ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তাশরিক-ই-হাবিব

জাদুবাস্তবতা অথবা নয়নতারা ফুলের কথামালা

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জাদুবাস্তবতা অথবা নয়নতারা ফুলের কথামালা

উত্তরাধুনিক সাহিত্য ভাবনার অন্যতম কৌশল তথা জাদুবাস্তবতাকে প্রয়োগে শহীদুল জহিরের পারদর্শিতা তাঁর বিভিন্ন গল্প, উপন্যাসে লক্ষণীয়। তাঁর পূর্বসূরি কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাতে এর উপস্থিতি সত্ত্বেও জহির একে হাতিয়ার করে তুলেছেন ব্যতিক্রমী ভাবনা ও অপ্রচলিত আঙ্গিকে গল্প, উপন্যাস লেখার প্রয়োজনে। তাঁর কথাসাহিত্যে এর কৌশলী উপস্থিতি পাঠকদের আগ্রহী করে তোলে সংশ্লিষ্ট রচনার তাৎপর্য অনুধাবন এবং এ প্রসঙ্গে লেখকের অবস্থান বুঝে উঠতে। এ কারণেই আমরা এ ধরনের রচনার দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁর ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ গল্পটি পাঠ করব। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামো স্বাধীন বাংলাদেশে অনুসৃত হওয়ায় চাকরি নামক শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্যক্তি মানুষের সম্ভাবনা, কর্মোদ্যম ও মানবীয় অনুভূতির অপমৃত্যুজনিত ইতিবৃত্ত রূপায়ণে এ গল্পে লেখকের প্রধান হাতিয়ার জাদুবাস্তবতার বিবিধ প্রকৌশল। ঔপনিবেশিক জীবনের অবরুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে এ গল্পে আগারগাঁও নামক সরকারী কলোনিতে বসবাসরত এমন কিছু মানুষের বৃত্তান্ত উপস্থাপিত, যারা পারস্পরিক সম্পর্কে অনাগ্রহী, কৌতূহলশূন্য, নিস্পৃহ। বিভিন্ন সরকারী অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সৃষ্ট এ কলোনিতে সামাজিক মর্যাদা ও আধিপত্যের মানদণ্ডে কেরানিদের অবস্থান নিঃসন্দেহে তলদেশে। এদেরই প্রতিনিধি হিসেবে এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তথা কালো, শীর্ণ ও মধ্যবয়সী আবদুস সাত্তারের জীবনচর্যার রূপায়ণে লেখকের অভিনিবেশ বিশেষ উদ্দেশ্যপুষ্ট, তাৎপর্যবহও বটে। পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ ও সমাজ বাস্তবতার পরিমণ্ডলে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ ব্যক্তি মানুষের অন্তর্লোকে সন্নিহিত একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গের বীজ শিকড় বিস্তারের অনুকূল আবহে তাকে একপর্যায়ে সংবেদনাশূন্য যন্ত্রমানুষের পর্যায়ে অবনমিত করে। বর্ষাস্নাত এক অপরাহ্ণে কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে গিয়ে আকস্মিকভাবে অসতর্কতাবশত পা পিছলে অপদস্থ হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক বিবেচনায় অসতর্কতা ও অমনোযোগের পরিণতি হিসেবে গণ্য করাটাই যুক্তিসম্মত। কিন্তু সমগ্র গল্পপাঠের অভিজ্ঞতার আলোকে সংবেদনশীল পাঠক এ ঘটনার অন্তরালেই পরবর্তী পর্যায়ে পেয়ে যায় পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তির মনোজাগতিক শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের ভয়াবহ রূপটি। সেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সহায়তার