ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মক্কা-মিনা মুয্দালিফা-আরাফাত

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মক্কা-মিনা মুয্দালিফা-আরাফাত

হজের সঙ্গে যেসব স্থানের সম্পর্ক সুনিবিড় তা হচ্ছে মক্কা মুর্কারমা, মিনা বা মুনা, মুয্দালিফা, আরাফাত। মক্কা মুর্কারমায় উপস্থিত হয়ে কা’বা শরীফ সাতবার তওয়াফ করার পর মাকামে ইব্রাহীমে দু’রাক’আত সালাত আদায় করে যম্যম্ কূপের পানি পান করে সাফা-মারওয়া সায়ী করে মাথার চুল কেটে ইহ্রাম থেকে মুক্ত হন তামাত্তু হজের নিয়মে যাঁরা হজ করেন তাঁরা, আর যাঁরা হজে কিরানের নিয়ত করেন তাঁরা চুল না কেটে ইহ্রাম অবস্থায় থাকেন, ইফ্রাদের নিয়তকারীরাও ইহ্রাম অবস্থায় থাকেন। তামাত্তু ওয়ালাগণ ৮ জিলহজ রাতেই ইহ্রাম বেঁধে আর কিরান ওয়ালাগণ ও ইফ্রাদ ওয়ালাগণ পূর্বের ইহ্রাম বাঁধা অবস্থাতেই রওনা হন মক্কা মুর্কারমা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিনা বা মুনার দিকে। সেখানে পৌঁছে জোহরের ওয়াক্তে জোহরের সালাত, আছরের ওয়াক্তে আছরের সালাত, মাগরিবের ওয়াক্তে মাগরিবের সালাত, ইশার ওয়াক্তে ইশার সালাত ও ফজরের ওয়াক্তে ফজরের সালাত আদায় করে ৯ জিলহজ মিনা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আরাফাত ময়দানের দিকে রওনা হন। আরাফাত ময়দানে পৌঁছে জোহরের ওয়াক্তে মসজিদে নামিরা থেকে খতীব সাহেব যে খুতবা দেন তা শুনে ওই খতীব অর্থাৎ ইমাম সাহেবের ইমামতিতে জোহরের সালাত, তার পর পরই আছরের সালাত আদায় করেন। এই দুই ওয়াক্তের সালাতই জোহরের ওয়াক্তে আদায় করা হয় কসরের নিয়তে অর্থাৎ চার চার রাকাআতের স্থলে দুই দুই রাকাআত করে। তারপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করতে হয়। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রওনা হতে হয় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত মুয্দালিফার দিকে এবং মুয্দালিফা পৌঁছে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করতে হয় এবং খোলা আকাশের নিচে মুয্দালিফায় অবস্থানকালে এখান থেকে পশ্চিম দিকে আবার মিনায় গিয়ে শয়তানকে কঙ্কর মারার জন্য কঙ্কর সংগ্রহ করতে হয় অন্তত পক্ষে ৭০টি, ফজরের ওয়াক্তে ফজরের সালাত আদায় করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পশ্চিমে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিনার উদ্দেশে রওনা হতে হয়, পথিমধ্যে আব্রাহার হস্তিবাহিনীকে আবাবিল পাখি কঙ্কর মেরে যেখানটিতে ধ্বংস করেছিল সেই ওয়াদিউন্নার বা ওয়াদিয়ে মুহাস্সার দ্রুত অতিক্রম করে মিনায় পৌঁছে প্রথমে মক্কা ও মিনার সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থিত জামরায়ে আকাবায় বা বড় শয়তানকে একটি একটি করে সাতটি কঙ্কর মারতে হয়, তারপর যাঁরা হজে কিরান ও হজে তামাত্তুর নিয়ত করেছিলেন তাদেরকে পশু কোরবানি দিয়ে এবং তারপর মাথার চুল কেটে কিংবা মু-ন করে ইহ্রাম মুক্ত হয়ে ভালভাবে গোসল করে সাধারণ পোশাক পরিধান করতে হয়। হজে ইফ্রাদের নিয়ত যাঁরা করেছিলেন তাঁরা কোরবানি দেয়া ছাড়া অন্যগুলো পালন করেন। তারপর ওই দিন কিংবা পরের দিন মক্কা মুর্কারমায় এসে কা’বা শরীফ সাতবার তওয়াফ করে সাফা-মারওয়া সায়ী করে আবার সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনায় ফিরতে হয়। এই তওয়াফকে তওয়াফে ইফাজা বা তওয়াফে জিয়ারত বলা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হজের ফরজ হচ্ছে তিনটি-১. ইহ্রাম বাঁধা, ২. ওকুফে আরাফা বা ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে অবস্থান আর ৩. তওয়াফে জিয়ারত। ১১ জিলহজ মিনায় দুপুরের পরে প্রথমে জামরায়ে সুগরাবা ছোট শয়তানকে একটি একটি করে ৭টি, তারপর জামরায়ে উসতা বা মেঝো শয়তানকে এভাবে ৭টি, তারপর জামরায়ে আকাবা বা বড় শয়তানকে ঐভাবে ৭টি কঙ্কর মারতে হয়। ১২ জিলহজ সূর্য পশ্চিমাংশে ঢলে পড়লে ওই একইভাবে তিনটি শয়তানকে কঙ্কর মেরে মক্কা মুর্কারমা ফিরে আসতে হয় আর এরই মধ্য দিয়ে হজ পালিত হয়ে যায়। হজের প্রধান প্রধান হুকুম-আহ্কামের অধিকংশই মিনায়, মুয্দালিফায়, আরাফাতে পালিত হয় নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে। এই তিনটি স্থানের এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। আমরা জানি, আল্লাহ্ হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে জান্নাতে সৃষ্টি করেন মাটি, পানি, আগুন, বাতাসের সংমিশ্রণে। আদমের একাকিত্ব দূরীভূত করবার জন্য আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ঘুমিয়ে থাকা হযরত আদম (আ.)-এর বাঁ পাঁজর থেকে সৃষ্টি করেন হাওয়া আলায়হাস্ সালামকে। জান্নাতেই আদি মানব-মানবীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। আল্লাহ্ হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সর্ববিষয়ে জ্ঞান দান করেন এবং ফেরেশ্তাদের চেয়েও অধিক মর্যাদা দান করেন। আদমকে এই মর্যাদা দিয়ে তিনি ফেরেশ্তাদের নির্দেশ দেন আদমকে সম্মান জানাতে সিজ্দা করার মাধ্যমে। সব ফেরেশ্তা আদমকে সিজ্দা করেন, কিন্তু ইবলিস আল্লাহ্র এই হুকুম পালন করা থেকে বিরত থাকে এই বলে যে, আমি আগুনের সৃষ্টি, আমি কেন মাটির আদমকে সিজ্দা করব। ইবলিস আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করল অহঙ্কারবশে, যে কারণে সে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত শয়তানে পরিণত হলো। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত আদমকে (আ.) সস্ত্রীক জান্নাতে থাকবার নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করলেন : হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখানে ইচ্ছে স্বচ্ছন্দে আহার-বিহার কর কিন্তু এই গাছটির কাছে যেও না, যদি যাও তাহলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা বাকারা : আয়াত ৩৫)। কিন্তু শয়তান তাদেরকে বিভ্রমে ফেলে ওই নিষিদ্ধ গাছের কাছে নিয়ে গেল, ফলে তাদেরকে পৃথিবীতে অবতরণ করানো হলো। হযরত আদম (আ.) বর্তমান শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড় চূড়ায় এবং হযরত হাওয়া (আ.) জেদ্দায় অবতরণ করলেন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর ধরে তওবা-ইস্তিগ্ফার করায় হযরত মুহম্মদ (সা.) এর উসিলায় আল্লাহ্ তাঁদের তওবা কবুল করলেন। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর তাঁরা মিলিত হলেন যে স্থানটিতে সেই স্থানটির নামকরণ হয় আরাফাত। আরাফা অর্থ পরিচিত হওয়া। তারপর তাঁরা সেখানটিতে এসে রাত্রি যাপন করেন সেই স্থানটির নামকরণ হয় মুয্দালিফা। এর অর্থ একান্ত সান্নিধ্য বা নিকট থেকে নিকটতর হওয়া। সকাল বেলা তাঁরা মিনা হয়ে যে পাহাড়বেষ্টিত সমতল ভূমিতে এসে উপনীত হন এবং বসত স্থাপন করেন সেই স্থানটির নাম বাক্কা- যা মক্কা নামে পরিচত হয় পরবর্তীকালে। এখানে আদম (আ.) সপ্ত আসমানে অবস্থিত ফেরেশ্তাদের কা’বা বায়তুল মামুরের মতো একটি ইবাদত গৃহ নির্মাণের জন্য আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নিকট দোয়া করলে আল্লাহ বায়তুল মামুরের বরাবর নিচে ফেরেশ্তাদের দ্বারা একটি গৃহের ভিত্তি স্থাপন করিয়ে দেন এবং সেই গৃহের দেয়ালের এক কোণে জান্নাতী একটি পাথর স্থাপন করা হয়। সেই গৃহই কা’বা গৃহ আর সেই পাথরই হাজরে আসওয়াদ। এই গৃহ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ (ইবাদত গাহ্) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায় (মক্কায়), তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের জন্য দিশারী। