ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

কবি শহীদ কাদরী ॥ অমরত্বের দিকে যাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কবি শহীদ কাদরী ॥ অমরত্বের দিকে যাত্রা

এ সামান্য শ্রদ্ধার্ঘটি যখন তৈরি হচ্ছে তখন কবি শহীদ কাদরী নীলিমা-নীলে, স্বদেশ-যাত্রায়। তাঁর প্রিয় শহর ঢাকা প্রস্তুত হয়ে আছে তাঁকে বরণ এবং অন্তিম অভিবাদন জানানোর জন্য। প্রায় চারটি দশক তিনি ছিলেন মাতৃভূমি থেকে দূরে। এই প্রবাসযাপনকে অনেকেই ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’ বলে থাকেন। এক অর্থে তো এটি সত্যি। অন্য দেশে ডেরা খুঁজে ফেরা নয়, নিজের জায়গা থেকে দূরে সরে যাওয়া, প্রস্থান করা। এই ঢাকা শহর এবং কবিতামগ্ন সময় থেকে নিজেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া। ১৯৭৮ সালে দেশত্যাগের সময় তিনি ছিলেন যৌবনের চূড়োয়, মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সী। ওই বছরই তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ প্রকাশিত হয়। প্রথমে যান বার্লিনে। সেখান থেকে চলে যান লন্ডনে। তারপর ফেরেন বস্টনে। কোথাও সেভাবে থিতু হননি। শেষমেশ আমেরিকারই আরেকটি রাজ্য নিউইয়র্কে বসবাস শুরু করেন। এতগুলো বছর তাঁর ফেরা হয়নি নিজ দেশে। না, ভুল হলো, আশির দশকে একবার অল্প কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিলেন। তারপর আর নয়। অবশ্য পরে তিনি শারীরিকভাবে অনেকটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস করতে হতো, হুইল চেয়ারের বন্দিত্বে থাকতে হতো। সে যাই হোক, আমেরিকায় শারীরিকভাবে গোটা জীবন কাটালেও তাঁর মনটা পড়ে ছিল এই দেশেই। আর কবিতা থেকে দূরেও থাকতে পারেননি তিনি। বহু বছর কবিতা লেখেননি- এটা সত্য। তবে বাংলাদেশের কবিতার বই খুঁজে পেতে পড়তেন। সেখানে যেমন বাঙালী কবি ও কবিযশোপ্রার্থীদের লেখা পড়তেন, তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। তেমনি বাংলাদেশ থেকে কোনো কবি গেলে তাঁর সঙ্গেও দীর্ঘ সময় কাটাতেন। আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতেন বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি। একই সঙ্গে নিজের দেশের খবর জানতে চাইতেন। একটি ঘটনার কথা বলতে পারি এ মুহূর্তে। ১৯৯১ সালে তাঁর অনুজপ্রতিম কবি শিহাব সরকার গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে। এক গভীর রাতে রুমের দেয়ালে সাঁটা ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। তখন মোবাইল ফোনের ব্যাপক চল শুরু হয়নি খোদ আমেরিকাতেও। ফোনে ভারি, গমগমে কণ্ঠ, শিহাব ঘুমাইয়া পড়ছো? উত্তেজনায়, আনন্দে ফ্লোরে বসে পড়লেন শিহাব। শহীদ কাদরী তখন বস্টনের কাছে এক শহরে থাকেন। অনেকক্ষণ দু’জনার কথা হলো। এক সময় তিনি আকুলভাবে বলে উঠলেন, ‘আমি বড় ক্লান্ত। আর ভালো লাগে না। দেশে ফিরতে চাই।’ শিহাব বললেন, ‘তাহলে দেরি করছেন কেন? চলুন বাংলাদেশে। ঢাকা আপনাকে চায়।’ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন তিনি। তারপর, ‘নাহ, সম্ভব না। আমি এখানে বাঁধা। কবে মুক্তি পাবো জানি না।’ শহীদ কাদরী ঠিকই বুঝেছিলেন একজন কবির মাতৃভূমি থেকে দূরে অবস্থান করা একটি অভিশাপ, এ অনেকটা আত্মহত্যার মতোই। আত্মহত্যা বলতে, কবিসত্তার হনন। কিন্তু তিনি দৃঢ়চেতা ছিলেন বলেই প্রবাসে থিতু হয়েও শেষ পর্যন্ত আবার কবিতা লিখতে শুরু করেন। জীবনের গোধূলিবেলায় এসে তারুণ্যের কবিপ্রতিভার নবায়ন ঘটানো আর কোন কবির পক্ষে সম্ভবত সম্ভবপর হয়নি। প্রবাসে বসবাসকারী লেখকরা স্বদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। এক ধরনের পরোক্ষ সংযোগও থাকে। কিন্তু যুগের পর যুগ আক্ষরিক অর্থে নিজ দেশের মাটির গন্ধ নিচ্ছেন না, আলোবাতাস মাখছেন না এমন কবির পক্ষে পুনরায় কবিতার জগতে প্রত্যাবর্তন খুব সহজ নয়। অথচ শহীদ কাদরী পেরেছিলেন। বাউ-ুলেপনা, আড্ডাবাজ আর মশকরায় সেই পঞ্চাশের-ষাটের দশকে আর কোন কবি ছিল না তাঁর মতো। সুরাপানেও অদ্বিতীয়। তাঁর মতো প্রাণখোলা অট্টহাসিও আর কোনো কবিকে হাসতে দেখা যেত না। তাঁর সমকালীন ও কিছুটা অনুজ কবিদের স্মৃতিচারণায় শহীদ কাদরী সমীহ জাগানিয়া কবিতার এক রাজকুমার। মৃত্যু এসে অমরত্ব দিতে পারে ক’জন কবিকে? কবি শহীদ কাদরী তাঁর যৌবনের তিনখানা কাব্য দিয়েই আবহমান বাংলা কবিতার পাঠককে বিশুদ্ধ আধুনিক কবিতাসুধা পান করিয়ে যাবেন- একটি দশকে এমন কবির দেখা খুব বেশি মেলে না। শহীদ কাদরীর যেসব কথোপকথনের ভিডিও দেখেছি, অনলাইন ও কাগজে পড়েছি তাতে শেষ পঞ্চাশ ও গোটা ষাটের দশকে তাঁর মনন তৈরি প্রসঙ্গে ধারণা পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা ও ইউরোপের আধুনিক কবিতা যেমন তিনি নিবিষ্টচিত্তে পড়তেন, তেমনি পাঠ করতেন আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী। ফলে কিছুটা বয়োজ্যেষ্ঠ সতীর্থদের মধ্যে তাঁর ছিল বিশেষ কদর। আর প্রথম থেকেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি কাব্যভাষা ছিল তাঁর অধিকারে, যে স্বকীয় স্বর প্রতিষ্ঠার জন্য একজন কবির দীর্ঘকাল নিবিষ্ট থাকতে হয়। আধুনিক শাহরিক মানুষের দ্বান্দ্বিক জীবনবোধ এবং সেই সঙ্গে অনন্য শিল্পবোধ ছন্দের ছাঁচে স্বচ্ছন্দভাবে উৎসারিত হতো তাঁর কলমে। কোথায় যেন তাঁর ছিল বিষাদগ্রস্ততা এবং একইসঙ্গে অনিকেত ভাবনা। (তৃতীয় কাব্য ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’-এর একটি কবিতায় পাচ্ছি: একটি মাছের অবসান ঘটে চিকন বটিতে,/ রাত্রির উঠোনে তার আঁশ জ্যোৎস্নার মতো/ হেলায়-ফেলায় পড়ে থাকে/ কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না,) সব মিলিয়ে এগার বছরের সময়পরিধিতে (১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮) যে তিনটি কবিতাগ্রন্থ তিনি পাঠককে উপহার দেন সেগুলো সর্বকালের বাঙালী পাঠকের জন্যই যেন মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছিল। দুই. ঠিক দশ বছর আগের এমনই এক আগস্ট-দিন। বন্ধু শামসুর রাহমান প্রস্থান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুর কাজটি করলেন শহীদ কাদরী সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার থেকে। তাৎক্ষণিক যে-বার্তা দিলেন কবিতার নবীন পাঠকদের উদ্দেশে তা সমীহ জাগালো নিমেষে। লিখলেন: ‘আমি শামসুর রাহমানকে বাংলা ভাষায় তিরিশের দশকের পাঁচজনের অব্যবহিত পরেই সবচেয়ে বড় কবি মনে করি। সময় ও ইতিহাস তাঁকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁর গঠন ছিল সম্পূর্ণ বিশুদ্ধতাবাদী কবির। কিন্তু এই বিশুদ্ধতা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তার কারণ হলো যে ওই সময়ে আমাদের দেশে শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। কোনো সচেতন লেখকের পক্ষে তখন এর থেকে সরে থাকা সম্ভব ছিল না।...’ গভীর বেদনার, আজ শহীদ কাদরীর সমসাময়িক কবিবন্ধুদের ভেতর আছেন কেবল সৈয়দ শামসুল হক ও আল মাহমুদ। হায় একজন বিলেতের আরোগ্যশালায়, অন্যজন প্রায় দৃষ্টিহীন। কিছুটা অনুজপ্রতিম কবিদের ভেতর শহীদ কাদরীর কাছের জন ছিলেন সিকদার আমিনুল হক। সবার আগে তিনিই চলে গেছেন। সিকদার ভাইয়ের কাছে শহীদ কাদরীর কত গল্পই না আমরা শুনেছি, সেসব ইতিহাস! বয়সে বেশ ছোট, কবি ইকবাল হাসানও ছিলেন শহীদ কাদরীর প্রিয়পাত্র। তাঁর কাছ থেকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতাম কবির কাহিনী। আমেরিকায় শহীদ কাদরীর অনুরাগী ও অনুসরণকারীদের ভেতর আছেন কবি হাসানআল আবদুল্লাহ, আদনান সৈয়দসহ অনেকেই। শেষের দিকে কবি কাজী জহিরুল ইসলাম কবির সান্নিধ্যধন্য হন। চলে যাওয়ার দিন দশেক আগে নাকি তাঁকে কবি বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছি।’ তিন. মধ্যপঞ্চাশে কয়েকটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সদ্যকৈশোর-উত্তীর্ণ কবি শহীদ কাদরীর তোলপাড়- তোলা আত্মপ্রকাশ। একই সময়ে দুই অগ্রজ শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের সঙ্গেও তাঁর সুখ্যাত সখ্যের শুরু। কবিতায় আধুনিক নগর জীবনের রূপকার শামসুর রাহমানের প্রথম গ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ষাট সালে। অন্যদিকে শহীদ কাদরীর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ বেরোয় তার ঠিক সাত বছর পর। সেকালে এই দুই কবির কাব্যমানস ও কাব্যরসদ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার কারণেই হয়তো এই দু’জনকে অনেকে সমসাময়িক কবি বলে মনে করে থাকেন, আসলে উভয়ের বয়সের ব্যবধান ১৩ বছর। প্রকৃত অর্থে এঁরা দু’জন যথাক্রমে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের নতুনতম কবিতার উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি। যে কোনো কবির ক্ষেত্রে অভিষেক গ্রন্থটি, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, প্রবেশক কবিতাটি এক ধরনের ইশতেহার এবং কবিজন্ম-পরিচয়পত্র হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। সে-সূত্রে শামসুর রাহমানের ‘রূপালী স্নান’ কবিতাটি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল জীবনানন্দ-জগৎ থেকে একজন রোম্যান্টিক কবির জন্ম হলেও এতে রয়েছে শুদ্ধতাবাদের সঙ্গে সমকালীনতার একটি মনকাড়া মিশেল। দুটি চরণ পাঠ করা যাক : ‘...যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি/ প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবু শান্ত রূপালী স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।’ অন্যদিকে শহীদ কাদরীর ‘উত্তরাধিকার’ গ্রন্থের নাম কবিতাটি প্রবলভাবে ব্যক্তিত্বস্পৃষ্ট; এই কবি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং দেশভাগের তিক্ত বেদনার্ত উত্তরাধিকার বহন করছেন সেটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রকাশিত কবিতাটিতে। বাস্তুহীন বেঁচে থাকার নিষ্করুণ অভিঘাত ঘটে সূচনাকালেই। প্রথম স্তবকটি লক্ষ্য করুন : ‘জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমেÑ/ সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগ্ড়ে দিলো যেন/ দীপহীন ল্যাম্প্পোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে/ নিমজ্জিত সব কিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটে আঁধারে।’ এখন লক্ষণীয় হলো এই দুই শক্তিমান নাগরিক এবং আধুনিক কবিই নিজ অস্তিত্ব ও পারিপার্শ্ব সম্পর্কে অসন্তুষ্ট এবং কিছুটা বিপন্ন ও বিব্রত। তবে উভয় কবির প্রাথমিক কবিত্বশক্তির তুলনা করলে দেখবো একজনের ভেতর রয়েছে মিহি ভাবালুতা, অতিকথন এবং বাংলা কবিতা-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা; অন্যজন ঋজু, একচুল পরিমাণও বাড়তি শব্দ ব্যবহারে অসম্মত এবং পরিপূর্ণভাবে ভাবাবেগবর্জিত ও মননময়। পরবর্তীকালে আমরা পাশাপাশি সন্তোষ ও অপ্রাপ্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ করবো যে এই দুই শক্তিমানের একজন ক্রমশ নিজেকে বদলে ফেলে-ফেলে জনতার কবি হয়ে উঠছেন এবং হৃদয়ের সঙ্গে রাজপথকে জড়িয়ে নিয়েছেন। ক্রমান্বয়ে তিনি পরিণত হয়েছেন স্বদেশের ‘দায়িত্বশীল’ প্রধান কবিকণ্ঠে। অপরজন তৃতীয় কাব্যটি প্রকাশের অব্যবহিত পর বেছে নেন প্রবাসজীবন। কবিতাবিচার সংখ্যা দিয়ে হয় না এটা মানলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত ও রক্তস্নাত একটি নতুন দেশের বয়সী হয়ে ওঠা এবং তার জনমানুষের মনোজগতে পরিবর্তনের পর্যায়টিতে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি শহীদ কাদরীর শুভানুধ্যায়ীদের জন্যে সকরুণ হয়ে ওঠে। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে কবিতার পথে বুঝি আর কাদরীর পদচিহ্ন পড়বে না। যা হোক, কবি শহীদ কাদরীর চতুর্থ বা সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে, তাঁর দীর্ঘ নীরবতার পর। এতে ছত্রিশটি কবিতা মলাটবন্দী করে কবি তাঁর সপ্রেম সবিনয় নিবেদনের দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন শেষাবধি। শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যের প্রথম কবিতা ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’। কোনো কবির আত্মপ্রকাশ এবং আত্মস্বর প্রচার-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম কবিতাটি সব সময় বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এই কবিতায় পাই সম্পূর্ণত নগরের বৃষ্টি; এবং বৃষ্টি নিয়ে বাঙালীর কবিতাপনার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি। প্রথম পঙ্ক্তির প্রথম বাক্যটি আগেকার বর্ষাবাদনের সব সুর মুছে দেয় যেন- ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো।’ বর্ষার এসে পড়া প্রকাশ করতে গিয়ে ‘সন্ত্রাস’ শব্দের প্রয়োগ। একেবারে অভাবিত। এখানে বৃষ্টির জল জীবন্ত এক অস্তিত্ব যেন (কেবল করুণ ক’টা / বিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলে/ বয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতো/ নর্দমার ফোয়ারার দিকে,-)। এই কবিতা নিয়ে যতো বিশ্লেষণ পড়েছি সেগুলোর ভেতর আমেরিকায় বসবাসকারী কবি ওমর কায়সারের অভিমত বিশেষ লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, ‘এই বৃষ্টির বিবরণ কোন নারী, প্রকৃতি, প্রেমিকের বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের অভিষেক নয়; নয় আবেগ, যে ‘কেঁদেও পাবে না তাকে’ বর্ষায়। এটি কেয়া-কেতকী তমাল-তরী-ধান দোলানো মিষ্টি বৃষ্টি নয়- এটি শহরের অলি-গলি-দালান, রাস্তা, সাইনবোর্ড অফিস-আদালত, যান, ব্যবসা, মহাজন-সাহেব, পৌর সমিতিকে তাড়িত করা বিহ্বল বর্ষা : ‘অবিরল করাত কলের চাকা, লক্ষ লেদ মেশিনের আর্ত অফুরন্ত আবর্তন- বিপন্ন বিদ্যুত মেঘ, জল, হাওয়া- ময়ূরের মতো যার বর্ণালী চিৎকার, জল, জল, জল, তীব্র হিংস্র খল।’ এই পৃথক সুর এবং ক্ষিপ্র বেগ কাদরী তাঁর নিজস্ব অক্ষর-বৃত্ত চালে ঝরিয়েছেন, যা বাংলা-পদ্যে-ধারাবাহিত ঝংকৃত ৮/৬ চাল নয় আবার জীবনানন্দের বিলম্বিত সুরও নয়। প্রথমেই ৮ মাত্রার শোঁ শোঁ : ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো’, তারপর যতি নিয়ে ১২ অথবা ২০ মাত্রার দৌড়। এই আনোখা বাঁটের চলনে কবিতার শ্রুতিকল্প বক্তব্যটিকেও স্বতন্ত্র ওজন দিয়েছে। বৃষ্টিতে নাগরিক উপাদান সব ভেসে যাচ্ছে।’ এই কবিতাটিকে শহীদ কাদরী স্বয়ং কতটা গুরুত্ব দিতেন তা ওমর শামসেরই রেফারেন্স থেকে জানতে পারি। ২০০৫ এর দিকে, তাঁর এ কবিতা প্রসঙ্গে তিনি একদিন ফোনে বলেছিলেন, ‘এই হচ্ছে আমার ওয়েস্ট ল্যান্ড।’ টি এস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড যাঁরা পড়েছেন তাঁরা শহীদ কাদরীর বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝবেন। চার. সুদীর্ঘ নীরবতার পর সপ্রতিভ ও স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল কবি শহীদ কাদরীর নতুন কবিতার বই স্বাভাবিকভাবেই কবিতাপ্রেমীদের আগ্রহের কারণ হয়েছিল। ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ গ্রন্থে কবির কণ্ঠে মূল যে-স্বরটি প্রকাশিত তার পর্যালোচনায় গেলে আমরা বুঝবো যে প্রবাসযাপনে বিপর্যস্ত এক প্রাজ্ঞ প্রবীণ তাঁর প্রিয়তমা মাতৃভূমির সুখস্মৃতিমগ্ন, যদিও তার ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে একইসঙ্গে গভীর অভিমান এবং প্রত্যাবর্তনের তৃষ্ণা। তবে সকল কিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে স্বদেশভূমির জন্যে যুগপৎ শঙ্কা ও কল্যাণভাবনাই। ‘ভ্রাতৃরক্তে সিক্ত মাতৃভূমি’- চরণধ্বনি প্রতিধ্বনিত তাঁর বেশ কিছু কবিতায়। বাঙালিত্ব নিয়ে তিনি গর্বিত ও সুখী হলেও বাঙালীর নিষ্ঠুরতা তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে বিমূঢ় কবির উচ্চারণ : তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম, বুট, সৈনিকদের টুপি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল, তারা ব্যবহার করেছিল এক্কেবারে খাঁটি বাঙালীর মতো, বাঙলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো দেখতে, এবং ওরা মানুষই, ওরা বাঙলার মানুষ... (হন্তারকদের প্রতি, পৃ. ২২) অন্তরে স্বদেশ চিরজাগরুক না থাকলে কবিতা কেন, কোন শিল্পকর্মই সৃজন করা সম্ভবপর নয়। আমরা ভুলে যাচ্ছি না যে, ধর্মভেদনীতির ফলশ্রুতিতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া এক দেশ থেকে অন্য দেশে কিছুটা বিলম্বে হলেও শেষ পর্যন্ত আসতে বাধ্য হন শহীদ কাদরীর পিতা। বালক কাদরীর হৃদয়ে যা গেঁথে দেয় অচিকিৎস্য গভীর ক্ষত। বহু বছর পরেও দীর্ঘ পরবাসজীবনের অন্তিমে তাঁর স্বগৃহে ফেরার কালে একই ক্ষত জীবন্ত হয়ে ওঠে। সৎ কবি বলেই তিনি এই গভীর সত্যটিকে আড়াল করেন না; বলেন, ‘যতবার আমি ঘরের নিকটবর্তী হই/ কুয়াশা আক্রান্ত সেই বারান্দায় রয়েছে দাঁড়ানো আজো/ একটি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিÑ একদা কৈশোরে/ যে আমাকে জানিয়েছিল বিদায়, সেই ছায়ামূর্তি/ আজো, এখনো, আমাকে লক্ষ্য ক’রে উড়িয়ে চলেছে একটি বিদায়ী রুমাল।’ তবু নিজের মাতৃভূমি তাঁর কাছে প্রিয়তমাতুল্যÑ বিব্রত ও রোরুদ্যমান সেই প্রিয়তমার উদ্দেশেই তিনি তাঁর ‘সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে’ পৌঁছে দিতে চান। তিনি জানেন পরবাসযাপন কত যন্ত্রণাদগ্ধ হতে পারে। বিজন বিভূঁইয়ের জীবন হয়ে ওঠে ‘বিব্রত’ ও ‘নতজানু’। ‘দেখতে শুনতে হুবহু বাঙালী কৈ ও মাগুর মাছের মতো কালো’ হলেও বর্ণবাদী দেশে কাকও মার্কিন নাগরিক বটে! বাংলা শব্দের জন্যে এমন সপ্রেম আর্তি শহীদ কাদরীতে আমরা আগে এত তীব্রভাবে পেয়েছি কি? ‘মার্কিনী ভাষায় কিচিরমিচির করা’ চড়ুইকে বাংলা বুলি শেখানোর জন্য তিনি ছটফট করে ওঠেন; একই কবিতার উপসংহারে তাঁর উচ্চারণ আর্তনাদের মতো শোনায় : কাউকে বিশ্বাস নেই আর এই বিরূপ বিদেশে। তবু বলি: যদি পারো, হে নন্দিত মেঘ তুমি নেমে এসো শ্রাবণে শ্রাবণে তুমি, হে বন্ধু স্পন্দিত করে দাও এই অফুরান পরবাস। (প্রবাসের পঙক্তিমালা, পৃ. ৪৬) স্বাভাবিক ও সমীচীনই মনে হয় যখন কবি ঘুরে ঘুরে কবিতায় কথা বলেন দেশত্যাগের কারণ সম্বন্ধে, কৌশলে প্রকাশ করেন বন্ধুদের প্রতি তাঁর পুঞ্জীভূত তীব্র অভিমান। ‘স্বগতোক্তি’, ‘তাই এই দীর্ঘ পরবাস’, ‘স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে একদিন’- এই তিনটি কবিতায় তার মাত্রা পায় চূড়ান্ত রূপ। তবু শেষ পর্যন্ত কবি-আত্মা দৃঢ়ভাবে জানায়- ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর’। নির্বাসন যে কত মর্মস্পর্শী ও ভয়াবহ হতে পারে তার প্রকৃত স্বরূপ কবি ছাড়া আর কে চেনাতে পারে! তার বিবরণ হয়ে উঠেছে স্বদেশপ্রেমী ও স্বদেশমুখী সমস্ত বাঙালী সত্তার নিবিড়তম উপলব্ধি। কী সাংকেতিক ও সাঙ্গীতিকই না এইসব উচ্চারণ : ‘জুঁই, চামেলি, চন্দ্রমল্লিকা কিংবা কাঠগোলাপ থেকে/ টিউলিপ ম্যাগনোলিয়া অথবা ক্রিসেনথিমামে/ নিজস্ব শহর থেকে অচেনা ফুটপাথে/ এশিয়ার আকাশে ময়ূর নীল থেকে/ কুয়াশাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যে/ না, কোনো নির্বাসনই/ কাম্য নয়/ আর।’ (কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর, পৃ. ৩৭) শহীদ কাদরীর পূর্বের তিনটি গ্রন্থকে (উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা এবং কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই) পাশে রেখে যদি পড়ি ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ তবে এই বইটিতে কোমলগন্ধি লিরিকের সন্ধান পাবো। অক্ষরবৃত্তের শক্তি আমরা দেখেছি কাদরীতে। এমনকি অন্তমিল ও অন্তরমিলের জাদুও। চিত্রকল্পের চমৎকারিত্ব-ভরা তাঁর কবিত্বে মোহিত হয়েছি আমরা বহুবার। এই কবিতাগুলোয় প্রবলভাবে তার দেখা না মিললেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সেই অভিন্ন পরাক্রম কবির কলম থেকেই নিঃসৃত হয়েছে এইসব বুদ্ধিদীপ্ত সুসম্পাদিত পঙ্ক্তিমালা। মিলের মিষ্টতা ও চিত্তাকর্ষক চিত্রকল্প মেলে তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে। আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম- সাত সাগরের ক্ষুব্ধ তরঙ্গে আছড়ে পড়া হারিয়ে যাওয়া বাংলা কবিতার রাজপুত্র অন্তহীন নক্ষত্রবিহীন যাত্রা শেষে আবার ফিরে এসেছেন আপন মাতৃক্রোড়ে, নিজস্ব ঠিকানায়- কবিতায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর কলম থেমে গেল! এইবার তাঁর বাড়ি ফেরার সময় হলো, আমাদেরও হলো ফুরসৎ তাঁর জন্য ভাবার, অশ্রুর সিক্ততায় তাঁকে ভালোবাসার! তিনি ফিরছেন নিজবাসভূমে। তাঁর উজ্জ্বল পঙক্তিমালা বাঙালী পাঠকের হৃদয়ে চিরআসন পেয়েছে সে তো ঢের আগেই। এবার অমরত্বের দিকে তাঁর যাত্রা। ৩০ আগস্ট ২০১৬ [email protected]
×