জন্য আগত প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ সৃষ্টি হলেও সে সামাজিকতাকে কখনও গুরুত্ব দেয়নি। সংসারের গণ্ডিতেও আবদুস সাত্তারের উপস্থিতি এতটাই নীরব ও নিষ্ক্রিয় যে, এ ঘটনার পর স্ত্রীকে ‘পইড়া গেলাম কেদোর মইধ্যে’ উচ্চারণেই তার প্রতিক্রিয়া অভিব্যক্ত হয়। রুটিনমাফিক দৈনন্দিন জীবনে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সময় অতিবাহিত করার তাড়নায় তার অবলম্বন হয়ে ওঠে ছোট ব্যালকনিটি। বিকেল ফুরিয়ে রাত নেমে এলে অন্ধকার তাকে নীরবে গ্রাস করে। ‘সে দেখে দিনের আলো মুছে যাওয়ার পর অন্ধকার কেমন গভীর আর স্পর্শযোগ্য হয়ে ওঠে; সে তাকিয়ে থাকে শুধু, এতে তার কোন আনন্দ অথবা ক্লান্তি হয় না, যেমন, কেরানির সরকারী চাকরিতে সে ক্লান্তিও বোধহীনভাবে লেগে থাকে।’ গড়পরতা বাঙালী কেরানির প্রত্যাশিত জীবনভাবনা অনুযায়ী সরকারী চাকরি নামক সোনার হরিণ, স্ত্রী, সন্তান, সংসার সবকিছু অর্জনের পরও সে প্রতিমুহূর্তে নিঃসঙ্গ। তাই স্ত্রীর প্রতি তার আচরণে প্রতিবিম্বিত হয় না প্রেমের প্রগাঢ়তা অথবা সন্তানদের প্রতি বাৎসল্যবোধ। সামাজিক প্রতিবেশে ব্যক্তির অবস্থান নিরাপত্তার নিñিদ্র ব্যুহে সুরক্ষিত হলেও উপর্যুক্ত শ্রেণির গড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ, মানুষ ও পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে প্রবঞ্চিত মানসিকতা, তা থেকে আবদুস সাত্তারের মতো কেরানির মুক্তি অসম্ভব। তাই অফিসের ক্লান্তিকর চাকরি বা বাসায় অবস্থানকালে তার বোধে অনুভূত হয় না কোন স্বাতন্ত্র্য। কেননা, যেখানে নিছক সময়কে অতিবাহিত করাই ব্যক্তির অভীষ্ট, সেখানে স্বজন বা অচেনা প্রতিবেশীর মধ্যে কোন ভিন্নতা অনুধাবনে সে অসমর্থ হলেও তার চিত্তে এজন্য অতৃপ্তির সঞ্চার ঘটে না। কারণ তার চরম উপলব্ধি হলো, পৃথিবীতে সে একা, সঙ্গীহীন। বিশ শতকের চরম বৈষম্যপূর্ণ পুঁজিবাদী সমাজের গড়পরতা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক ক্লেদ, গ্লানি ও অবক্ষয়জাত সঙ্কট এমনই অপ্রতিরোধ্য গতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে যে, আবদুস সাত্তারের মতো ব্যক্তির পক্ষে এই গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তির একমাত্র সোপান হয়ে ওঠে মৃত্যু। স্ত্রী শিরিন বানুর বৃক্ষপ্রীতির গুণে তার বাসা নিকুঞ্জসদৃশ নিবিড় প্রশান্তিদায়ক আশ্রয়ে উন্নীত, যদিও তা আবদুস সাত্তারের নিস্পৃহ চেতনালোকে কোন আলোড়ন তোলে না। যন্ত্রনির্ভর সমাজে প্রকৃতিবিমুখতার অপবাদ মুছে ফেলতেই যেন শিরিনের দেখাদেখি কলোনিবাসী বিভিন্ন গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লালনসূত্রে পারস্পরিক দূরত্ব অতিক্রমে সচেষ্ট হয়। কিন্তু নিঃসঙ্গ আবদুস সাত্তার তখনও থেকে যায় দলছুট। অধিবাসীদের যৌথ উদ্যোগ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলোনিটি প্রকৃতির বর্ণাঢ্যতায় শোভিত হলে এর অনিন্দ্য হাতছানিতে অচিরেই আবির্ভাব ঘটে হলুদ রঙের প্রজাপতিকুলের। তাদের আনন্দোচ্ছ্বল নৃত্য প্রথমদিকে কলোনিবাসীকে শঙ্কিত করলেও এর অবসান ঘটে বিকেলের