ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রামেন্দু মজুমদার

সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ আজ কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশ এই সন্ত্রাসবাদের মর্মান্তিক শিকারে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু উগ্রবাদী দল এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করছে, আবার এমন দৃষ্টান্তও আছে যে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালান হয়েছে। ডবধঢ়ড়হং ড়ভ সধংং ফবংঃৎঁপঃরড়হ ধ্বংস করার অজুহাতে ইরাকের মতো প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমিকে কিভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, সে স্মৃতি এখনও পুরনো হয়নি। এখন সিরিয়াতে চলছে চরম মানবিক বিপর্যয়। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সন্ত্রাসবাদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চারটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। প্রথমটি সন্ত্রাসের হুমকি অথবা সন্ত্রাসী তৎপরতা। দ্বিতীয়ত, তারপর রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। তৃতীয়ত, সাধারণত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। চতুর্থত, এ ধরনের কর্মকা-ে কোন সন্ত্রাসী দেশের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। সবই বোধহয় তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত। সন্ত্রাসী কর্মকা- কেন করা হয়? প্রধান কারণ হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা তাদের মতবাদ বিশ্বে জানান দিতে চায়। অন্যের ওপর জোর করে তা চাপিয়ে দিতে চায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, কোন কালে কোন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, জনগণ সন্ত্রাসীদের মতবাদ গ্রহণ করেনি। আজকাল গণমাধ্যম সন্ত্রাসীদের মতবাদ প্রচারের এক বিশাল সুযোগ করে দিয়েছে। কোথাও কোন সন্ত্রাসী হামলা হলে সন্ত্রাসীরা তার দায় স্বীকার করে এবং এর মাধ্যমে তাদের দাবি উচ্চকিত হয়। অনেক সময় তারা জড়িত না থাকলেও দায় স্বীকার করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে চায়। বাংলাদেশে জঙ্গী হামলায় কেউ নিহত হওয়ার পর পর যেমনটি কোন কোন জঙ্গীগোষ্ঠী বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। সৌদি বংশোদ্ভূত ওসামা বিন লাদেন তার আল কায়েদা সৃষ্টি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথাকথিত ইসলামী জিহাদের নামে যে তা-ব চালিয়েছিল, তা আরও অনেক জঙ্গীগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ওপর ভয়াবহ হামলা চালাবার পরও দশ বছর ওসামা বিন লাদেন তার গোপন আস্তানায় থেকে মাঝে মাঝেই ভিডিওর মাধ্যমে ‘ফতোয়া’ জারি করে বিশ্বব্যাপী তরুণদের এই ‘জিহাদে’ শামিল হওয়ার আহ্বান জানাতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নৌসেনারা লাদেনকে তার গোপন আস্তানায় হত্যা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু জঙ্গীবাদের অবসান হয় না। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই যে কোন ব্যক্তি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়; সব সময়ে তা কিন্তু যথেষ্ট কারণ নয়। সে যখন বিশ্বাস করে যে সহিংসতার মাধ্যমেই কেবল তার দৃষ্টিতে সমাজের যেসব অন্যায় আছে, তার অবসান ঘটানো যাবে তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সহিংস কাজের মধ্য দিয়ে একটা পরিবর্তন আনা সম্ভব। সন্ত্রাসবাদের হোতারা অনুসারীদের এই বলে উজ্জীবিত করে যে, তাদের সহিংস কাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া হবে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় অনেকদূর এগিয়ে যাবে। যারা সহিংস কাজে লিপ্ত হয় তাদের মগজধোলাই এমনই হয় যে, তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে ১৯৪৫ সালের ১৬ নবেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেস্কোর যে গঠনতন্ত্র গৃহীত হলো তার প্রস্তাবনার দিকে একবার আমরা ফিরে তাকাতে চাই : ÔSince wars begin in the minds of men, it is in the minds of men that the defences of peace must be constructed; ignorance of each otherÕs ways and lives has been a common cause, throughout the history of mankind, of that suspicion and mistrust between the peoples of the world through which their differences have all too often broken into war; the great and terrible war which has nwo ended was a war made possible by the denial of the democratic principles of the dignity, equality and mutual respect of men, and by the propagation, in their place, through ignorance and prejudice, of the doctrine of the inequality of men and races; the wide diffusion of