ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

‘সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ চাই না, জঙ্গীবাদমুক্ত দেশ চাই’

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ চাই না, জঙ্গীবাদমুক্ত দেশ চাই’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে এবার মাঠে নেমেছেন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ‘আমরা সন্ত্রাস চাই না, জঙ্গীবাদ চাই না। জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ চাই’- এই দাবি নিয়ে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আহ্বানে বৃহস্পতিবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীবাদবিরোধী মানববন্ধন করেছেন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন হলেও মূল কর্মসূচী ছিল রাজধানী কেন্দ্রিক। কর্মসূচী থেকে জঙ্গীবাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের দাবি তোলা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসা জঙ্গী প্রজনন কেন্দ্র নয়, জঙ্গী নির্মূল কেন্দ্র- এমন স্লোগান তুলে বলা হয়েছে, ইসলামের নাম দিয়ে কিছু মানুষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে। এরা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট। মুসলমানদের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। গুলশানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলার প্রেক্ষাপটে দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসার পক্ষ থেকে জঙ্গীবিরোধী কর্মসূচী চলছে। কর্মসূচী পালন করেছে হেফাজত নেতাদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসার বাইরের অন্যান্য মাদ্রাসার পক্ষ থেকেও। জঙ্গীবিরোধী কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন সুন্নী সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী ছাত্রসেনাসহ বিভিন্ন ইসলামী দল কর্মসূচী পালন করলেও অভিযোগ ওঠে হেফাজত নিয়ন্ত্রিত কওমী মাদ্রাসার নীরবতা নিয়ে। ইসলামী নেতারা গত সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন করে জঙ্গীদের বিষয়ে হেফাজত নেতাদের নীরবতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তবে বৃহস্পতিবার কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নেমেছে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বৃহৎ একটি অংশ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর কওমী মাদ্রাসাসমূহের উদ্যোগে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়। রাজধানীর সায়েদাবাদ, লালবাগ, মৎস্য ভবন, রামপুরা নতুনবাজার, বারিধারা, টঙ্গী এলাকার বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। তাদের হাতে ‘হটাও সন্ত্রাস বাঁচাও দেশ, উলামায়ে কিরামের নির্দেশ’, ‘সন্ত্রাস নয় শান্তি চাই, মাতৃভূমিকে বাঁচাতে চাই’, ‘দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই, সন্ত্রাসবাদ জঙ্গীবাদ, ধ্বংস হোক নিপাত যাকসহ বিভিন্ন সেøাগান লেখা প্লাকার্ড দেখা যায়। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছিল মূল কর্মসূচী। যেখান থেকে জঙ্গীবাদের মদদদাতা এবং এসব কর্মকা-ে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। কওমী নেতারা বলেন, আজকের মানববন্ধন প্রমাণ করে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সব ধরনের জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ কর্মকা-কে ঘৃণা করে। দেশের কওমী মাদ্রাসাকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। হেফাজতের ঢাকা মহনগরের আমির ও কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) সহ-সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী বলেছেন, ইসলাম ও ওলামায়ে-ইকরামের সঙ্গে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের কোন সম্পর্ক নেই। দেশের শান্তির জন্য ওলামা-মাশায়েখ তাদের জীবন উৎসর্গ করবেন। ইসলামী শিক্ষা শান্তির শিক্ষা, এখানে সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি আরও বলেন, ইসলামের নাম দিয়ে কিছু মানুষ সন্ত্রাসী কর্মকা- করছে। এরা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট। মুসলমানদের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ। শান্তি-সম্প্রতির দেশে নিরাপত্তা বিঘিœত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সরকারী দল, বিরোধী দল ও সর্বস্তরের জনগণকে এক কাতারে দেখতে চাই, যাতে দেশ থেকে সন্ত্রাস সমূলে ধ্বংস করা যায়। এই হেফাজত নেতার দাবি, সত্যিকারের সন্ত্রাস দমন করতে চাইলে দরকার পবিত্র কোরান সুন্নাহর শিক্ষা। পবিত্র কোরান সুন্নাহর শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা পরিশুদ্ধ হয় না। ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলে নিঃসন্দেহে সন্ত্রাস দূর হবে। আদর্শ নাগরিক তৈরি হবে। মাদকাসক্তমুক্ত সমাজ তৈরি হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ হবে। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ করে, তারা চরিত্রহীন। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। যারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- করে, তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে। মানববন্ধনে আরও বক্তব্যে দেন বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি শায়খুল হাদিস আশরাফ আলী, মহাসচিব আবদুল জব্বার জাহানাবাদী, জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহফুজুল হক প্রমুখ। এছাড়া ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন মাদ্রাসার পরিচালকরাও মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন। এদিকে রাজধানীর বাইরে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেন তারা। