ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এবিএম রমজান আলী

যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ...

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ...

‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ সুকান্তের সংক্ষিপ্ত জীবন এই অঙ্গীকার রক্ষারই ইতিহাস। কৈশোর থেকেই প্রজ্বলিত আদর্শের নিষ্ঠাপূর্ণ অনুসরণের পথে জীবনটি উৎসর্গ করে গেছেন তাঁর একমাত্র উদ্দিষ্ট ছিল সমাজটাকে বদলে জঞ্জালমুক্ত করে সুস্থ-সুন্দর করে যাবেন জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। কবি সুকান্ত ও কর্মী সুকান্ত অভিন্ন। এত অল্প সময়ে বঞ্চিত-নিপীড়িত অসহায় মানুষের এমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে ওঠা বিরলদৃষ্ট ঘটনা। তাঁর প্রকৃত পরিচয় নিহিত রয়েছে তাঁরই কবিতায়- ‘আমি এক ক্ষুধিত মজুর, আমার সম্মুখে আজ এক শত্রু : এক লালপথ শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ।’ লক্ষ্য নির্ধারণে, শত্রু নির্বাচনে সার্থক এই জীবনটি ছোট্ট হলেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। আর এই তাৎপর্যের মধ্যেই মিলেমিশে রয়েছে তাঁর সৃষ্টির অসীম সাফল্যের রহস্য। গণজীবন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং সৃষ্টিধারাÑ এই সবকিছু একাকার হয়ে সুকান্তের মধ্যে এক কবি ব্যক্তিত্বে জন্ম দিয়েছিল। যে ব্যক্তিত্ব সমকালে স্পষ্ট, উত্তরকালে স্পষ্টতর। শুধু সৃষ্টিমূল্যেই নয়, যে জীবন ও কথায় সত্য আত্মীয়তা অর্জন করেছিল জনগণের, সেই জীবনটিও প্রাণিধানযোগ্য। তাঁর আচার-আচরণে চেহারায় কিন্তু দামাল ছেলের কোন পরিচয় ছিল না। ধুতি-শার্ট পরনে, মাথাভর্তি একরাশ চুল, সামনে ঈষৎ ঝুঁকে চলা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ দোহারা ছেলেটির আর পাঁচটা সমবয়সী ছেলের থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। খেলার মাঠে হুটোপুটি, অকারণ গল্পগুজব করা বালক বয়সের এই স্বভাব-ধর্ম সুকান্তের মধ্যে ছিল না বললেই চলে। ওই বয়স থেকেই তিনি ছিলেন বয়স্কদের দলে। যেন রাজ্যের চিন্তা ও সমস্যা ভিড় করে থাকত তাঁর ছোট্ট মাথাটিতে। ধীর অথচ ঋজু ছিল বাকভঙ্গি, কোথাও ছিল না এতটুকু বাহুল্য। ১৯৯৩ সালের ৩০ শ্রাবণ (১৫ আগস্ট ১৯২৬) কালীঘাটের ৫২নং মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে সুকান্তের জন্ম। বাড়িটি মাতামহ সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের। সুকান্তের আদিনিবাস ছিল পূর্ব বাংলার ফরিদপুরে। পিতামহের অকাল মৃত্যুতে তাঁর অসহায় জ্যাঠামশাই ও পিতাকে অল্প বয়সেই ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা শহরে এসে উঠতে হয়। সংস্কৃত প-িত ও বাগ্মী হিসেবে তাঁর জ্যাঠামশাই কৃষ্ণ চন্দ্র ভট্টাচার্যের সেকালে খুব ডাকনাম ছিল। তাঁর পিতা নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য স্কুল-কলেজের শিক্ষা বেশিদূর গ্রহণ করতে না পারলেও স্বীয় চেষ্টায় সংস্কৃত সাহিত্যে যথেষ্ট পা-িত্য অর্জন করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যাভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। সুপ-িত ও সুসংস্কৃত জ্যাঠামশাই ও পিতার শিক্ষার পরিবেশে বাড়িতে গড়ে উঠে এক শিল্পময় আবহাওয়া। কোন ভাব, কল্পনা বা আদর্শ আকাশ থেকে পড়ে না, জীবনের মধ্যেই তার সৃষ্টি আর সেই জীবন সমাজবদ্ধ। অতএব যে কোন ভাব বা আদর্শের মধ্যেই আছে সৃষ্টিকালের সমাজচেতনা। সামাজিক ইতিহাসের মধ্যেই সে যুগের চেতনার সন্ধান করতে হয়। আবার যেদিন থেকে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, সেদিন থেকে দেখা