culture, and the education of humanity for justice and liberty and peace are indispensable to the dignity of man and constitute a sacred duty which all the nations must fulfill in a spirit of mutual assistance and concern;.... সুতরাং আমরা দেখতে পাই, দৃশ্যমান যুদ্ধের অনুপস্থিতিই কিন্তু শান্তি নয়। মানুষের মনোজগতে যা ঘটছে- হিংসা, বিদ্বেষ, কলহ, ভিন্ন ধর্ম, জাতি বা রাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানার প্রবণতা- সবকিছুই অবদমন করা সম্ভব যদি মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনা যায়। আজকের বাংলাদেশ ভূখ-ে জঙ্গীবাদ এসেছে সাম্প্রদায়িকতার হাত ধরে। ইংরেজ আমলে এদেশে সাম্প্রদায়িকতা তেমন ছিল না এবং তা বিকাশের সুযোগ পায়নি। কারণ তখন সমাজে সাম্প্রদায়িক সংহতি অত্যন্ত প্রবল ছিল। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করে। কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্য এই যে, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িকতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান, বাঙালী- আদিবাসী নৃগোষ্ঠী সকলের মিলিত রক্তস্র্রোতে ১৯৭১-এ যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার চার মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা; চেতনাগতভাবে যা অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয়- এ কথাটা আমরা সে সময়ে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে সক্ষম হইনি। হয়ত সেক্যুলারিজমের বাংলা ধর্মনিরপেক্ষতা করা ঠিক হয়নি। ধর্ম সকলের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান প্রণেতারা যা চেয়েছিলেন, তা হচ্ছে ধর্মীয় আচরণ হবে মানুষের ব্যক্তিগত। রাষ্ট্র কোন ধর্মের প্রাধান্য দেবে না বা পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। ধর্মকে রাষ্ট্র বা রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে হবে। আমরা ভেবেছিলাম সাম্প্রদায়িকতাকে চিরদিনের মতো কবর দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তা ছিল সাময়িক। পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনীর বন্দুকের সামনে ধর্মের কোন বাচবিচার ছিল না। বাঙালী মাত্রই তাদের শত্রু। অবশ্য হিন্দু হলে তার অপরাধ ছিল দ্বিগুণ। শেষ পর্যন্ত ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানীরা ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরই হত্যা করেছে বেশি। ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর যখন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হলো তখন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ধর্মকে রাজনীতিতে অপব্যবহার করা হলো। সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে তার হিংস্র্র থাবা বিস্তার করল। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও এক সময়ে সরকারের মদদে জঙ্গীবাদ বাংলাদেশে বিকাশ লাভ করল। আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদী শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। দীর্ঘদিন ধরে পত্রপত্রিকায় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলে মাদ্রাসার আড়ালে জঙ্গী প্রশিক্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ভোট নষ্ট হওয়ার ভয়ে অতীতের কোন সরকারই জঙ্গী নির্মূলে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অথচ তখন যদি এখনকার মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হতো, তাহলে জঙ্গী তৎপরতা এত বৃদ্ধি পেত না। একটা কথা আমাদের সকলকে স্বীকার করতে হবে যে, কেবল অস্ত্র দিয়ে আজকের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিহত করা যাবে না। সকল সামাজিক শক্তির মিলিত উদ্যোগে মানবিক চেতনা জাগরিত করেই কেবল এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আজ যেটা সবচেয়ে জরুরী তা হচ্ছে একে অন্যকে বোঝা, সংলাপে প্রবৃত্ত হওয়া, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। কল্পিত শত্রুর পেছনে ধাওয়া না করে অন্য ধর্ম, অন্য সংস্কৃতির মানুষকে জানার চেষ্টা করতে হবে। তার জন্যই প্রয়োজন আন্তঃসংস্কৃতি, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে ১৯৯৬ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রখ্যাত সিরীয় নাট্যকার সাদাল্লা ওয়াননুস তাঁর বিশ্বনাট্য দিবস বাণীতে বলেছিলেন : ‘... সমাজের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মধ্যেও বহুস্তরা, বহুমুখী ও সার্বিক সংলাপের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এসব সংলাপের পূর্বশর্ত নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র, বহুবাদিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান আগ্রাসী তাগিদ নিয়ন্ত্রণ।... পরিহাসের দিক হচ্ছে