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৯৬)। হযরত নুহ আলায়হিস্ সালামের সময় ঘটে যাওয়া মহাপ্লাবনে এই গৃহ ধসে পড়ে এবং দীর্ঘকাল এই স্থান বিরান অবস্থায় থাকে। হযরত আদম (আ.) এর বংশধররা পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু বছর পর নিঃসন্তান হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজিরার গর্ভে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে যাঁর নাম রাখা হয় ইসমাঈল। আল্লাহ্র হুকুমে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহ্র রহমতে প্রাপ্ত শিশু পুত্র ইসমাঈলকে ও স্ত্রী হাজিরাকে কয়েকদিনের খাবার ও পানি দিয়ে মক্কার এই বিরান স্থানে রেখে আসেন ফিলিস্তিনের কানআন থেকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে। তিনি দোয়া করেছিলেন : হে আমার রব্! এই নগরীকে (মক্কা) নিরাপদ রেখ এবং আমাকে ও আমার বংশগণকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রেখ। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩৫), হে আমার রব! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার গৃহের নিকট। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩৭) কয়েক দিনের মধ্যে খাবার-দাবার ও পানি ফুরিয়ে গেলে পানির জন্য সমতলভূমিতে শিশু ইসমাঈলকে রেখে মা হাজিরা পাগলিনীর মতো সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন আর সন্তানের দিকে তাকাতে থাকেন, হঠাৎ দেখতে পান শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছে র্ঝির্ঝি করে পানি বের হচ্ছে তিনি ছুটে এসে সেই পানির উৎসের চারদিক পাথর দিয়ে বেঁধে দিলেন। আস্তে আস্তে সেখানে একটি কূপের সৃষ্টি হলো যার নাম যম্যম্-অফুরন্ত পানি। বেশ কয়েক বছর পর হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে একদিন তাঁর পার্থিব সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করার জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুত্রকে তিনি স্বপ্নের কথা বললে পুত্র ইসমাঈল বললেন : আব্বা, আপনি আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুন, আমাকে ইনশাআল্লাহ্ আপনি ধৈর্যশীল পাবেন। পুত্রকে তিনি সঙ্গে নিয়ে মক্কার অদূরে মিনা স্থানে পৌঁছলেই শয়তান তিনটি স্থানে তাঁদেরকে আল্লাহ্র এই হুকুম পালন করা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করলে তাঁরা পাথর তুলে শয়তানকে মারলেন এই বলে : দূর হ শয়তান, আল্লাহ্র সন্তুষ্টিই আমাদের কাম্য। তারপর মিনার একটি স্থানে পুত্র ইসমাঈলকে কাত করে শুইয়ে দিয়ে তাঁর গলায় ছুরি চালালে আল্লাহ্র তরফ থেকে তা করতে নিষেধ করা হলো এবং এটা যে পরীক্ষা ছিল ইব্রাহীমের জন্য তা ঘোষিত হলো। পুত্রের বদলে একটি দুম্বা কোরবানি দেয়ার নির্দেশ এলো। হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাই করলেন। সেই কোরবানি দেয়ার রীতি এখনও চালু আছে। লক্ষ করা যায় হজের বিধানগুলো পালিত হয় নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে নির্দেশ দেন তাঁর গৃহ বা কা’বা ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য। কিন্তু সেই গৃহের ভিত্তি যে যম্যমের অতি নিকটে তা তাঁর জানা ছিল না। ফেরেশ্তা জিব্রাঈল এসে তা দেখিয়ে দেন এবং এক খ- মেঘ তার ওপর ছায়াপাত করে। হযরত ইব্রাহীম সেই স্থান খুঁড়ে ভিত পেয়ে যান, সেই ভিতের ওপর তিনি তাঁর পুত্র ইসমাঈলের সহযোগিতায় কা’বা শরীফের দেয়াল তোলেন। যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি এই দেয়াল তোলেন সেই পাথরে তাঁর পায়ের চিহ্ন গভীর হয়ে পড়ে যায়। সেই পায়ের চিহ্নের পাথরখানি