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে রেডিও কলোনি পর্যন্ত কওমী মাদ্রাসার প্রায় কয়েক হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হাতে হাত ধরে এ মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেন। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মানববন্ধনে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অংশ নেন। ছিলেন সাভার পৌর মেয়র হাজী আব্দুল গণি, সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু নাসের বেগ, সাভার ব্যাংক কলোনি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল্লাহ, আব্দুল মান্নান, আলী আকবরসহ আরও অনেকে। মানববন্ধনে তারা জঙ্গী দমনে বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান। ফেস্টুন ও বুকে জঙ্গীবিরোধী সেøাগান লিখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করেছে কিশোরগঞ্জ জেলার কওমী মাদ্রাসাগুলোর কয়েক হাজার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। আমরা সন্ত্রাস চাই না, জঙ্গীবাদ চাই না। জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ চাই। কওমী মাদ্রাসা জঙ্গী প্রজনন কেন্দ্র নয়, জঙ্গী নির্মূল কেন্দ্র। এমন সব সেøাগান ছিল শিক্ষার্থীদের মুখে। শহরের ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের সামনে থেকে শুরু করে পশ্চিমে কাচারীবাজার, পূর্বদিকে চামটা রোডের তারাপাশা নুরানি মাদ্রাসা পর্যন্ত দীর্ঘ তিন কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এ মানববন্ধনে অংশ নেন। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বেফাকের সহসভাপতি ও আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক শহীদী মসজিদের খতিব মাওলানা আজাহার আলী আনোয়ার শাহ। তিনি বলেন, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। এ ধর্ম বিশৃঙ্খলা ও জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ইসলামের নামে কিছু লোককে ব্রেন ওয়াশ করে বিপথগামী করা হচ্ছে। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন জামিয়ার শাইখুল হাদিস মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী, মাওলানা শামসুল ইসলাম, মাওলানা শোয়াইব বিন আবদুর রউফ, জামিয়া নুরানিয়া তারাপাশা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল বাশার, শিক্ষাসচিব মাওলানা মোখলেছুর রহমান প্রমুখ। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে মাগুরা জেলার সকল কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা। শহরের ভায়না মোড় থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি সড়কে এ মানববন্ধন হয়। বক্তব্য রাখেন কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড মাগুরা জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা আমজাদ হুসাইন, সহসভাপতি মাওলানা শাহ সাইফুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক কাজী জাবের বীন মুহসিন তাজাল্লা। সাতক্ষীরায় সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। জেলা প্রেসক্লাবের সামনে ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচী পালিত হয়। পাটকেলঘাটা সিদ্দিকিয়া কওমী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মনিরুল হকের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা সহ-সভাপতি মুফতি রবিউল ইসলাম, ধুলিহর কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি সাদেকুল ইসলাম, দারুল উলুম ইটাগাছা মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি সাইফুল্লাহ রহমান, বদ্দীপুর কলোনি কওমী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি সাইফুল্লাহ প্রমুখ। বক্তারা এ সময় জঙ্গী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করে বলেন, আমাদের যার যার অবস্থান থেকে জঙ্গী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ময়মনসিংহ মহানগর কওমী মাদ্রাসা পরিষদের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর মাসকান্দা এলাকা থেকে ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড ও টাউন হল মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ মানববন্ধন কর্মসূচী চলে। ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেনÑ মাওলানা আব্দুর রহমান হাফেজ্জি, আব্দুল হক, মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ সাদী, মুফতী মুহিবুল্লাহ, মাওলানা মঞ্জুরুল হক, মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা আশরাফ আলী, মুফতি জাকির হুসাইন, মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব, মাওলানা শরীফুর রহমান প্রমুখ। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবিরোধী সভার নির্দেশ ॥ আগামীকাল দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী সভা আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোঃ আখতার-উজ-জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সভায় জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিতভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-ক্রীড়ানুষ্ঠান আয়োজন, স্কাউটিং ও গার্ল গাইডস কার্যক্রম বৃদ্ধি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরির বিষয়েও আলোকপাত করতে হবে। সভায় সব শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজের বিশিষ্ট উদ্যোগী ব্যক্তি, ইমাম, শিক্ষার্থী এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ইউজিসি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
×