ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

আরব্যরজনীর জাদুর প্রদীপ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আরব্যরজনীর জাদুর প্রদীপ

শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট চরিত্র কথাচ্ছলে কথা দিয়েই কথাকে ব্যাঙ্গ করে বলে, পড়ছি কথা আর কথা। কোটি কোটি কথার ভিড়ে কোনটি যে কাজের কথা, কোনটি ফাউ কথা অথবা কোনটি বাজে কথা সে মীমাংসায় পৌঁছাতে প্রয়োজন মিলিয়ন-বিলিয়ন দামী কথা। এত সত্ত্বেও বয়োজ্যেষ্ঠরা তো বলেন, কাজ বেশি কথা কম। কম কথা না, বরং একদম কথা না বলেই শুধুমাত্র অভিনয় দিয়েই এক সময় মহিলা সমিতির রজনী উদ্ভাসিত করেছেন লিজেন্ড অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তার অভিনীত একা নাটকে। একা নাটকটি ছিল জার্মান নাটক রিকোয়েস্ট কনসার্ট এর বাংলা রূপান্তার। অনেকটা তেমনই সীমিত সংলাপ কিন্তু বাদবাকি পুরোটাই আঙ্গিক সাত্ত্বিক অভিনয় নির্ভর নাট্য প্রয়োজনা জাদুর প্রদীপ। আরব্য রজনীর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ অবলম্বনে অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক জাহিদ রিপন পুনর্বিনস্ত ও নির্দেশিত, স্বপ্নদল প্রযোজিত নাটক জাদুর প্রদীপ মঞ্চস্থ হলো সেলিম আল দীন নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ গত ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। হলে বিলে খালে কিংবা মরুর বালির পরে দাঁড়িয়ে লোভীর যেমন ছলনার অভাব হয় না, ঠিক তেমনি লোভী জাদুকর যে কিনা জেনে গেছে পাহাড়ের গহীন খাদে রয়েছে জাদুর প্রদীপ যা হাতে এলে সমস্ত পৃথিবীই হবে করায়ও, তারও ছলনার অভাব হয় না। গহীন থেকে প্রদীপ আনার যোগ্য ব্যক্তি যে দুঃখিনী মায়ের ছেলে আলাদিন এ কথা জাদুকর জেনে বন্ধুত্বের আর অর্থ প্রদানের ছলনায় আলাদিনকে রাজি করায়। ভয়ার্ত আলাদিন গর্তে প্রবেশে অসম্মতি জানালে গলায় চাকু ধরে যেতে বাধ্য করে জাদুকর। কিন্তু আলাদিন বোঝে, যে বন্ধু হয়েও স্বার্থের প্রয়োজন গলায় চাকু ধরতে পারে সে যে প্রদীপটি হাতে পেয়ে সাক্ষী বিলুপ্তি ঘটাতে তাকে মেরে ফেলবে না তার নিশ্চয়তা কি? ফলে আলাদিন জাদুর প্রদীপ পেয়েও গর্তের বাইরে আসে না। হুমকি-ধামকিতে কোন কাজ না হওয়ায় গর্তের মুখে পাথর চাপা দিয়ে আলাদিনের মৃত্যু নিশ্চিতের ব্যবস্থা করে জাদুকর রওনা দেয়। প্রদীপের দৈত্যের আনুকূল্যে আলাদিন মুক্ত হয়, অবস্থার উন্নতি হয় এবং মাতৃ আশীর্বাদ নিয়ে রাজকন্যার উপযুক্ত স্বামী হয়। কিন্তু রাবণ যেভাবে সোনার হরিণের মায়া দেখিয়ে সীতাকে হরণ করে অনেকটা সেভাবে শিকারে বেরুনো আলাদিনের অনুপস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলাদিনের মাও স্ত্রীসহ জাদুর প্রদীপ হরণ করে লোভী জাদুকর। বিধ্বস্ত, ভেঙ্গে পড়া আলাদিন এক দরবেশের পরামর্শে অবশেষে জাদুকরের হাত