ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদ ও ইব্রাহিমের লাশ পড়ে আছে মর্গে

উত্তরাঞ্চলে জঙ্গীকাণ্ডের মূল হোতা সুবাস এখনও ধরা পড়েনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩১ আগস্ট ২০১৬

উত্তরাঞ্চলে জঙ্গীকাণ্ডের মূল হোতা সুবাস এখনও ধরা পড়েনি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ উত্তরাঞ্চলে গত কয়েক মাসে যে ক’টি হত্যা ও হত্যার চেষ্টা এবং বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তার মূল পরিকল্পনাকারী (মাস্টারমাইন্ড) সুবাসের ডান হাত ছিল বগুড়ায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত কথিত জেএমবির উত্তরাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার খালেদ হাসান। নিহত আরেক সহযোগী আবু ইব্রাহিম রিপন রাজশাহীতে কথিত জেএমবির আদলে ‘আনসার রাজশাহী’ নামে আরকেটি সংগঠন দাঁড় করিয়েছিল। মাস্টারমাইন্ড সুবাসকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। মঙ্গলবার পর্যন্ত নিহত খালেদ হাসান ও আবু ইব্রাহিমের লাশ স্বজনরা নিতে আসেনি। এই দুই লাশ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের মর্গে আছে। পুলিশ জানিয়েছে, কথিত জেএমবির জঙ্গীরা নানা নামে, নানা ছদ্মবেশে দেশের বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিয়ে আছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিয়ে আছে সুবাস। পঞ্চগড় থেকে কুষ্টিয়া এবং টাঙ্গাইল পর্যন্ত কিলিংয়ের যত ঘটনা ঘটছে তার পরিকল্পনা করে সে। নিহত খালেদ, রিপনসহ অন্যান্য সহযোগীকে নিয়ে সে মাঠে নামত। তবে সামনে বেশি থাকত খালেদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় রাজশাহীর বাগমাড়া পাঠানপাড়ার রিপনের বাড়িতে। সেখানে সুবাস পরিকল্পনা করে কাজ ভাগ করে দেয় খালেদ হাসান, রিপন, নজরুল ইসলাম (বাইক হাসান), বাঁধন ও শরিফুল ইসলামকে। তারা রেজাউল করিমকে শালবাগান এলাকায় তার বাড়ির সামনে জবাই করে হত্যা করে। এই কিলিং গ্রুপের মধ্যে নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক হাসান কিছুদিন আগে রাজশাহীতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বাঁধন নিহত হয় ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় পুলিশের অভিযানে। রবিবার রাতে খালেদ হাসান ও রিপন বগুড়ায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মাস্টারমাইন্ড সুবাস ও আরেক সহযোগী শরিফুল ইসলামকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। পুলিশ জানায়, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। সুবাস নানা নামে ও নানা ছদ্মবেশে দেশের বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিয়ে আছে। সুবাস যে নামগুলো ব্যবহার করে : টাইগার, রাজিব গান্ধী, জাহাঙ্গির। এর বাইরে আরও নাম আছে বলে পুলিশের ধারণা। তার বাড়ি গাইবান্ধার বোনারপাড়ায়। সে ওষুধ বিক্রেতা, ফুটপাথের ভাসমান দোকানি, রিক্সাচালকসহ নানা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। তার বিচরণ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা দক্ষিণাঞ্চলের কুষ্টিয়া থেকে পূর্বাঞ্চলের টাঙ্গাইল পর্যন্ত। সে ঢাকাতেও যাচ্ছে। জানা যায় হলি আর্টিজানে হামলার মাস্টারমাইন্ড নিহত তামিমের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে তামিমসহ তিন জন নিহত হওয়ার পর সুবাসের অবস্থান কোথায় তা খুঁজছে পুলিশ। দেশের বিভিন্নস্থানে নানা ঘটনায় বিশেষ করে রংপুরে জাপানীকে হত্যা, পাবনায় ক্রিশ্চিয়ান যাজক হত্যা, রংপুরের কাউনিয়ায় খাদেম হত্যা, বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা হত্যা চেষ্টা, দিনাজপুরের কান্তজীর রাসমেলা ও ইসকন মন্দিরে বোমা হামলা, রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রীস্টান ব্যক্তিকে