ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধরা স্বপ্ন নিয়ে আজ ফিরছেন শহীদ কাদরী

পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি...

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩১ আগস্ট ২০১৬

পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি...

মোরসালিন মিজান ॥ স্বপ্ন দেখার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল শহীদ কাদরীর। বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য সুন্দরের স্বপ্ন দেখেছেন। যুদ্ধের সঙ্গে ছিল যুদ্ধ। ভালবাসা দিয়ে গড়তে চেয়েছিলেন পৃথিবী। চেয়েছিলেন বলার কারণ- আর তিনি নেই! স্বপ্ন বুকে নিয়েই দীর্ঘকাল প্রবাসে কাটিয়েছিলেন। বিশ্বনাগরিকতার বোধ দ্বারা তাড়িত কবি মুহূর্তের জন্য স্বদেশ ভুলে থাকেননি। পরিশেষে বাংলায় ফিরতে চেয়েছিলেন। জীবদ্দশায় সম্ভব হয়নি। আজ বুধবার যখন ফিরছেন, তিনি কফিনবন্দী! কবিতাগুলো বলছে তার স্বপ্নের কথা। স্বপ্নগুলোই চেনা হয়ে গেলে চেনা হয়ে যায় কবিকেও! কেমন ছিল শহীদ কাদরীর স্বপ্ন? কী ছিল তাঁর ভাবনায়? উত্তর দেয় তাঁর অমর কবিতা, যেখানে কবি লিখে গেছেন- রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো/পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি/মাইক্রোফোনের বদলে বিহ্বল বকুলের ঘ্রাণ?/...জেনারেলদের হুকুম দেবেন রবীন্দ্রচর্চার? মন্ত্রীদের/ কিনে দেবেন সোনালী সোনালী গীটার/ব্যাঙ্কারদের বানিয়ে দেবেন কবিতার নিপুণ সমঝদার...। কবির এ শুধু নন্দনতত্ত্ব নয়, একান্ত চাওয়া বলেই মনে হয়। তাঁর স্বপ্নের পৃথিবীতে রক্তের খেলা নেই। ফুলের উৎসব। সে কথা জানিয়ে কবি লিখে যান- ক্যাপ্টেন, এবার তুমি চিৎকার করে ব’লে ওঠো ‘হ্যান্ডস আপ’/টলে-পড়া গোলাপ দাঁড়িয়ে পড়ুক তার ঝাঁড়ে,/হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাক ছুরি,/পলায়নপটু ঋতুরাজ দাঁড়াক দু’হাত তুলে/পুষ্পের সম্ভার নিয়ে পার্কে, পুকুর পাড়ে গরীবের পাড়াগাঁয়ে...। যুদ্ধে বিশ্বাস করতেন না। একদমই না। অস্ত্রের ঝনঝনানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। যুদ্ধে ক্ষতি আর ক্ষতি শুধু, সে কথা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন- আমাদের বধির করে মেশিনগান গর্জন করছে বারবার,/এক রত্তি ছোট্ট একটা চাবিঅলা দম-দেয়া ধূসরাভ ট্যাংক/একটা চারাগাছের চতুর্দিকে ঘুরপাক খেতে-খেতে/মাড়িয়ে দিলো কয়েকটা ফড়িং, পিঁপড়ে আর/অসংখ্য ঝংকারে ভরা তিনটে নীল ঝিঁঝিঁর শরীর...। একই চেতনা থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করেন- ভয় নেই/আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী/ গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে/মার্চপাস্ট ক’রে চলে যাবে/এবং স্যালুট করবে/ কেবল তোমাকে প্রিয়তমা...। হ্যাঁ, সেনার হাতে গোলাপ ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি! ভালবাসায়, কেবল ভালবাসায় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন প্রিয়তমাকে। অবশ্য প্রিয়তমা একই সঙ্গে দেশমাতৃকা। কবি লিখেছিলেন, ‘একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ/আমার কনিষ্ঠ আঙুলে...। সীমাহীন আবেগ বলে দেয় প্রিয় স্বদেশেই থাকতে চেয়েছিলেন কবি। সে কথা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘ইচ্ছে ছিলো কেবল তোমার নুন খেয়ে আজীবন/গুণ গেয়ে যাবে/অথচ কদ্দিন পরে বারান্দা পেরিয়ে/দাঁড়িয়েছি ঝোঁপে ...। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখার তিন বছর পর স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। ১৯৭৮ সালে দেশ ছাড়েন। তবু হৃদয়ের অনুভবে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দেশ। স্বীকারোক্তি করেছিলেন- ক্ষণকাল সে নকল স্বর্গলোকের আমি নতজানু রাজা/কানাকড়ির মূল্যে যা দিলে জীবনের ত্রিকূলে তা নেই/অচির মুহূর্তের ঘরে তোমারই তো উজ্জ্বল ঘরনী/ভ্রাম্যমাণেরে ফিরিয়ে দিলে ঘরের আঘ্রাণ...। ভ্রাম্যমাণ কবির নতুন ভ্রমণ শুরু হলো। মাটির সঙ্গে মিশে যাবেন সহসাই। তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অমর কবিতা। স্বপ্ন। কবি নিজেও যেন সে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন- ‘ভূগর্ভে, শিলার স্তরে, ধ্বংসস্তূপের তলায়/মানুষের মহৎ মৃত্যুর পর/মহত্তর অস্ত্রগুলো থেকে যায়...। মহত্তর অস্ত্র হয়ে কবির কবিতা থাকবে। স্বপ্নগুলো পাখা মেলবে। নিশ্চয়ই পাখা মেলবে!
×