থেকে উদ্ধার করে মা ও স্ত্রীকে এবং জাদুর প্রদীপের দৈত্যের প্রতি ভালবাসার প্রতিদান হিসাবে দৈত্যকে মুক্ত করে তার বন্ধীদশা থেকে মানব তীর্থ যাত্রায়। মানবতার মুক্তির জয়গানের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় স্বপ্নদলের মাইমোড্রামা জাদুর প্রদীপ। জাদুর প্রদীপ কৌশলী জাদুকরের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে নাটকের পরিধি একটু বেড়ে গেলেও পুনর্বিন্যাসকারী ও নির্দেশক জহির রিপনের দুটি অবস্থান স্বতন্ত্র কারনে। এক. অর্জিত অর্জন ধরে রাখতে চাই নিরবচ্ছিন্ন চর্চা। দুই. ভুল মানুষ ভুল সময়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করলে তার পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর। লোক কাহিনীর শক্তিটাই বুঝি এমন যা গল্পচ্ছলে বোধ বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়। প্রয়োজনটির বিকাশ ও প্রকাশে জাহিদ রিপনের পরিশ্রমী মানসিকতা ও নিরলস ধৈর্যের দৃঢ়তা দৃশ্যমান। আবহে এ্যারাবিক-বাংলার লোক-আধুনিক সুর সংযোজন বিশ্বায়নের মানসিকতা বোঝায়। আঙ্গিক অভিনয়ে শব্দ-বাক্য ও ঘটনার দৃশ্যকল্প নির্মাণ তার সৃজনশীলতা। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে অন্দর-বাহির অভিনয় স্পেস নির্মাণ এবং অভিনয় করিয়ে নাটকের গতিশীলতা ধরে রাখাটা তার দক্ষতা। তবে ঐতিহ্য তথা ক্ষমতা ট্রান্সফার প্রসঙ্গে জাহিদ রিপনের ডিরেক্টরিয়াল সিদ্ধান্তের প্রশ্নে কথা থাকে। ছলনাকারীর যেমন ছলনার অভাব হয় না, ঠিক তেমনি ছলনাকারী বলে নির্দিষ্ট করে কাউকে বা কোন বৈশিষ্ট্যকে চিনিয়ে দেয়া ছলনা শব্দের ব্যাপ্তিকে সংক্ষিপ্ত করে। উপরন্ত নির্দেশক জাহিদ রিপন নিশ্চই বিশ্বাস করেন, দলের দলীয় প্রধান হিসাবে তার সিদ্ধান্ত যেখানে মানানসই, সেখানে দলীয় শিল্পী হিসাবে দর্শকদের সম্মুখে শিল্পের মতামত তুলে ধরাটাই তার সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের একটা বড় অংশ এই প্রযোজনায় অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের সামগ্রিক টিমওয়ার্ক। এই নাটক চিনিয়ে দেয় অভিনেতা আলাদিনরূপী অভিনেতা সামাদ ভূঞা, জাদুকররুপী অভিনেতা শিশির সিকদার কিংবা দৈত্যরূপী অভিনেতা শাহীন শাওনসহ আরও অনেককে। জাদুকররূপী অভিনেতা শিশির সিকদার খানিকটা প্রাপ্য প্রপস থেকে বঞ্চিত হলেও (গলায় মালা, হাতে বেসলেট, পরনে ঢোলা তালি দেয়া পোশাক প্রভৃতি বিবেচ্য) আলাদিনরূপী অভিনেতা সামাদ ভূঞা স্বপ্নে-জাগরণে কিংবা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে যে মরণীয় অভিনয় ফুটিয়ে তুললেন অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তাকি ভোলা যায়! ভোলার প্রশ্ন নয়, বরং নাটক জাদুর প্রদীপ বিশ্বাস করায়, পাশ্চাত্য-মধ্যপ্রাচ্য এবং প্রাচ্য মিলেমিশে একাকার হয় মঞ্চনাটকের মোহিনী মায়ায়।
×