হত্যা, দিনাজপুরে ইতালির নাগরিককে হত্যা চেষ্টা, সৈয়দপুর মাজারে খাদেম হত্যা চেষ্টা, পঞ্চগড়ে মঠ প্রধানকে হত্যা, গাইবান্ধায় হিন্দু ব্যবসায়ী হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা, বগুড়া শিয়া মসজিদে হামলা করে মুসল্লি হত্যা, ঢাকায় কয়েক ব্লগার ও প্রকাশককে হত্যার প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে কথিত জেএমবি এবং কোন জঙ্গী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। দিনাজপুরের ঘটনায় খালেদ হাসানের নামে ৪টি মামলা হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, সুবাস ও খালেদ হাসান জেএমবি কর্মীদের অস্ত্র সরবরাহ করত এবং সুবাস যে পরিকল্পনা করত তা বাস্তবায়ন করত। ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার পাঁচ জনের মধ্যে বগুড়ার দুই জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর বগুড়ার কত জঙ্গী আছে সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। বগুড়ায় বন্দুকযুদ্ধে কথিত জেএমবির উত্তরাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার নিহত হওয়ার পর আরও একটি প্রশ্ন এসেছে তা হলো : বগুড়ায় জঙ্গীদের অস্ত্রের কোন ঘাঁটি আছে কিনা! গুলশানের জঙ্গী হামলায় পুলিশ প্রথম যে পাঁচজনের ছবি এবং পরিচিতি দিয়েছিল তার মধ্যে একটির পরিচয় ছিল ভুল। বগুড়ার দুইজনের একজন ধুনটের জঙ্গী শফিকুলের পরিচয় প্রথমে দেয়া হয়নি। পরে বগুড়ার দুই জঙ্গীরই পরিচয় দেয়া হয়। এদের একজন শাজাহানপুর উপজেলার বৃকুষ্টিয়া গ্রামের খায়রুজ্জামান (২২) ও ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ির চিথুলিয়ার শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (২০)। খায়রুল আরও দুই নামে পরিচিত পায়েল ও বাঁধন। জঙ্গীরা যে গোপনে থাকার কৌশল অবলম্বন করছে তা টের পাওয়া যায় গত ৩ এপ্রিল বগুড়ার শেরপুরের জোয়ানপুর কুঠিরভিটা গ্রামে একটি বাড়িতে বোমা বানাবার সময় বিস্ফোরিত হয়ে দুই জঙ্গী নিহত হওয়ার পর। ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল বোমা গ্রেনেড বানানোর বিপুল আধুনিক উপকরণ সরঞ্জাম এবং অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় নিহত দুই জঙ্গী রাসেলের বাড়ি ময়মনসিংহ ও তারেকের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। রাসেলের পরিচয় পাওয়া যায় ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর। চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনা হাটহাজারীতে বিপুল অস্ত্র মজুদের সঙ্গে জড়িত। মিজানুর রহমান নামের যে ব্যক্তি শেরপুরের গ্রামে সিএনজি অটোরিকশা চালকের পরিচয়ে বাড়ি ভাড়া নেয় পুলিশ এখনও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শেরপুরের গ্রামের এই ঘটনা পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় দেশের ভেতরে বিভিন্নস্থানে জঙ্গীরা নানা ছদ্মবেশে লুকিয়ে থেকে সন্ত্রাস করে যাচ্ছে। আরেকটি বড় প্রমাণ- গেল নবেম্বরের শেষে বগুড়ার শিবগঞ্জের চককানু হরিপুর গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের আল মোস্তফা জামে মসজিদের এশার নামাজের সময় মুসল্লিদের ওপর গুলি করে একজনকে হত্যা। এই ঘটনার কোন কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। বছর দুয়েক আগে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া এলাকায় একটি বাড়িতে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল আধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করে। এর মধ্যে লাইন মেশিনগানও ছিল। এই অস্ত্রগুলো থেকে পুলিশ ও র‌্যাব বিস্মিত হয়ে যায়, এত অস্ত্র তারা মজুদ করল কিভাবে! এই ঘটনায় পুলিশ আজও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অভিযানের সময় তারা জানালা ভেঙ্গে পালিয়ে যায়।
×