ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে ও দেশে-দেশে লবিং করেও পারলেন না

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ আগস্ট ২০১৬

কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে ও দেশে-দেশে লবিং করেও পারলেন না

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বিপুল পরিমাণ অর্থের বন্যা বইয়ে দিয়ে এবং দেশে-বিদেশে লবিং চালিয়েও শেষ পর্যন্ত রেহাই পেলেন না জামায়াতে ইসলামীর টাকার কুমির হিসেবে পরিচিত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলী। সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা ছিল এই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নিষ্পত্তি জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা- তা নিয়ে। কারণ, রিভিউতে সবচেয়ে বেশি সময় পেয়েছিলেন এই আসামি। অবশেষে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির রায়ে নিশ্চিত হলো যে, ফাঁসির দড়িতে ঝোলা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মীর কাশেম আলীর দ- বহাল থাকায় মঙ্গলবার চট্টগ্রামে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আনন্দ পরিলক্ষিত হয়। বেরিয়ে পড়ে আনন্দ মিছিল এবং হয় মিষ্টি বিতরণ। উঠে আসে যত দ্রুত সম্ভব দ- কার্যকরের দাবি। মীর কাশেম আলীর বাড়ি চট্টগ্রামে না হলেও তার বেড়ে উঠা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগই চট্টগ্রামে। টিএ্যান্ডটিতে পিতার চাকরির সুবাদে তার চট্টগ্রামে আসা। তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে বিশেষ বাহিনী, যার কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, তাদের আত্মীয়স্বজন ও মুক্তির সংগ্রামে সক্রিয় নেতাকর্মীদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। তার টর্চার সেল ছিল ‘ডালিম হোটেল’। নগরীর নন্দন কানন এলাকার টেলিগ্রাফ সড়কে চন্দ্র মোহন নাথের মালিকানার ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে ওই ভবনটির নাম দেয়া হয়েছিল ডালিম হোটেল। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে নির্মিত সেই পুরনো ভবনটি এখন জরাজীর্ণ। তবে ধারণ করে আছে অনেক বেদনার স্মৃতি। একাত্তরে যারা ওই সেলে নির্যাতিত হয়েছিলেন তারা এবং তাদের স্বজনরা এখনও ভবনটির পাশ দিয়ে যেতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। খুব স্বাভাবিক কারণেই রিভিউর চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম গণজাগরণ মঞ্চের একটি মিছিল ছুটে যায় মহামায়া ভবনের দিকে। সে মিছিলে যোগ দেন নারী নেত্রী নুরজাহান খান, গণজাগরণ মঞ্চের সদস্য সচিব চন্দন দাশ ও সমন্বয়কারী শরীফ চৌহান, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সহ-সভাপতি সুনীল ধর, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান এবং চট্টগ্রামের প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তারা যত দ্রুত সম্ভব এ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর এবং তার সম্পদ বাজেয়াপ্তের দাবি জানান। এছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত-শিবিরকে আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবিও জানানো হয়। ১৯৭১ সালে এই মহামায়া ভবনে মীর কাশেম আলীর বাহিনী নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ৮ জনকে। রিভিউ অর্থাৎ একেবারে চূড়ান্ত রায়ে এ জসিম হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- বহাল রাখে আদালত। এই রায়েই মীর কাশেম আলীকে ঝুলতে হবে ফাঁসির দড়িতে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনের মামাত বোন হাসিনা খাতুন মীর কাশেম আলীর মামলায় সাক্ষ্য দেন আদালতে। রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ন্যায় বিচার পেয়েছি। জসিমকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়েছিল মীর কাশেম আলীর বাহিনী। বুকের ওপর এতদিন বড় একটি পাথর ছিল। মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকর হলে সেই পাথর সরে যাবে। মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আরেক সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন জয়বাংলা বাহিনীর উপ-প্রধান মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকালে রোজার ঈদে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে আল বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। ডালিম হোটেলে ২৩ দিন আটকে রেখে তার উপর চালানো হয়েছিল অমানুষিক নির্যাতন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ সেই হোটেল ভেঙ্গে তাকে ছাড়িয়ে এনেছিল। একই দিনে ওই ভবন থেকে ছাড়া পান আরও অনেকে। মীর কাশেম আলীর বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমের ভাই মুক্তিযোদ্ধা দস্তগীর চৌধুরীকেও (বিএনপি নেতা) ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তার উপরও চলেছিল নির্যাতন। রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আজ আমার ঈদের দিন। তবে দুর্ভাগ্য যে আমার মা ও ভাই এই বিচার দেখে যেতে পারলেন না। মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আদালতে আরেক সাক্ষী সৈয়দ এমরান। তার চাচাত ভাই জামাল উদ্দিন ও সরোয়ার উদ্দিনও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। রায় শোনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, একাত্তরের ৩০ নবেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও এলাকা থেকে তাকেসহ ৬ ভাইকে ধরে নিয়ে যায় আল বদর বাহিনী। ডালিম হোটেলে আটকে রেখে দিনের পর দিন শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। কোন কিছু খেতে দেয়া হতো না, এমনকি পানি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এ রায় দ্রুত সম্ভব কার্যকর করা হোক। এতে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। এদিকে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেয়ার দাবি জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। নির্যাতনের সাক্ষী ডালিম হোটেলকে মুক্তিযুদ্ধ স্মতি জাদুঘর বানানোর দাবিও সংসদের। সংগঠনের চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার মোঃ সাহাবউদ্দিন বলেন, আদালতের রায়ই বলেছে, ডালিম হোটেল ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বা মৃত্যুর কারখানা। এই ভবনটি স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। তিনিও বলেন, এই জল্লাদের ফাঁসি যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর হোক এটাই চান মুক্তিযোদ্ধারা।
×