ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননা

বিভক্ত মতামতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বিভক্ত মতামতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতি এবং বিচারাধীন বিষয়ে বিরূপ মন্তব্যের মাধ্যমে আদালত অবমাননার দায়ে দুই মন্ত্রীকে করা জরিমানার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। গত ২৭ মার্চ খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। বৃহস্পতিবার ৫৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সর্বোচ্চ আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতিরা বিভক্ত মতামত দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে হওয়া এ রায় লিখেছেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এর মধ্যে বিচারপতি ইমান আলীর সঙ্গে অপর চার বিচারপতি একমত পোষণ করেছেন। অন্যদিকে ভিন্নমত দিয়েছেন তিন বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার রায়ের বিষয়ে বিচারপতি ইমান আলীর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তারা পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মন্ত্রীদ্বয় শপথ ভঙ্গ করেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তারা (দুই মন্ত্রী) বিচার বিভাগের মর্যাদাকে খাটো করেছেন। তারা রায়ের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে সুপ্রীমকোর্ট নিয়ে কুৎসা রটনা করেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক। তারা বলেছেন, শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা, তা মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়। জরিমানার শাস্তির বিষয়ে একমত হলেও দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেননি। বিচারপতি সিদ্দিকী তার রায়ে বলেছেন, ‘আমি আমার ভাই মোহাম্মদ ইমান আলীর রায় পড়েছি। অবমাননাকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাদের দেয়া দ-ের বিষয়ে দ্বিমত পোষণের কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। তবে অবমাননাকারীদের শপথ লঙ্ঘন বিষয়ক অংশের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করতে পারছি না।’ তারা আরও বলেছেন, তাদের (দুই মন্ত্রী) শপথ ভঙ্গ করার বিষয়টি এ আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল না। শপথ ভঙ্গের বিষয়টি তাদের নজরেও (নোটিসে) আনা হয়নি। যারা এখন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় রয়েছেন- সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে তারা আদালত অবমাননা করেছেন কি করেননি, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। এদিকে রায় প্রকাশিত হওয়ার পর আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমি রায়টি পেয়েছি। এখন পড়ছি। পড়ে পরে এ বিষয়ে জানাব। সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, সংবিধানে বলা আছে- নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হন, তা হলে তাদের মেম্বারশিপ যাবে। প্রশ্ন হলো কনটেম্পট টু কোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। শপথ ভঙ্গ নিয়ে তিন বিচারপতি ভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তাদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন কোন ডাইরেকশনও নেই তাদের মন্ত্রিত্ব চলে যাবে। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। নিশ্চয়ই তারা মন্ত্রিত্ব চালিয়ে যেতে পারবেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়েছে, এতে মন্ত্রীর পশথ ভঙ্গ হয়েছে। সংবিধানে এমন কিছু নেই তাদের মন্ত্রিত্ব যাবে। আদালতও এমন কিছু বলেনি। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমাযুন বলেছেন, আমি রায়টি দেখিনি। না দেখে কিভাবে বলব। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও এ মামলার আইনজীবী এ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেছেন, রায়ের অপারেটিং পার্টে আছে উনারা আদালত অবমাননা করেছেন সেজন্য ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে কিছু থাকতেই পারে। গত ২৭ মার্চ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপীল বিভাগের ৮ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সাত দিনের কারাদ-ের রায় দেন। রায়ে আদালত জানায়, মন্তব্যের মাধ্যমে আদালত অবমাননা করেছেন দুই মন্ত্রী। তাদের সাত দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও কিডনি ফাউন্ডেশনকে দিতে বলা হয়। পরে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন তারা। গত ৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে মীর কাশেম আলীর আপীল মামলার আপীল শুনানি পুনরায় করার দাবি জানান খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। এ বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশের পর গত ৮ মার্চ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে তলব করেন পূর্ণাঙ্গ আপীল বেঞ্চ। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে নোটিস জারি করে। সরকারের এই দুই মন্ত্রীকে ১৫ মার্চ সকাল ৯টায় সর্বোচ্চ আদালতে হাজির হয়ে তাদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। অন্যদিকে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয় ১৪ মার্চের মধ্যে। নোটিসে কেন তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না, তা দুই মন্ত্রীর কাছে জানতে চায় আপীল বিভাগ। দুই মন্ত্রীর পক্ষে গত ১৪ মার্চ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় নোটিসের জবাব দাখিল করা হয়। আদালতের তলবে ১৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক হাজিরা দেন। তবে বিদেশে থাকায় সেদিন হাজিরা দিতে পারেননি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তার সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে ২০ মার্চ ফের দুই মন্ত্রীকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ আপীল বেঞ্চ। পরে ২০ মার্চ সকালে হাজির হন দুই মন্ত্রী। ওই দিন আপীল বিভাগ খাদ্যমন্ত্রীর নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন এবং ২৭ মার্চ দুই মন্ত্রীকে ফের হাজিরের নির্দেশ দেন। এ কারণে গত ২৪ মার্চ নতুন করে আবারও নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন জানান খাদ্যমন্ত্রী। ২৭ মার্চ সকাল পৌনে ৯টার দিকে তাদের মন্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা ও শোকজ নোটিসের জবাব দিতে সুপ্রীমকোর্টে ফের হাজির হন দুই মন্ত্রী। তারা দু’জনই নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান। কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আবদুল বাসেত মজুমদার। মোজাম্মেল হকের ক্ষমা চেয়ে করা আবেদনটি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। আদালতের নির্দেশে দুই মন্ত্রীর করা মন্তব্য পড়ে শোনান এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানি শেষে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে করা দুই মন্ত্রীর আবেদন নামঞ্জুর করে রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
×