যায় সমাজ দ্বিধাবিভক্ত শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ ও বিপ্লবকে স্তব্ধ করার জন্য ধনতন্ত্রের প্রবক্তা বা ধ্বজাধারীরা ফ্যাসিবাদের পথ গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হতে যাচ্ছে। অতএব এ যুগটা ছিল সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের যুগ আর সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার যুগ। সুকান্তের কবিতায় সর্বহারা শ্রেণীর সমাজ চেতনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, ‘পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের’। সেই যুগ সমাজতন্ত্রের যুগ। দ্বন্দ্বমূলক বাস্তববাদী নিয়মে গতিশীল সমাজবিরোধী শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে অবশেষে সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক পর্যায় শুরু হয়। লেখক শিল্পীরা সে পর্যায়ের আরম্ভকে ত্বরান্বিত করতে পারেন সৃষ্টির মাধ্যমে। এই আন্তর্জাতিক চেতনার জন্যই সুকান্ত বলতে পেরেছিলেনÑ ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,’ প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তার নিয়ামকদের ধ্বংসের ফলেই নবজাতকের আবির্ভাব সম্ভব হবে। সুকান্ত সেই নবজাতকের কবি। নবজাতকের বাসযোগ্য করে পৃথিবীকে গড়ার অঙ্গীকার নিয়েই তাঁর কাব্য সাধনা। সেই সাধনা এই যুগের সাধনা। “দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার হিসেবে খাত যখনি নিয়েছি হাতে দেখেছি লিখিতÑ ‘রক্ত খরচ’ তাতে; এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম, অবাক পৃথিবী। সেলাম, তোমাকে সেলাম।” ‘এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম’Ñ পরাধীন দেশের বঞ্চিত, অবহেলিত, উৎপীড়িত মানুষের গভীর ক্ষোভের কথা একটি বাক্যে অপূর্ব বাঙময়তা লাভ করেছে। বহু রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এদেশের বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন। কেবল এদেশেই নয়, তখন বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আক্রমণে সারা পৃথিবী রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। কবির গভীর সংবেদনশীল মন এসব দেখে-শুনে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। বিশেষ করে প্রাত্যহিক জীবন পথে প্রতি পদে পদে তিনি দেখেছেন শ্রেণিবৈষম্য। সুকান্তের কবিতা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। এই কবিতায় একদিকে যৌবন ধর্মের যেমন পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি যে যুগ ও পরিবেশে এই আঠারো বছর এসেছে তারও চমৎকার পরিচয় এসেছে। সব মিলিয়ে এই কবিতা হয়ে উঠেছে এক বিদ্রোহী কবিতা। এই বিদ্রোহ আছে যৌবনের স্বধর্মে। এই বয়সে কোন শ্রেণী ভেদাভেদ নেই। এই বয়সটাই দুঃসাহসের বয়স, প্রচ- ঝুঁকি নেয়ার বয়স, স্পর্ধা করার বয়স। এই সময় ভয়ভীতি নেই। নেই মাথা নত করে সবকিছু মেনে নেয়ার অবস্থা। বরং এই বয়স চায় পদাঘাতে সব প্রতিকূল পাথর ভেঙ্গে ফেলতে। জীবন মৃত্যু এ বয়সের কাছে মনে হয় অতি তুচ্ছ। তাই অনায়াসে তারা ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে চলে। এরা প্রতিশ্রুতি পালন করতে কোন দ্বিধা করে না। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন দুর্বার, শ্রমিক-কৃষক পাশাপাশি জেগে উঠেছে। পূর্বদিকে জাপানী আক্রমণে ‘গোপনে লাঞ্ছিত হই মৃত্যুর কবলে।’ বিদেশী চরেরা গোপন ষড়যন্ত্রে রত। ‘হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত।’ যুদ্ধের সঙ্গে এলো দুর্ভিক্ষ, মহামারী, এখানে, ‘ভুখা জ্বলে হাড়ে হাড়ে’ এ রক্তাক্ত দিনে নিশ্চিত উপবাসের মতো সুকান্তের মনে ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস। আত্মপরিচয়ে তিনি বলেনÑ ‘আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়, আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে, আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।’ স্বভাবতই ‘শান্তির ললিত বাণী’ ব্যর্থ পরিহাসের মতো শোনায়। অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামই একমাত্র পথ। সংগ্রামী পথে রক্তের আল্পনায় কবি কণ্ঠ সুদৃঢ় হয়ে ওঠেÑ ‘আমি এক ক্ষুধিত মজুর আমার সম্মুখে আজ এ শত্রু, এক লালপথ শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ।’ সুকান্তের দৃষ্টিতে ‘লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা।’ তাই তিনি সকলকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘রক্তে আনো লাল/রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল।’ দেশে দেশে এই পতাকা তিনি উড্ডীন হতে দেখেছেন মুসোলিনির পরাজয়ে (১৯৪৩), স্তালিনগ্রাদের বিজয়ে, হিটলারের আত্মহত্যায়, ফ্যাসিবাদের আত্মসমর্পণে। দেখেছেন মার্কসবাদী চিন্তা-ধারণার অসামান্য সাফল্য। এই সাফল্যে সংগ্রামী শ্রমিকের মতো কবির হৃদয়ও উল্লসিত। ‘আমার ঠিকানা খোঁজ করো শুধু সূর্যোদয়ের পথে, ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুশ ও চীনের কাছে।’ অর্থাৎ যেসব দেশে সর্বহারার নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা হতে যাচ্ছিল, কবি তাদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছেন। কারণ তিনি জানেন, ‘বুর্জোয়া সমাজের দাসত্বকে বহির্দৃষ্টিতে মনে হয় সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা। সুকান্ত নিজেকে কোন স্বাধীনচেতা কবি বলে মনে করেননি। কবি তাই নিজেকে অন্তলোকের অধিনায়ক মনে করেন। কবি সুকান্ত রম্যাঁ রঁলার মতো বলতে চেয়েছেন, ‘আমার সকল কাজ সকল ক্ষেত্রেই চিরদিই গতিপন্থী। যাহারা থামিয়া নাই, চিরদিন আমি তাদের জন্যই শিখিয়াছি। আমি নিজে কোনদিন থামি নাই; আশা করি যতদিন বাঁচিব থাকিব না। জীবন যদি সম্মুখপানে চির চলমান না হয়, তবে আমার কাছে জীবন অর্থহীন।’ সুকান্ত শ্রেণীহীন সমাজের বিশ্বাসী মানুষ। তাঁর লেখনীতেও তাই কোন আপোস নেই, গোপনীয়তা নেই। শব্দের কুহকজাল তিনি সৃষ্টি করেননি। লক্ষ্য তাঁর স্থির এবং সেই দুর্গম পথ রক্তাক্ত। জালিয়ানওয়ালার যে পথের শুরু, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনখ্যাত জালালাবাদের পথ ধরে শহীদ রামেশ্বরের রক্তে রাঙ্গা পথ সুকান্তের মৃত্যুর পরেও এগিয়ে চলেছে শ্রমজীবী সাধারণের নেতৃত্বে এক মহামানবসমাজ গঠনের পথে। কবি সুকান্তের ঠিকানা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে সেই পথের মাঝে। এমন দৃপ্ত ভঙ্গিমায় অত্যন্ত সহজ সরল করে সংগ্রামী মানুষের মনের ভাষাকে মুখর করতে পেরেছেন বলেই সুকান্ত এত জনপ্রিয় কবি। তাঁর সমাজ চেতনা শ্রেণী চেতনার ক্রমাগ্রগতির মধ্যেই ক্রমবর্ধমান। সুকান্ত আরেক অর্থেও নতুন যুগের প্রবর্তক। আধুনিক কবিতার সুদীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রবণতা। সুকান্তের মধ্যে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ বর্তমান। প্রান্তিক-নবজাতক জন্মদিনে সভ্যতার সঙ্কটের রবীন্দ্রনাথ সুকান্তের মধ্য দিয়ে আবার আধুনিক কবিতায় প্রতিষ্ঠিত হলেন। সুকান্তের কাব্য-ভাষাও রবীন্দ্র ঐতিহ্যের অনুসারী। সাম্যবাদী কবি সুকান্ত জনতার কবি হতে গিয়ে মানবপ্রেমিক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী রবীন্দ্র সত্তাকে ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।
×