ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

ডেভিড আজও বিস্ময়

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ডেভিড আজও বিস্ময়

মাইকেল এঞ্জেলো বলেছিলেন ‘তিনি পাথর কুঁদে মূর্তি বানান না, তিনি তাদের করেন প্রস্তর শৃঙ্খল মুক্ত।’ প্রায় আড়াই বছর পরিশ্রমের পর এঞ্জেলো প্রস্তর কারাগার থেকে যাকে মুক্তি দিয়েছিলেন তার নাম হলো ‘ডেভিড’। ডেভিড মাইকেল এঞ্জেলোর অমর সৃষ্টি। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর যে কয়টি ভাস্কর্য মানুষকে দিনের পর দিন অবাক করে রেখেছে তাদের মধ্যে ডেভিডের নাম সবার আগে চলে আসে। শুরু থেকেই ডেভিড পৃথিবীর মানুষের কাছে দৈহিক সৌন্দর্য আর শৌর্যবীর্যের প্রতীক। যুগে যুগে যা মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে গেছে অসম্ভবকে সম্ভব করার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ডেভিড নির্মাণ করেন এঞ্জেলো। ডেভিড কোথায় স্থাপিত হবে সেই স্থান নির্বাচন করেছিলেন ফিলিপিনো লিপ্পি, বত্তিচেল্লি, ভিঞ্চির মতো বিশ্ব কাঁপানো শিল্পীরা। ১৫০৪ সালের এপ্রিলে ডেভিড এর নির্মাণ শেষ হলে তা স্থাপন করা হয় পালাৎসো ভেক্কিওর প্রবেশ মুখের সামনের অঙ্গনে। একবারে রাস্তার ওপরে থাকায় ভাস্কর্যটি বিভিন্ন আক্রমণের শিকার হয়। একটি অযাচিত দুর্ঘটনায় ভাস্কর্যের বাঁ হাত ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে ভাস্কর্যটি ফ্লোরেন্সের একাডেমিয়া দি বেলে আর্টের গ্যালারিতে রাখা হয় ১৮৭৩ সালে। এখনও সেখানেই আছে। যে ডেভিডকে পাথরের নির্জীব ভাস্কর বানিয়ে রীতিমতো বিশ্ব মাতিয়ে দিয়েছেন এঞ্জেলো আসলে কে সেই ডেভিড? ভাস্কর্যটি প্রতিনিধিত্ব করছে বাইবেলের নায়ক ডেভিডকে। হিব্রু বাইবেলের মতে ডেভিডকে মনে করা হতো ইসরাইলের আসল রাজা। গ্রীক সৌন্দর্য দেবতা এ্যাপোলোকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। গলিয়াথের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাকে পুরো জাতির সাহসিকতার প্রতীক বলে মনে করা হয়। গলিয়াথ ছিল যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী সে সময়ের সেরা একজন। যিশুর আগমনের আগ থেকেই গলিয়াথকে ঈশ্বরবাদী একজন প্যাগান হিসেবে মনে করা হতো। এক কথায় বলতে গেলে গলিয়াথের বিরুদ্ধে ডেভিডের যুদ্ধকে দেখা হয় মন্দের বিরুদ্ধে ভালর, আর মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের যুদ্ধ হিসেবে। ইতিহাসের চোখে ডেভিড মানে রক্ষাকর্তা। ইসলাম ধর্মে ডেভিডকে নবী দাউদ হিসেবে সবাই চেনে। ডেভিড হলো এক পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত নগ্ন তরুণের অবয়ব। বেদীসহ প্রায় সতেরো ফুট উঁচু কিন্তু সেই তুলনায় একটু পাতলাই মনে হয়। ডেভিড তৈরিতে পাহাড় থেকে কেটে আনা যে বিশাল পাথরের টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। ডেভিড ভুলোকের সবচেয়ে বিখ্যাত আর নান্দনিক ভাস্কর্য। এ এক অপরূপ বিস্ময়ের আধার। দাঁড়িয়ে আছেন ডান পায়ের ওপর সমস্ত শরীরের ভার রেখে বা হাঁটু আলগা করে নগ্নদেহে দাঁড়িয়ে। কাঁধ ও কটি সমান্তরাল নয়। উর্ধাঙ্গের পেশী টানটান, ইংরেজী এস অক্ষরের আভাস আছে একটু যা বহু প্রচলিত মানবদেহের পক্ষে নিখুঁত ভঙ্গি। বাঁ হাত টানটান কিন্তু ডান হাত শ্লথ। বাঁ হাত বুকের কাছে ওপর দিকে মুড়ে তার অবস্থান। ডান হাতের বদ্ধ মুষ্ঠির দৃঢ়তা বোঝা যাচ্ছে স্ফীত শিরার ইঙ্গিতে। ডান হাতের মুঠিতে গুলতির হাতল। গুলতির ফিতে পিঠ দিয়ে উঠেছে। থলিটি বাঁ কাঁধে ধরে রেখেছে বাঁ হাত। অপূর্ব