যে, জ্ঞান ও তথ্যের বিপুল সম্পদ এবং বিপণন ও যোগাযোগের লভ্য ক্ষমতা যা দুনিয়াকে পরিবর্তিত করে বস্তুত বৈশ্বিকভাবে একটি গ্রাম করে তুলেছে, সেসব সত্ত্বেও থিয়েটারের, সকল থিয়েটারের ইউটোপিয়া রয়ে গেছে একই রকম মায়াবী, ঠিক সেই স্বপ্নের মতো যখন নারী-পুরুষ সকলে অখ- বিশ্বে বাস করবে যেখানে পৃথিবীর সম্পদ সবাই সমভাবে ভাগ করে নেবে এবং অন্যায় ও আগ্রাসিতা মুক্ত হয়ে মানবিক জীবন উপভোগ করবে। অথচ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে যে বিশ্বায়ন রূপ লাভ করছে তা সেই স্বপ্নে দেখা ইউটোপিয়ার একেবারেই বিপরীত; কেননা দৃশ্যত এটা তৈরি করছে সম্পদ বণ্টনে আরও বেশি বৈষম্য এবং কদর্যভাবে ধনী ও নিদারুণ দরিদ্রের মধ্যে আরও ব্যাপক ফারাক। অধিকন্তু, এটা সমাজের সব রকম সংহতি নির্দয়ভাবে বিনষ্ট করছে। সমাজকে খ--বিখ- করে ব্যক্তিকে পরিণত করছে নিঃসঙ্গ ও বিষাদগ্রস্ত আত্মায়।...’ তিনি তাঁর বাণী শেষ করেছেন এই বলে যে, আমাদের ললাটলিখন হচ্ছে আশাবাদী হওয়া এবং আজ যা ঘটছে সেটাই যে কালপ্রবাহের সমাপ্তি নয় তা স্মরণ রাখা। মানবিক বোধ জাগরিত করার একটা বড় ক্ষেত্র হচ্ছে উচ্চশিক্ষা। উচ্চশিক্ষা কি কেবল মানুষকে জীবিকা অর্জনের পথ প্রদর্শন করে? উচ্চশিক্ষা কি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ বিশেষ দিকের শিক্ষা দিয়ে একজনকে কেবল কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করে? না, তা নয়। উচ্চশিক্ষা আগে মানুষ হবার শিক্ষা দেয়, মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধনে উদ্বুদ্ধ করে। উচ্চশিক্ষা মানুষকে সকল সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে যুক্তি দিয়ে সবকিছু বুঝতে সহায়তা করে। আজকের বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজন মানববিদ্যার চর্চা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শিক্ষার কেন্দ্র নয়, জ্ঞানচর্চাই হওয়া উচিত তার প্রধান লক্ষ্য। সভ্যতার সকল দিক নিয়ে আলোচনা হবে, সমাজের বৈচিত্র্যের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে হবে। আর পাঁচ বছর পর যখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্যাপন করব তখন আমরা এই ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির গৌরবজনক অতীতের দিকে দৃষ্টি ফেরাব। গত কয়েক দশকে আমাদের এই ভূখ-ে যত রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের তাতে একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই পরবর্তীকালে দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে, দেশ-বিদেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছে। এ প্রসঙ্গে ২৬ জুন ২০১৬ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক লেখায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যথার্থই উল্লেখ করেছেন: ‘...এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই তো বাংলাদেশের সমাজ উচ্চশিক্ষার পথে হেঁটেছে; এ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেছে, বেগবান করেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চিন্তা ও সক্রিয়তার প্রেক্ষাপটটি তৈরি করেছে। এখনও সারাদেশের সুস্থ চিন্তা বিকাশের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কেন্দ্র হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখনও প্রাথমিক শিক্ষকরা তাঁদের সম্মান রক্ষার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থন চান; পোশাক শ্রমিকরা ভাবেন, তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়ালে তাঁরা বেঁচে যাবেন। মিডিয়ার চোখ সারাক্ষণ মেলা থাকে বটতলা বা অপরাজেয় বাংলার দিকে।...’ তাই আজকের এই অন্ধকার দূর করার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন যোগ্য শিক্ষকের- যারা বিষয়গত জ্ঞানের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের মানবিক চেতনা বিকাশে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে আজ যে শত শত তরুণকে জঙ্গী হতে অনুপ্রাণিত করছে, তার বিরুদ্ধে শিক্ষক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। সেদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ধৃত এক জঙ্গী বলেছে তাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে গুলি করার চেয়ে চাপাতি দিয়ে আঘাত করলে সওয়াব বেশি, সামনে থেকে আঘাত করার চেয়ে পেছন থেকে আঘাতে সওয়াব আরও বেশি এবং এক কোপে শিরñেদ করতে পারলে তো কথাই নেই। বেহেশ্ত হত্যাকারীর জন্যে নিশ্চিত। পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম আছে যা মানুষ হত্যাকে অনুমোদন দেয়? আমাদের দেশে বিভিন্ন রকম শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে। মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যকারিতা সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। বিরাজমান