ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে ২২ ট্যানারির সবই বন্ধ

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৩১ আগস্ট ২০১৬

চট্টগ্রামে ২২ ট্যানারির সবই বন্ধ

আহমেদ হুমায়ুন, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে চামড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলো (ট্যানারি) একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোরবানির ঈদে উৎপাদিত চামড়া নিয়ে অনিশ্চতার মুখে পড়েছেন চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারির সবকটিই এখন বন্ধ। কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জটিলতায় এখানে ক্রমাগত কমছে চামড়ার দাম। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে চামড়ার দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ইটিপি বাস্তবায়ন না করার অভিযোগে সর্বশেষ চলতি বছর শেষ দুটি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বিপাকে পড়েছেন। ফলে এক সময়কার চট্টগ্রামনির্ভর চামড়া শিল্প বর্তমানে অনেকটাই ঢাকানির্ভর হয়ে পড়েছে। দুই দশক আগেও যেটি চামড়া শিল্পের উর্বর ভূমি ছিল, মাত্র অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে সে চট্টগ্রামেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রফতানিমুখী শিল্পটি। ক্রমাগত দাম কমতে থাকায় এবার কোরবানির ঈদে ভারত ও মিয়ানমারে চামড়া পাচার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। সারাদেশের উৎপাদিত কাঁচা চামড়ার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ হয় চট্টগ্রামে। বছরের পর বছর চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারি এসব কাঁচা চামড়া কিনে তা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতসহ রফতানিতে নিয়োজিত ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার নিম্নমুখী দর ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পেরে লোকসানে পড়ে ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ২০টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা নির্ভর হয়ে পড়ে অবশিষ্ট দুই ট্যানারির ওপর। চট্টগ্রামের মোট চামড়ার প্রায় ৭০ শতাংশ কিনে নিত এ দুটি কারখানা। কিন্তু ইটিপি বাস্তবায়ন না করায় চলতি বছর অবশিষ্ট দুই ট্যানারিও বন্ধ করে দেয় পরিবেশ অধিদফতর। সর্বশেষ গত ১ আগস্ট বন্ধ করে দেয়া হয় রিফ লেদার। এতে মারাত্মক বেকায়দায় পড়েছে চট্টগ্রামের প্রায় তিন শ’ আড়তদার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী। কারণ বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৭০ শতাংশ চামড়া কিনে নেয় এ দুটি ট্যানারি। সর্বশেষ এ দুটি ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবার কোরবানির ঈদে উৎপাদিত চামড়া ভারত ও মিয়ানমারে পাচার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া কেনাবেচা হয়। আর কোরবানির মৌসুমে চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ছয় লাখ। প্রতি বছর শুধু কোরবানির ঈদেই প্রায় ৪০ কোটি টাকার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। সারা বছর কেবল চট্টগ্রাম থেকে চামড়া শিল্পে অবদান প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। আর সারাদেশে চামড়া শিল্প থেকে রফতানি আয়ের পরিমাণ ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের মোট চামড়া শিল্পের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের যোগান আসে চট্টগ্রাম থেকে। অথচ এ অঞ্চলে চামড়া শিল্পের প্রচুর কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ট্যানারি শিল্প না থাকায় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের ওপর নির্ভর করতে হয় এখানকার ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ট্যানারি মালিকরা চামড়া না কেনায় বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, স্থানীয় ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করলে নগদ মূল্য পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকায় চামড়া বিক্রি করতে গেলে কম দামে কিংবা অর্ধেক বাকিতে বিক্রি করতে হয়। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা, যে কারণে এবার কোরবানিতে চামড়া সংরক্ষণ ও দাম নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কাঁচা চামড়ার আড়তদার খোরশেদ আলম জানান, চট্টগ্রামের প্রায় তিন শ’ আড়তের গুদামের মধ্যে প্রতিটিতে এখনও ৪০০-৫০০ পিস চামড়া মজুদ রয়েছে। কিন্তু কোন ক্রেতা নেই। ঢাকার কয়েকটি ট্যানারির সঙ্গে আলোচনা করা হলেও তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার কারণে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে গড়িমসি করছেন। একদিকে ট্যানারি মালিকদের গড়িমসি, অপরদিকে দাম কমতে থাকায় অনেক আড়তদার চামড়া কিনতে আগ্রহী নন বলে তিনি জানান। আড়তদাররা জানান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ তিন পার্বত্য জেলার কাঁচা চামড়া নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় অবস্থিত প্রধান পাইকারি বাজারে সংগ্রহ করা হয়। ফড়িয়ারা বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া কিনে পাইকারি বাজারে নিয়ে আসে। স্বাভাবিক অবস্থায় দৈনিক এক হাজার গরু ও মহিষের চামড়া এবং তিন-চার হাজার ছাগলের চামড়া বেচাকেনা হয়। সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের মনসা পূজা উপলক্ষে বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রায় ৭০ হাজার পিস চামড়া পাওয়া গেছে। কোরবানির সময় চট্টগ্রামে চার লাখ গরুর চামড়া, প্রায় দুই লাখ ছাগলের চামড়া ও ১০-১২ হাজার মহিষের চামড়া সংগ্রহ হয়ে থাকে। বিপুল পরিমাণ চামড়া সংগ্রহের বিপরীতে এখানে কোন ট্যানারি নেই। ফলে কাঁচা চামড়া নিয়ে আমাদের ঢাকার ট্যানারি মালিকদের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে। একদিকে চট্টগ্রামে ট্যানারি না থাকায় কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে, অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় কাঁচা চামড়া কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছেন আড়তদাররা। কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি সূত্রে জানা যায়, এবার প্রতিটি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ ২০০-২২০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
×