গোধূলি আলো ম্রিয়মাণ হলে তাদের অন্তর্ধানের ঘটনায়। লালচে বেগুনি রঙের নয়নতারা ফুলে আচ্ছাদিত এ কলোনির প্রতি প্রজাপতিদের মোহমুগ্ধ আকর্ষণের ঘটনায় অচিরেই সমগ্র শহরে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড কৌতূহল। এ খবর সংবাদপত্রের পাতায় সচিত্র প্রতিবেদনসহ প্রকাশের পর উৎসুক মানুষ চিত্তবিনোদনের নতুন মাধ্যম হিসেবে সেই কলোনির সম্মুখবর্তী রাস্তায় উপস্থিত হয়। কিন্তু বৈচিত্র্যসন্ধানী মানুষের নিকট কিছুদিনের ব্যবধানেই এ ঘটনা একঘেয়েমিপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় তারা প্রজাপতিদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে থাকে, অন্যদিকে কলোনির সামনে সমবেত মানুষের নিকট থেকে কিছু উপার্জনের উদ্দেশ্যে ভিড় জমে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতাদের। ফলে এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়াতে নগরে শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে অস্থায়ী পুলিশি প্রহরার পাশাপাশি সংবিধিবদ্ধ সতর্কবাণী জারি করা হয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের অধীনে প্রজাপতিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদে। নিঃসন্দেহে এসব ঘটনায় রয়েছে জাদুবাস্তবতার প্রভাব। কেননা, অন্য কোন ফুল এবং ভিন্ন রঙের প্রজাপতির পরিবর্তে শুধু হলুদ প্রজাপতির একমাত্র নয়নতারা ফুলের প্রতি সম্মোহিত হওয়ার প্রসঙ্গটি গল্পভাষ্য নির্মাণের জন্য জরুরী হলেও তেমন বাস্তবসম্মত নয়। উপর্যুক্ত ঘটনারাশি বিন্যাসে লেখকের শিল্পভাবনায় সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ সক্রিয়। সেটি হলো, বাস্তব জগতের সঙ্গে মনোজগতে সম্পর্কচ্যুত, নিস্পৃহ আবদুস সাত্তারের চেতনালোকে পরিবর্তন সাধনের রূপরেখা নির্দেশ। লেখক জানিয়েছেন, কলোনিতে প্রজাপতিদের আবির্ভাবের পর এক বছর অতিক্রান্ত হয়। এ সময়ে ‘আবদুস সাত্তার একটি অসার এবং অবশ্যম্ভাবী প্রস্তরখণ্ডের মতো নিশ্চল অস্তিত্ব নিয়ে জেগে থাকে’। প্রজাপতির উপস্থিতি তার স্থবির মনোলোকে আদৌ আবেদন সঞ্চার করে না। বরং এর আকর্ষণে এ কলোনির প্রতি বিমুগ্ধ দর্শকদের ঢিল নিক্ষেপের ঘটনায় বিরক্ত হয়ে সে ব্যালকনি পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার এ ভাবনা অচিরেই বদলে যায়, নতুন সামরিক সরকারের উদ্যোগে মিরপুর চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নের পর চিত্তবিনোদনের তাগিদে নগরবাসীর এ কলোনির পরিবর্তে সেখানে বেড়াতে যাওয়ায়। তবে এ পর্যায়ে তার প্রতি স্ত্রীর পরকীয়া প্রণয়গত অভিযোগের প্রত্যুত্তরে অতীতের দাম্পত্যজীবনের ক্লেদাক্ত কোন অধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় প্রকাশিত হয় তাদের প্রেমহীন যান্ত্রিক জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা। এভাবেই আবদুস সাত্তারের জীবনলিপির প্রতিটি পাতা হয়ে ওঠে গতানুগতিক, অভ্যস্ত ও ধরাবাঁধা দিনযাপনের অর্থহীন পুনরাবৃত্তি। ফলে সমাজ-সংসারের কোন ঘটনাতেই তার চিত্তভূমিতে জাগে না আগ্রহ, জিজ্ঞাসা। কারণ ইতোমধ্যেই সে