ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

রসাতলে যেতে বসেছে ভেনিজুয়েলা

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৩১ আগস্ট ২০১৬

রসাতলে যেতে বসেছে ভেনিজুয়েলা

ভেনিজুয়েলার মানুষ আজ খাদ্যের জন্য, গ্যাসের জন্য এমনকি সাধারণ শ্যাম্পুর জন্য দোকানে লাইন ধরে। সেই কাকভোর থেকে লাইন শুরু হয় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। সে দেশে কোথাও কোথাও ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। হাসপাতালে ওষুধের অভাবে রোগীকে মারা যেতে হয়। মানুষ প্রতিবাদ জানালে, বিক্ষোভ করলে পুলিশ নিষ্ঠুরভাবে লাঠিপেটা করে। থানার ফটকগুলো বন্দীদের ভিড়ে ঠাসা। এককভাবে যে দেশটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের ভা-ার সেই দেশ আজ এমনিভাবে ধসে পড়ছে। রসাতলে যাচ্ছে। এক সময় লাতিন আমেরিকার আদর্শ দেশ ছিল ভেনিজুয়েলা সিমন বলিভারের সেই দেশটি বছরের পর বছর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে আজ এই করুণ দশায় পড়েছে। রাষ্ট্রীয় মুদ্রা বলিভার এখন আর ওয়ালেটে নিতে হয় না, ব্যাক প্যাকে নিতে হয়। এক ইউনিটের মূল্য এক পেনিরও কম এমনই পড়ে গেছে এর দাম। উৎপাদন কমছে। অপরাধ বাড়ছে। খাদ্যের লাইনগুলোতে মারামরি নৈমিত্তিক ঘটনা। গত বছর ১৭ হাজার থেকে ২৮ হাজার লোক খুন হয়েছে। সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না। তবে এই হত্যার হার বিশ্বে সর্বাধিক। স্ট্রিট গ্যাং, ড্রাগ কার্টেল, বাম গেরিলা ও ডানপন্থী মিলিশিয়ার ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে এসব হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে চিড়িয়াখানার প্রাণীরাও মারা যাচ্ছে। হ্যারিকেনের মতো কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়লে যে অবস্থা হয় আজ ভেনিজুয়েলার সেই দশা। মনে হচ্ছে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, শেষ হতে চলেছে। কেন এমন হলো? এ জন্য পশ্চিমা মহল একজনের শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকে। তিনি হুগো শ্যাভেজ। ক্যান্সারে ২০১৩ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ১৪ বছর দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাই নাকি বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। যে যাই বলুক দারুণ জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্যাভেজ। জনকল্যাণে অনেক কিছু বলেছিলেন। করার সুযোগও ছিল। তার কার্যকলাপের বেশিরভাগ সময়টা তেলের দাম আকাশচুম্বী ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার উত্তরসূরি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও প্রাক্তন বাসচালক নিকোলাস মাদুরোর। তার আমলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি এক শ’ ডলার থেকে কমতে কমতে ২৫ ডলারে নেমে আসে। এখন অবশ্য ৩৫ ডলার। দেশের রাজস্বের প্রধান উৎস তেল। তেলের আয় কমে যাওয়ায় দেশ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে মাদুরোর পক্ষে। এই অবস্থায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিরোধীরা। গত বছরের ডিসেম্বরে মধ্যমেয়াদী নির্বাচনে তারা ১৯৯৮ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। কিন্তু তাতে কি। মাদুরোর হাতে সর্বময় ক্ষমতা শ্যাভেজেরই রেখে যাওয়া লিগেসি। বিরোধীরা মাদুরোকে সরানোর জন্য গণভোট চাইছে। গণভোট হলে মাদুরোর শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। সে জন্য তিনি ও পথ মাড়াচ্ছেন না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি রাষ্ট্রশক্তি সামরিক বাহিনী ও পুলিশের ওপর নির্ভর করছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতা তিনি ছাড়ছেন না। গত মে মাসে তিনি জরুরী অবস্থা জারি করেন। মাদুরোর যে জনসমর্থন নেই তা নয়। তাঁর সমর্থনে জঙ্গী শাভিস্টাদের প্রায়ই মিছিল হয়। মাদুরোর অভিযোগ। দেশের ধনিক শ্রেণী সিআইএ ও কলম্বিয়ার প্যারামিলিটারির যোগসাজশে বর্তমান সঙ্কট তৈরি করে বিদেশী হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। ভেনিজুয়েলার এমন অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না। বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের ১৮ শতাংশ ভেনিজুয়েলার যা প্রায় ৩শ’ বিলিয়ন ব্যারেলের সমান। ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগের আগ পর্যন্ত মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল দেশটা। তারপর তেলের দাম দীর্ঘস্থায়ী মন্দার কবলে পড়ে। অর্থনীতি শোচনীয় আকার ধারণ করে। লুটপাট হয়। বিক্ষোভ হয়। এই টালমাটাল অবস্থায় তরুণ প্যারাট্রুপার শ্যাভেজ ১৯৯২ সালে অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়ে ব্যর্থ হন। দু’বছর জেল খাটেন। কিন্তু এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শ্যাভেজ বরাবরই এর বিচিত্র ধরনের সমাজতন্ত্রের ধারক-বাহক ছিলেন। তেল শিল্পের ওপর নির্ভর করে তিনি ব্যাপকভাবে সেই সমাজতন্ত্র অনুশীলন করেন। সৌভাগ্যক্রমে তেলের দর তার আমলে বাড়তে থাকে এবং ২০০৮ সালে ১৪০ ডলার ব্যারেলপ্রতি দাঁড়ায়। তেলের আয় দিযে শ্যাভেজ গরিবের ভাগ্যোন্নয়নে দৃষ্টি দেন। তাদের জন্য ১০ লাখ নতুন ঘর বানিয়ে দেন। দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠে চিকিৎসা কেন্দ্র। ঘরে ঘরে ল্যাপটপ ও ওয়াশিং মেশিন দেখা দিতে থাকে। ভেনিজুয়েলা সুখী গরিবের দেশে পরিণত হয়। শ্যাভেজ গরিবের প্রকৃত আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে তাদের অনেক কিছুই দিয়ে দেন। তার জনপ্রিয়তা যেমন বাড়তে থাকে তেমিন পাল্লা দিয়ে বাড়ে সরকারী অর্থের ব্যয়। শ্যাভেজ কফি থেকে কুকি পর্যন্ত সব খাবারের দাম বেঁধে দেন। দেশে এসব পণ্য উৎপাদন দেশীয় কোম্পানিগুলোর জন্য অলাভজনক হয়ে উঠলে তিনি তেলের টাকায় এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করেন। আখক্ষেত থেকে ডেইরি ফার্ম পর্যন্ত শত শত কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ব করেন। ডলারের দাম বেঁধে দেন এবং ডলার কেনা সীমিত করেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যেই নিহিত ছিল আজকের সঙ্কটের বীজ। এর সঙ্গে যোগ হয় তেলের দর পতন। তেলের আয় কমে যাওয়ায় ভেনিজুয়েলা আর আগের মতো আমদানি করতে পারছে না। ফলে সৃষ্টি খাদ্য ও অন্যান্য সঙ্কট। ভেনিজুয়েলার মানুষ আজ দুঃসহ জীবনযাপন করছে। বলিবারের দাম পড়ে যাওয়ায় তাদের প্রকৃত আয়ও গেছে কমে। সর্বত্র অভাব অনটন, দারিদ্র্য, অরাজকতা। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। তারা রাস্তায় নেমে আসছে। প্রেসিডেন্ট মাদুরো সেনাবাহিনীর সমর্থনেই টিকে আছেন। কিন্তু সেই সমর্থন কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। সেনাবাহিনী হয়ত নতুন কোন কুশীলবকে বেছে নেবে। পরিস্থিতিটা এমন যে, ভেনিজুয়েলা একটা বিস্ফোরণের মুখে। ধসে পড়ে শেষ হওয়ার মুখে।
×