ডেভিড গ্রীক পুরুষোচিত সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা। শরীরের প্রতিটি মাপ নিখুঁত, আদর্শ পুরুষের দেহের মাপ। দারুণ আত্মবিশ্বাসী এই ডেভিড। ডেভিড ক্ল্যাসিকাল গ্রীক বা রোমান ভাস্কর্যের মতো শান্ত, সমাহিত বা সংযত নয়। শরীর প্রচ- শক্ত সমর্থ, কোথাও এতটুকু মেদ নেই। দাঁড়ানোর ভঙ্গি, শরীরী অভিব্যক্তি, বিস্ফোরিত দৃষ্টি, কোঁচকানো ভ্রু, ললাটে কুঞ্চিত রেখা সবকিছু শরীরে ও মনে বেশ আলোড়ন তুলেছে। গুলতিটি কাঁধে এমনভাবে রাখা যে তিনি যে কোন সময় গুলতি ছুড়তে সক্ষম। দেহ মনে প্রচ- আত্মবিশ্বাসী ডেভিড এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন যে আগামী দিনে তিনিই হবেন ফ্লোরেন্সের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। দুই চোখ পূর্ণ উম্মীলিত, নাসিকারন্ধ্র স্ফীত, ভূমধ্য পেশী কুঞ্চিত, দৃষ্টি দূরান্বেষী। সারা মুখ যেন ফেটে পড়েছে উত্তেজনায়, আশঙ্কায় নাকি অভাবনীয় কিছুর প্রত্যাশায়? বা পায়ের একটি নখ ভাঙ্গা দেখিয়েছেন এঞ্জেলো। কিছু কিছু অঙ্গের যথা মাথা ও ডান হাতের মাপ বাকি কাঠামোর তুলনায় একটু বড় দেখায়। ভাস্কর্যটি এমন ভাবে গড়েছেন যে দেখলে মনে হয় প্রাণসত্তা পাথরের বন্ধন ভেঙ্গে বের হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। একটু লক্ষ্য করলেই তার হাত, পা, কাঁধ সর্বত্রই ছড়ানো রক্ত পরিবহনকারী শিরা-উপশিরা পরিষ্কার বোঝা যায় অবিকল মানুষের মতো। হয়ত আরেকটু ভালমতো খেয়াল করলে দেখা যেত সেই শিরা- উপশিরা দিয়ে রক্ত চলাচলও করছে। শ্বেত পাথরের এ ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে থাকেল মনে হয়, কী নারী, কী পুরুষ, ডেভিড সবার কাছে সুন্দর ও আকর্ষণীয়। কে বিশ্বাস করবে নাক, চোখ, মুখ, চুল সব নিরেট পাথর কেটে করা। ডেভিডের চোখ আর মুখের দিকে তাকালে মনে হয় এঞ্জেলো গলিয়াথের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী ডেভিডের প্রতিকৃতি বানিয়েছেন। যেখানে ডেভিডের চোখে মুখে আমরা একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখি যে, যে কোন সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিছুটা চিন্তার ছাপও পাওয়া যায় ডেভিডের চোখে মুখে। ডেভিডের কাঁধে যে স্লিংশর্টটি রয়েছে তা প্রায় অদৃশ্য যেটা আসলে গলিয়াথের ডেভিডের বিজয়কে যতটা না শক্তির তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় হিসেবে বোঝায়। ডেভিডের দাঁড়ানোর ভঙ্গি বুঝিয়ে দেয় শত্রুদের যুদ্ধের আগে সতর্কবাণী। ডেভিড যখন তৈরি করা হয় তখন রোমের সঙ্গে ফ্লোরেন্সের বেশ টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু এঞ্জেলো যখন এই ডেভিড প্রাসাদ চত্বরে স্থাপন করলেন তখন এটি হয়ে উঠল ফ্লোরেন্সের প্রতিরোধের প্রতীক। ফ্লোরেন্সের মানুষ ডেভিডের মাঝে শক্তি খুঁজে নিতে শুরু করল। এঞ্জেলোর ডায়েরির পাতাতে পাওয়া ডেভিড সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ‘সে পৌর বীর। সে একটি সতর্কবাণী। এ রাজ্যকে ন্যায়ানুগভাবে চালনা করতে হবে। নির্ভয়ে রক্ষা করতে হবে। তা সে যেই রাজ্য চালনার ভার নাও না কেন? সজাগ দৃষ্টি, বৃষস্কন্ধ, প্রাণহারীর হাত, শরীর অফুরান শক্তির উৎস, অন্যথা হলে সে আঘাত হেনে শাস্তি দিতে উদ্যত।’ মাইকেল এঞ্জেলোর সময় ইউরোপে বিশেষ করে ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর মাধ্যমে এক পুরনো গ্রীক দর্শনের নবজাগরণ ঘটেছিল, তার নাম নিও প্লেটোনিজম। এঞ্জেলো যৌবনে ছিলেন সেই মতের এক সার্থক সাধক। এই দর্শনে সৌন্দর্যের মূল ছিল অবিসংবাদী, ‘সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য’ মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এই দার্শনিকরা এবং সুন্দর মানব যে সুন্দরতম সেই ঈশ্বরেরই প্রকাশ, এই তত্ত্ব তাঁরা প্রচার করতেন। এঞ্জেলো তাঁর ডেভিডকে করলেন মানুষী মানদ-েই অসামান্য সুন্দর, আর সেই সুন্দরই হলো সত্য। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অবিচার প্রস্তরীভূত মনুষ্যত্বকে যেভাবে আন্দময় জয়ধ্বনি দিয়ে মুক্তি দিলেন এঞ্জেলো, তা অনন্য এবং শুধু এ কারণেই তাঁর কৃতী চিরজীবী হয়ে থাকবে। ডেভিড ও গলিয়াথের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কোন মুহূর্তটি শিল্পী ধরে রাখলেন তাঁর ভাস্কর্যে তা খুবই রহস্যজনক। ডেভিডের সর্ব শরীরে প্রবল উত্তেজনা প্রকাশিত। সেই সাক্ষ্য ধরলে পাল্লাটা ঝুঁকছে যুদ্ধের অব্যাহিত আগের দিকে। যুদ্ধে নামবেন এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, এখন আরদ্ধ কাজের শুরু। এই দুই ঘটনার মধ্যকার মুহূর্তটির ভাস্কর্য। ভ্রু সঙ্কুচিত, দুই চোখ যুদ্ধক্ষেত্রে গলিয়াথ কোথায় তার সন্ধান করছে। এ ভাস্কর্য জয়ীর আনন্দোচ্ছল ভাস্কর্য নয়, এ এক চিন্তাশীল, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কর্ম বীরের প্রস্তর আলেখ্য। পুরো ভাস্কর্যটিকে যদি ঘড়ির কাঁটার দিকে আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে দেয়া যেত তাহলে ঠিক হতো। এখানে দেখি ডেভিড উত্তেজিত, কিন্তু উত্তেজনা সংহত করে সে আপাতত প্রশান্ত মূর্তিতে গলিয়াথের প্রতীক্ষা করছে, মুখের ভাবে খানিকটা অবজ্ঞা, খানিকটা প্রত্যয় আর খানিকটা শঙ্কা। ডেভিডের তীর্যক চক্ষু খানিকটা ট্যারা, বিশেষজ্ঞদের মতে এটি এঞ্জেলোর শৈল্পিক কৌশল। মাটিতে দাঁড়ানো দর্শক যদি ভাস্কর্যটির বাঁ দিক থেকে আসেন তাহলে দেখবেন যে তাঁর বাঁ চোখটি চেয়ে আছে দর্শকের দিকে বা তার মাথার ওপর দিয়ে গলিয়াথের দিকে। গুলতি ছুড়তে গেলে যেমনটি হওয়া উচিত। গুলতির ঝুলিটি এমনভাবে রাখা আছে যে ডান চোখটি দেখা যাচ্ছে না। আবার দর্শক যদি ডান দিক থেকে ভাস্কর্যটির কাছে আসেন তাহলে নাকের আড়ালে বাঁ চোখটি দেখা যাবে না, কিন্তু ডান চোখটির দৃষ্টি সুদূর প্রসারী, শক্তি, বুদ্ধি ও তীক্ষèতার সমন্বয় আরদ্ধ ভাব ভাস্কর্যটির, যা হওয়া প্রয়োজন। আর সরাসরি দেখলে এই তীর্যকতা বোঝা যাবে না। উত্তেজিত পেশীরাশির সঙ্গে শ্লথ পেশীগুচ্ছের সমন্বয় ঘটিয়ে বিচার করলে এও বলা যায় যে দৃশ্যটির কাল গলিয়াথ বধের অব্যবহিত পরে। মানুষের মধ্যে যা শুভ, যা শিব, তার জয় হয়েছে, দানব পরাস্ত। মানুষ তার আত্মশক্তির ওপর বিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। সে এখন চেয়ে আছে ভবিষ্যতের অসীম, অনাবিল প্রতিশ্রুতির দিকে। নতুন ঊষার সূর্যের পানে চাহিল নির্ণিমিখ। কেউ কেউ ভেবেছিলেন ভাস্কর্যটির মধ্যে রক্ষাকবচের শক্তি আছে। মনুষ্যত্বের মুক্তি ডেভিডের রূপে, আত্মবিশ্বাসে অবিচল, পুরনোকে বিদায় দিয়ে সম্ভাবনাশীল ভবিষ্যতের মোকাবেলায় প্রস্তুত। গুলতির গড়ন প্রচলিত গুলতির থেকে আলাদা তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ডান হাতে ধরা ইংরেজীটি আকৃতির হাতল আর কুঁচনো কাপড়ের বদলে চওড়া ফিতের ব্যবহার দেখে অনেকে সন্দেহ করেছেন যে গুলতিটি খুব একটা কাজের নয় এবং যেভাবে এঞ্জেলো তার হাতে গুলতি ধরিয়েছেন সেভাবে জোড়ে পাথর ছোড়া অতি কঠিন। তারপর পাথর রাখার থলি কোথায় গেল? শেষের দুটি প্রশ্ন ভাবলে ভাস্কর্যটি গলিয়াথ বধের পরের দৃশ্য বলে মনে হয়।
×