হারিয়ে ফেলেছে কৌতূহল, বিস্ময়বোধ। কিন্তু জীবনের প্রতি প্রগাঢ় মমতা যে তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তখনও বিলীন হয়ে যায়নি, তা ইতঃপূর্বে উপলব্ধি না করলেও আকস্মিক ভূমিকম্পকালে সে উক্ত বোধের দ্বারা তাড়িত হয়ে বারান্দার রেলিঙে দড়িবাঁধা নয়নতারা ফুলের দুটি টবকে রক্ষার প্রচেষ্টায় নিজেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এ দুর্যোগের ঘটনায় আগারগাঁও কলোনির একমাত্র মৃত ব্যক্তি আবদুস সাত্তারের পাশাপাশি সকল নয়নতারা গাছের উন্মূলিত হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে বাস্তবতার গণ্ডি অতিক্রমপূর্বক জাদুবাস্তবতায় উত্তীর্ণ। নয়নতারার প্রতি জীবদ্দশায় তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশিত না হলেও ভূমিকম্পকালীন সঙ্কটের মুহূর্তে দুটি নয়নতারা গাছকে রক্ষার জন্য নিজেকেই মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উন্নীত করার তার যে অবিশ্বাস্য প্রয়াস, (যদিও তা আবদুস সাত্তারের ইচ্ছাকৃত নয়, বরং সেই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তার সহজাত বোধের দ্বারা তাড়িত হওয়ার শোচনীয় পরিণতি) এরই অনিবার্যতায় হয়ত কলোনির মাটিতে প্রতিপালিত সব নয়নতারা গাছ মৃত্যুবরণ করে। এরপর কলোনিবাসীর নবোদ্যমে নয়নতারার চারা নতুনভাবে রোপণের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেগুলোর অকালমৃত্যু ঘটে। তাদের উদ্যোগে কৃষি কলেজের জনৈক অধ্যাপকের প্রযতেœ এদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক মাসের কঠোর পরিশ্রমও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এসব ঘটনার মূল ভিত্তি নিঃসন্দেহে জাদুবাস্তবতা। উক্ত কৃষিবিদের অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়, আবদুস সাত্তারের মস্তিষ্কের গলিত মগজ কলোনির যে স্থানে পতিত হয়েছিল, শুধু সেখানেই নতুন চারটি নয়নতারা গাছ গজিয়েছে, অন্যত্র নয়। এমনকি এদের কোনটিকে অন্যত্র সরানোর প্রচেষ্টা চালাতেই সেটি মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। অথচ আগের স্থানে আনলে সেটি ফিরে পায় প্রাণবন্ত রূপ। এ ঘটনার অস্বাভাবিক ও অব্যাখ্যাত কার্য-কারণের স্বরূপ সম্পর্কে কৃষিবিদের অনুমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে পূর্বোক্ত হলুদ প্রজাপতির উদ্দীপক ভূমিকা পালনের প্রসঙ্গ। কৃষিবিদের মতে, গাছগুলো আত্মহত্যা করেছে। ‘আত্মহত্যার এই ইচ্ছে প্রথমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায় গাছগুলোর নৈকট্যের কারণে এবং প্রজাপতি সম্ভবত এই প্রক্রিয়ায় মেসেঞ্জারের কাজ করেছে; পরে, আমার সন্দেহ হয়, মাটিরও কোন এক ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে। আমি পলিথিনের ব্যাগের ভেতর একটি চারাকে এভাবে বাঁচাতে পেরেছিলাম। তবে, এভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা যায়, বাগান করা যায় না।’ কৃষিবিদের এ বক্তব্য বাস্তবতার শর্তকে এড়িয়ে পরাবাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে সম্ভাবনা আর কার্য-কারণের সমীকরণে থেকে যায় অনিশ্চয়তা, সংশয় ও দ্বিধা। অর্থাৎ এমনটি বাস্তবে ঘটার সুযোগ নেই বলে ভাবলেও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া চলে না। নতুন রাস্তা নির্মাণ ও জঞ্জাল নির্মূলের প্রয়োজনে গণপূর্ত বিভাগের অবশিষ্ট নয়নতারা গাছগুলো কাটায় আগারগাঁও কলোনি এ গাছশূন্য হয়ে পড়ে। স্মর্তব্য, গাছগুলো রক্ষার জন্য আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর ঘটনা আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছামৃত্যু নয়, বরং নিছক দুর্ঘটনা। তার মস্তিষ্কের গলিত মগজের রসে পুষ্ট হয়ে নয়নতারা গাছের অচিরেই জন্মগ্রহণ এবং পূর্ববর্তী গাছসমূহের মৃত্যুর ঘটনায় লেখক কোন বিশেষ ইঙ্গিত প্রকাশে আগ্রহী। আবদুস সাত্তারের মতো আপাতনিষ্ক্রিয় কেরানি, যে আত্মচারী স্বভাবের জন্য পরিবার ও সমাজে ‘পাগল’ হিসেবে একাধিকবার আখ্যায়িত হয়েছে, তার সংবেদনশীলতার পরিচয় কলোনিবাসী, এমনকি শিরিন বানু না পেলেও তা পরিস্ফুট হয় ভূমিকম্পের সংঘটনকালে নয়নতারা গাছের প্রতি তার বিস্ময়কর ভালবাসার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশে। অর্থাৎ কলোনির অবরুদ্ধ সমাজে সংবেদনশীল মানুষের সকল সম্ভাবনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও জীবনের প্রতি প্রগাঢ় মমত্বের বোধ তার চেতনালোকে সংগুপ্ত থেকেই যায়; যা তাকে উদ্বুদ্ধ করে ধরাবাঁধা শৃঙ্খলে আবদ্ধ অবস্থাতেও অন্যকে বিপন্নতার করালগ্রাস থেকে উদ্ধারে। তবে এর বাস্তবায়ন যে দুরূহ, তা গল্পের পরিণতি অংশেই নির্দেশিত। গল্পটিতে আকস্মিক ভূমিকম্পে জনজীবনের বিপর্যয় প্রতীকী তাৎপর্যে স্বৈরাচারী রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পরিণতিতে সৃষ্ট সঙ্কটকেই জাদুবাস্তবতার আবহে ইঙ্গিতপূর্ণ করে তোলে। কলোনিবাসী এর প্রতিষ্ঠাতাদের নির্দেশানুযায়ী পরাধীন অথচ নিরাপদ, শৃঙ্খলিত জীবনে অভ্যস্ত হতে বাধ্য। তবু নয়নতারা গাছগুলোর স্বেচ্ছামৃত্যু পরোক্ষ অর্থে কলোনিতে অবরুদ্ধ সংবেদনশীল মানুষের অন্যের দ্বারা প্রতিপালিত হয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার সুযোগকে উপেক্ষাপূর্বক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণেরই প্রতীক। তাছাড়া কলোনিটি যে সামরিক শাসনের আশ্রয়স্থল তথা অবরুদ্ধ বাংলাদেশেরই রূপক, তাতেও সন্দেহ থাকে না। এভাবেই ভূমিকম্পকালীন সঙ্কটের ভয়াবহ মুহূর্তে নয়নতারা গাছকে রক্ষার প্রচেষ্টায় আবদুস সাত্তারের অপমৃত্যু এবং পরবর্তী পর্যায়ে কলোনিবাসীর নতুন উদ্যোগে নয়নতারা গাছ রোপণের প্রচেষ্টাগত ব্যর্থতা সমার্থক হয়ে ওঠে। গাছগুলোর স্বেচ্ছামৃত্যু পরোক্ষ অর্থে কলোনির প্রতি সংবেদনশীল মানুষের বিদ্রোহ এবং এর অবসানকল্পে তাদের আত্মত্যাগের সমুন্নত মহিমায় উত্তরণের প্রতীকী তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। এ গল্পে কলোনির বদ্ধায়ত পরিবেশে বৈকল্যগ্রস্ত মানুষের সীমাবদ্ধ পরিসরে প্রকৃতিকে প্রতিপালনের প্রতীকে লেখক বাংলাদেশে আশির দশকের সামরিক শাসনের অভিঘাতে জনজীবনের বিপন্নতার ভয়াবহ রূপকেই জাদুবাস্তবতার প্রকরণে উন্নীত করেছেন।
×