ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রফতানিতে পুরস্কার ॥ ব্যবসায়ীদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রফতানিতে পুরস্কার ॥ ব্যবসায়ীদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ

অনেক দেরিতে ‘রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো’ (ইপিবি) দেশের শীর্ষ রফতানিকারকদের নানা পদকে পুরস্কারে ভূষিত করেছে। গত সপ্তাহে তারা এক অনুষ্ঠানে এই পুরস্কার দেয়। মোট ৩২টি ক্যাটাগরিতে দেশের বড় রফতানিকারকরা ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ‘এ্যাওয়ার্ড’ পান। স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ ট্রফিগুলো রফতানিকারকদের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুঝলাম না ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছর গেছে সেই কবে, এখন ২০১৬-১৭ অর্থবছর, এতদিন কেন লাগল এই ট্রফি প্রদানে। এখন কম্পিউটারের যুগ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কোন্্ রফতানিকারক কত টাকার পণ্য কোন্্ দেশে কত মূল্যে রফতানি করেছেন এসব তথ্য বোতাম টিপ দিলেই পাওয়ার কথা। অথচ এত বিলম্ব করে ট্রফি প্রদান করা হলো। ভাল কাজ দেরিতে করলে এর ফল এত ভাল হয় না বলেই জানি। তবু মন্দের ভাল, ‘ইপিবি’ এই কাজটি করছে বেশ অনেকদিন ধরেই। জানা যায়, কোম্পানির রফতানি আয়, রফতানিতে তার অগ্রগতি, রফতানি পণ্য, নতুন বাজারে পণ্য বিক্রি এবং বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা পরিপালন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এবার ২৪টি স্বর্ণ, ১৮টি রৌপ্য এবং ৯টি ব্রোঞ্জ পদক দেয়া হয়েছে। সরকার আরেকটি ক্যাটাগরিতে আলাদাভাবে সর্বোচ্চ রফতানিকারককে পুরস্কৃত করেছে। বলাবাহুল্য, রফতানি উন্নয়নে এই পদক বিতরণ উৎসাহ যুগিয়ে আসছে রফতানিকারকদের। প্রধানমন্ত্রী এই পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রথমেই তিনি বলেছেন পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে এবং রফতানি পণ্য হিসেবে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন করতে, যাতে পোশাক রফতানি এবং কয়েকটি বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়। তিনি বলেছেন, বিশ্বমন্দা না হলে এবং ‘ইউরো’ মুদ্রার অবমূল্যায়ন না হলে আমাদের রফতানি আয় আরও বেশি হতো। তিনি বলেছেন, তার সরকার গত ৭ বছরে ২১ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে নগদ ভর্তুকি হিসেবে। তার অর্থ প্রতি বছর সরকার রফতানি বৃদ্ধিকল্পে তিন হাজার কোটি টাকা ‘ক্যাশ সাবসিডি’ হিসেবে প্রদান করেছে। শুধু ২০১৫-১৬ অর্থবছরেই সরকার নগদ ভর্তুকি দিয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। সরকার রফতানি বৃদ্ধিকল্পে কী কী করছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের উপদেশ দিয়েছেন আরেকটি ব্যাপারে। তিনি তাদের বলেছেন শ্রমঘন শিল্প করতে, যাতে অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন ৭৩ শতাংশ বাংলাদেশীই যুব সম্প্রদায়ভুক্ত, যা আমাদের জন্য বিরাট একটি সুবিধা ও শক্তি। প্রধানমন্ত্রী দেশে যে ১০০টি ‘ইকোনমিক জোন’ গড়ে উঠছে তার কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের রফতানি আয় হবে ৬০ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান এক হাজার মিলিয়ন) ডলার, যার মধ্যে কেবল পোশাক রফতানি খাত থেকেই আসবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন রফতানি পণ্যে কৃষিজাত পণ্য ও কৃষিপণ্য যোগ করতে, যাতে প্রকৃত রফতানি আয় বেশি (ভ্যালু এ্যাডিশন) হয়। তিনি আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া ও নেপালের মধ্যকার ট্রানজিট সুবিধা পুরোপুরি চালু হলে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ঐ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প নিয়েও কথা হয়। বলা হয় বাংলাদেশ থেকে বহু দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। আগামী দিনে আইসিটি ও ওষুধ শিল্প থেকেও আমাদের রফতানি আয় বেশ বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রীর পদক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের বক্তব্য একটু বিস্তারিতভাবেই তুলে ধরলাম। এর কারণ আছে। বলা যায় তার বক্তৃতায় ভবিষ্যতের একটা রূপরেখা আছে। তিনি কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রফতানির ওপর যে গুরুত্বারোপ করেন তা যথার্থ। বিদেশে কেন, দেশেও রাসায়নিক মিশ্রণবর্জিত জৈবসারে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বড় বাজার আছে। রাসায়নিক সার ব্যবহৃত পণ্যের ওপর আমাদের মধ্যবিত্তরা আস্থা হারাচ্ছে। প্রাকৃতিক সার দিয়ে তৈরি কৃষিপণ্যের দাম ক্রেতারা বেশি দিতে রাজি। মাছের বাজারেও তাই। চাষের মাছের চেয়ে নদী-নালা-বিল ইত্যাদির মাছের কদর বাজারে বেশি। এই অর্থে এসবে ভ্যালু এ্যাডিশন বেশি। বিদেশে এই ধরনের পণ্য রফতানি করতে পারলে তাৎক্ষণিক বাজার পাওয়ার সম্ভাবনা। বলাবাহুল্য, প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করে কৃষিতে নবজাগরণ ঘটানো যায়। এই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর শ্রমঘন শিল্পের কথাও স্মরণ করা যায়। সরকার ১০০টি ইকোনমিক জোন করছে। এসবে বিনিয়োগ হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এসব শিল্পে কর্মসংস্থান হবে খুবই কমÑ এ কথা মনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী শ্রমঘন শিল্পের কথা বলেছেন। কৃষি হতে পারে শ্রমঘন শিল্প ও কৃষিজ শিল্পের বড় জায়গা। মনে রাখতে হবে যদিও কৃষির অবদান জিডিপিতে কমছে; কিন্তু এখনও কৃষিতে নিয়োজিত বৃহত্তম সংখ্যক শ্রমিক। অতএব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা যদি কৃষিতে বিনিয়োগ করেন তাহলে দেশের যথেষ্ট উপকার হবে। বলাবাহুল্য, কৃষিতে বিনিয়োগ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, যা লক্ষণ হিসেবে ভাল নয়। এই প্রবণতা রোধ করা দরকার। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি আশাবাদের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপালের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা পুরোপুরি প্রবর্তিত হলে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি পাবে। এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পোশাক শিল্পের অন্যতম একটি বড় সমস্যা সম্পর্কে দুটি কথা বলা দরকার। পোশাক কারখানার জন্য মুন্সীগঞ্জের বাউসিয়াতে পোশাকপল্লী তৈরি করা হচ্ছে। এটি তৈরি করছে একটা চীনা কোম্পানি। প্রধানমন্ত্রী দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন এখানে যেতে পোশাক কারখানার মালিকরা গড়িমসি করছে। কেন? তারাই বলেন তাদের জায়গার অভাব। সরকার তা পূরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে তারা সরকারের সেই সদিচ্ছার কোন মূল্য দিচ্ছেন না। যেমন দিচ্ছেন না আরেকটি রফতানি খাতের কারখানা। সেটা হচ্ছে চামড়া শিল্প। সাভারে সরকার চামড়া শিল্পের জন্য আধুনিক চামড়া নগরী করে দিয়েছে। তারা সেখানে যেতে চান না। আদালত তাদের জরিমানা করছে। তবু তারা গড়িমসি করছেন। তারা আবার অনেকেই ঋণ খেলাপী। অবশ্য খেলাপী ঋণের ক্ষেত্রে পোশাক কারখানা যেমন আছে, তেমনি আছে চামড়া শিল্পের কারখানাগুলোও। এটা ভিন্ন একটা সমস্যা। সেই আলোচনাও ভিন্ন। আপাতত আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি আগেই প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদের কথা উল্লেখ করেছি এবং বলেছি তার আশাবাদের একটা ভিত্তি আছে। ভিত্তি ও তথ্যটি ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের। বহুদিন ধরেই আমরা জানছি যে, ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি বিপুল। এই ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা যায় তার কথাই সবসময় ওঠে। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৫৬৩ মিলিয়ন ডলার। সেইস্থলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯০ মিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ভারতে আমাদের রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮৯ মিলিয়ন ডলার। অপরপক্ষে ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে বিপুল পরিমাণ পণ্য। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪৫০ মিলিয়ন ডলার। ভারত থেকে আমদানির তুলনায় সেদেশে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু লক্ষণীয়, বাংলাদেশের রফতানি দিন দিন বাড়ছে। পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের একটা বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ত্রিপুরাতে ‘প্রাণের’ জিনিস ঘরে ঘরে। সিমেন্ট, লোহা, রড, চা, বিস্কিট, চানাচুর ইত্যাদি বাংলাদেশী পণ্যে ভর্তি আগরতলার বাজার। প্রতিদিন সীমান্তে বাংলাদেশী পণ্যভর্তি ট্রাক দেখা যায় বিপুল সংখ্যায়। ভারতে বাজার পেয়েছে রহিম আফরোজও। এই দুটি ‘হাউজ’ ভারতে বিনিয়োগও করছে। এদিকে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগও বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা যায় বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। চীনা বিনিয়োগও বাংলাদেশে ভারতের প্রায় সমান। এয়ারটেল, ‘সিইএটি’ (সিয়েট), মারিকো, আদিত্য বিড়লা ইত্যাদি ব্যবসায়ী গ্রুপের বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে। নিটল-নিলয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘হিরো’ গ্রুপও বাংলাদেশে আসছে ৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে। দুই দেশের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের জন্য দরকার জনগণের মধ্যে গভীরতর যোগাযোগ এবং পণ্য আনা-নেয়ার ব্যবস্থা, দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা। কয়েকটি পণ্য বাদে ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা কোন উপকারে আসছে না। এদিকে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হয়েছে চিহ্নিত। প্রাকৃতিক সম্পদের ভাগাভাগি, বন্যানিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তায় সহযোগিতা, ‘বিএসটিআই’-এর সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, পেট্রাপোল ও বেনাপোলে চার লেন রাস্তা নির্মাণ- এসব হচ্ছে সম্ভাবনার কয়েকটি দিক। এদিকে মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-শিলং, আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা ইত্যাদি বাসরুটের পর সর্বশেষ যোগ হয়েছে খুলনা-বেনাপোল-কলকাতা ট্রেন। ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস তো আছেই। ভারতের বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে। এসবের ফল পাওয়া যাচ্ছে। ধীরে ধীরে হলেও বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য বাণিজ্য ঘাটতি এখনও বিপুল। সেই বিপুল ঘাটতি আমাদের রয়েছে চীনের সঙ্গেও। পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করতে না পারলে ঘাটতি দূর করা কঠিন, যার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×