আজও কা’বা শরীফের পাশে রক্ষিত আছে, যাকে মাকামে ইব্রাহীম বলা হয়। কা’বা ঘর পুনরায় নির্মিত হয়ে গেলে আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে এখানে এসে হজ করার ঘোষণা করতে নির্দেশ দেন। আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী হযরত ইব্রাহীম (আ.) হজের ঘোষণা দেন আবূ কুবায়স পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে। তারপর থেকে জিলহজের নির্দিষ্ট তারিখগুলোতে হজ পালিত হতে থাকে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ইব্রাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ্র দেয়াল তুলবার সময় বলেছিল : হে আমাদের রব! আমাদের এই কাজ কবুল কর নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা। (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৭)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি যখন কা’বা ঘরকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম তখন বলেছিলাম : তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজ্দাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম। (সূরা বাকারা : আয়াত ১২৫)। হজের ঘোষণা দেয়ার হুকুম প্রসঙ্গ এনে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও, ওরা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্ব প্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে, ওরা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা হজ : আয়াত ২৭)। কালক্রমে এই হজ আইয়ামে জাহিলিয়াতের খপ্পরে পড়ে র্শিক ও কুফরের অন্ধকারে ছেয়ে যায়। লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক উচ্চারণ থাকলেও তার সঙ্গে বিভিন্ন গোত্রের ও জাতির দেব-দেবীর নাম সংযুক্ত হয়ে যায় এবং মক্কার বাইরে থেকে যারা হজ করতে আসত তারা ইহ্রাম বাঁধা বলতে উলঙ্গ হওয়া বুঝত এবং তাই করত। মক্কার কুরাইশরা আভিজাত্যের কারণে আরাফাত ময়দানে আমজনতার সঙ্গে ৯ জিলহজ মিলিত হতো না, তারা মুয্দালিফায় এসে জড়ো হতো। আরাফাত ময়দানে হযরত ইব্রাহীম কর্তৃক নির্মিত একটি মসজিদ ছিল তাও যতেœর অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর নিকট হজ বিধান নাজিল হলে তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এক লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবীসহ হজ পালন করেন। তিনি ৯ জিলহজ আরাফাতে পৌঁছে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের মসজিদ যেখানটিতে ছিল ঠিক সেইখানটিতে কালো কম্বল দিয়ে একটি তাঁবু স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে উটের পিঠে আরোহণ করে বিদায় হজের খুতবা দিতে দিতে আরাফাত পাহাড়ের চূড়ায় উঠে শেষ করেন। আরাফাত পর্বতের নামকরণ করা হয় জবলে রহমত। আজকের মসজিদে নামিরাই হচ্ছে সেই স্থান, সেখানে ইব্রাহীম মসজিদ ছিল। প্রিয় নবী (সা.) সেই হজ যেভাবে পালন করেছিলেন এখনও হজ সেই নিয়মে পালিত হয় এবং হতে থাকবে। কুরাইশরা যে আভিজাত্যের অন্ধ অহমিকায় আমজনতার সঙ্গে আরাফাতে ৯ জিলহজ না গিয়ে মুয্দালিফা অবস্থান করত তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : তোমরা যখন আরাফাত হতে প্রত্যাবর্তন করবে তখন মাশ্’আরুল হারাম (মুয্দালিফার পাহাড়)-এর নিকট পৌঁছে আল্লাহ্র যিক্র করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁর যিক্র করবে। যদিও ইতোপূর্বে তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৯৮)। হজ বিশ্ব মানবতার ঐক্য ও সংহতির এক অপূর্ব নিদর্শন। আল্লাহ্র মেহমান হিসেবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য ব্যবস্থা হজ। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×