বাস্তবতায় মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, বাংলা ও বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠ্যসূচীতে আবশ্যিক করা উচিত। আর প্রয়োজন সরকারের কঠোর নজরদারি। কত শত শত মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না, কর্তৃপক্ষ কি সে খবর রাখেন? বরং জাতীয় সঙ্গীতকে অবমাননা করতে ছাত্রদের শিক্ষা দেয়া হয়। মাদ্রাসার ছাত্ররা ব্লগারদের ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করে তাদের শাস্তির দাবিতে যখন মিছিল করে তখন তাদের ব্যাপক সংখ্যকই জানে না ব্লগার কী। হুজুর বলেছেন, তাই তারা মিছিলে শামিল হয়েছে। আজকের বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা অত্যন্ত বিপদসঙ্কুুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য নিমর্মভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারদের। অজুহাত ছিল তাঁরা ধর্মের অবমাননা করেছেন। অথচ তাঁদের কেউই ধর্মের অবমাননা করে কিছু লেখেননি বা প্রকাশ করেননি। আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে তিন বছর আগে শাহ্বাগে তরুণরা যে অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের মূলে ছিলেন ব্লগাররা- যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে জনগণকে একত্রিত করেছিল। এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বাংলাদেশে অতীতে আর কখনও হয়নি। সে কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের সকল ক্রোধ ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষদের ওপর। জঙ্গীবাদের ব্যাপারে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও জঙ্গী হামলায় যারা এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে, কারও হত্যাকা-েরই তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। দু’-এক জায়গায় হত্যাকারী চিহ্নিত হলেও কোথাও কারও শাস্তি হয়নি। ফলে একটা ভয়ের সংস্কৃতি গ্রাস করছে আমাদের। বাংলাদেশে আজ পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে- আমাদের চোখের সামনে কোন অন্যায় হলে বা কেউ অত্যাচারিত হতে দেখলেও, আমরা প্রতিবাদ করি না বা করতে চাই না। আক্রমণকারী তার কাজ শেষ করে নির্বিঘেœ চলে যেতে পারে। কারণ আমরা ভয়ে কেউ এগিয়ে গিয়ে তাদের প্রতিহত করি না। আমরা ভাবি তা করতে গিয়ে যদি নিজেদের বিপদ ডেকে আনি? কিন্তু যদি আজ অন্যের বিপদে আমি এগিয়ে না আসি, তবে আমার বিপদের দিনে কাউকে পাশে পাব না। নাজি বন্দীশিবিরে ৭ বছর আটক থাকা ধর্মযাজক মার্টিন নিমুলারের কথাই আমাদের স্মরণে আসে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথমে তারা সমাজতন্ত্রীদের খোঁজে এসেছিল, তাই আমি কোন কথা বলিনি কারণ আমি সমাজতন্ত্রী ছিলাম না। তারপর তারা ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের খোঁজে এলো, এবারও আমি কথা বললাম না, কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়ন করতাম না। পরে তারা এলো ইহুদীদের খোঁজে, এবারও আমি নিশ্চুপ কারণ আমি ইহুদী নই। শেষে তারা এলো আমার খোঁজে, কিন্তু তখন দেখলাম, আমার জন্য কথা বলার মতো আর কেউ অবশিষ্ট নেই।’ গত ২৩ জুন ২০১৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তাঁর ভাষণে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন : ‘... সহনশীল জাতি বলে আমাদের অহঙ্কার ছিল। অন্যকে আপন, বন্ধু ও আত্মীয় বলে গ্রহণের ঐতিহ্য আমাদের প্রাচীন। কিন্তু এখন তা নিদারুণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অন্যের প্রতি আমরা হঠাৎই অসহিষ্ণু ও বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে পড়ছি। অপরের অস্তিত্ব, তার ধর্মবোধ, ভিন্ন মতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে প্রশ্রয় পাচ্ছে দানবিক জিঘাংসা।...’ পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে আজ নির্বাসিত। ভিন্নমত যদি আমরা সহ্য করতে না পারি তবে কিভাবে নিজেদের গণতন্ত্রী ও সভ্য সমাজের মানুষ বলে পরিচয় দেব? ইংরেজ লেখিকা এভেলিন বিয়েটিস হল যিনি ছদ্মনামে ভলতেয়ারের জীবনী লিখেছিলেন, তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি তো সভ্য সমাজের ম্যাগনা কার্টা : ‘তোমার মতকে আমি সমর্থন না করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব।’ সেদিন খবরে দেখলাম সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইন করা হয়েছে, ভিন্ন ধর্মের কোন মানুষকে ‘মুরতাদ’ বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যে কোন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সে দেশে কঠোরভাবে দমন করা হয়। আমাদের দেশে এসব খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় না। সম্প্রতি বাংলাদেশের লক্ষাধিক মুফতি ও আলেম ‘জঙ্গীবাদ জাহান্নামের পথ’ বলে যে মতামত দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও কার্যকরী পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি। তাঁরা বলেছেন, ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ হারাম। এতে আরও বলা হয়েছে, জঙ্গীদের জানাজা পড়া হারাম। যারা জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মারা যাবেন, তারা শহীদের মর্যাদা পাবেন। এ মূল্যবান দলটির ব্যাপক প্রচার কাম্য। এতে করে ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। বাঙালীর জীবনাচরণে হাজার বছরের যে অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য, তাকে যদি আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে পারি, তবেই সমাজ থেকে এসব সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দূর করা সহজ হবে। এখানে আমার ব্যক্তিগত জীবনের দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর দাঙ্গার সময়ে আমাদের পরিবার গ্রামের বাড়ি থেকে লক্ষ্মীপুর যাবার পথে দাঙ্গাকারী দুর্বৃত্তদের হাতে আটক হয়। আমাদের আটক করে জিনিসপত্র সব লুট করে নিয়ে যায়। আমরা পরিবারের সবাই এক বস্ত্রে কোনমতে আতঙ্কের মধ্যে বাড়িতে আছি; না-আছে খাবার, না-আছে পাল্টাবার মতো দ্বিতীয় কোন বস্ত্র। আমাদের এক প্রতিবেশী- এনায়েত আলী ভূঁঞা, তিনি চাল-ডাল দিলেন, কাপড় যোগাড় করে দিলেন। দাঙ্গাকারীরা নামে মুসলমান, কিন্তু সহায়তাকারী সহৃদয় প্রতিবেশী ধর্মে মুসলমান। ধর্মবর্ণ বিচার না করে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসাই তো ছিল আমাদের যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত ঐতিহ্য। দ্বিতীয় ঘটনা- ১৯৬৪ সালে যখন ঢাকার দাঙ্গাউপদ্রুত তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে বঙ্গবন্ধু আমাদের পরিবারকে নিজের জীপে তুলে তাঁর বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে এনে নিরাপদ আশ্রয় দেন। বঙ্গবন্ধু কেবল মুখে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলতেন না, জীবনাচরণে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতেন। নেতারাই তো পারেন উদাহরণ সৃষ্টি করতে। এ কথা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে জঙ্গীবাদীরা আমাদের আবার অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট, তালেবান ও আল কায়দার মতো জঙ্গীগোষ্ঠী দেশে দেশে চোরাগোপ্তা হামলা করছে। প্রাচীন সভ্যতার পুরাকীর্তি, জাদুঘর, গ্রন্থাগার সব ধ্বংস করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব ধ্বংস করে ওরা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এ সহজ কথাটা কী আমরা বুঝতে পারি না? বাংলাদেশেও আজ আমাদের সকল শুভ অর্জন ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে আবারো সেই তমসাচ্ছন্ন যুগে ফিরিয়ে নিতে মৌলবাদী গোষ্ঠী তৎপর। নববর্ষের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসবকে তারা প্রকাশ্যে ইসলাম বিরোধী বলার সাহস পায়। অথচ তারা নওরোজের খবর রাখে না। আজ যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই তাদের মরণকামড় দিতেই হবে। সে সুযোগে তাদের সঙ্গে অসৎ রাজনৈতিক দল, জঙ্গীগোষ্ঠী ও তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা একজোট হয়ে দেশে একটা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিই পারে মানুষের শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে। শেষ কথা হচ্ছে, শিক্ষার আলো জ্বালানো ছাড়া মনের অন্ধকার দূর করা যাবে না। উচ্চশিক্ষা সে পথ দেখাতে পারে সত্যি, তবে শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে বেশি। জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনই হোক সকলের কাম্য। দেশের সব মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে আপনা আপনিই দূর হবে সকল অন্ধবিশ্বাস ও ভ্রান্তি। অতীতে আমরা সব সঙ্কট সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছি, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসও আমরা সমবেত প্রচেষ্টায় দেশ থেকে দূর করতে পারব। সকল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর উর্ধে উঠে আজ আমাদের সহমর্মিতার বোধে উজ্জীবিত হয়ে, মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য গৌরবের অংশী হয়ে সত্যিকার মানুষ হওয়ার শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে হবে। যুগ যুগ ধরে যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় আমরা লালিত হয়েছি, তার উন্মেষ ঘটিয়ে আমরা আলোর পথে যাত্রা অব্যাহত রাখব। রবীন্দ্রনাথের বাণী কণ্ঠে ধারণ করে গাইতে চাই- ‘চলো যাই, চলো, যাই চলো, যাই- চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।’ [১ জুলাই ২০১৬ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবসে প্রদত্ত বক্তৃতা] লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×