ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রদত্ত সহায়তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক তত্ত্বাবধান প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৩১ আগস্ট ২০১৬

প্রদত্ত সহায়তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক তত্ত্বাবধান প্রয়োজন

আমি ও সহযোগী সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূঁইয়া আর্থিক অধিদর্শন, বৈদেশিক সাহায্যের তত্ত্বাবধান ও ফলশ্রুতিতা সম্পর্কিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ষষ্ঠ ওয়েস্ট মিনিস্টার কর্মশালায় ২০১৬ সালের ৪ থেকে ৭ জুলাই বাংলাদেশ সংসদের তরফ থেকে অংশগ্রহণ করেছি। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট গণতন্ত্রের কার্যকরণ সূত্র অনুযায়ী প্রসারণের লক্ষ্যে মূলত কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে গত ছয় বছর ধরে ওয়েস্ট মিনিস্টার কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। এই বছরের কর্মশালায় কমনওয়েলথের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটিসমূহের সমিতি, যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, অর্থনৈতিক সহযোগী উন্নয়ন সংগঠন, আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক, সাহায্যের ফলশ্রুতিতা বিষয়ক যুক্তরাজ্যের স্বাধীন কমিশন, বিদেশী উন্নয়ন ইনস্টিটিউশন, যুক্তরাজ্যের সাহায্য নেটওয়ার্ক ও জাতীয় নিরিখ অফিস এবং সুইডেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ইনস্টিটিউশন অংশগ্রহণ করে। কমনওয়েলথভুক্ত এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মোট ৩১টি দেশ থেকে ৭৩ জন সংসদ সদস্যের অংশগ্রহণ এই বছরের কর্মশালাটিকে গুরুত্ব প্রদান করে। ১৮টি অধিবেশনে এই কর্মশালাটি সমাপ্ত হয়। এইসব অধিবেশনে অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে বিদেশী সাহায্যের ফলশ্রুতিতার তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়। সাহায্যের স্থাপনার মধ্যে আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তার সঙ্গে ব্যক্তি খাতের অন্তপ্রবাহ ও বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকসমূহের ঋণ সাহায্য অন্তর্ভুক্তকরণ বিবেচনা করা হয়। টেকসই উন্নয়নে সহায়তা প্রদানকারী দেশসমূহের মৌল কৌশলের মধ্যে জাতীয় কার্যক্রম সমন্বিত করার প্রক্রিয়ায় সংসদসমূহের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করা হয়। সহায়তামূলক ব্যয় ব্যবহারকরণের ওপর প্রতিটি সংসদের তত্ত্বাবধানের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ ও বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমনের মৌল কৌশল পর্যালোচনা করা হয়। জাতীয় বাজেটে বিদেশী সাহায্যের অন্তর্ভুক্তি এবং সার্বিকভাবে এসব ক্ষেত্রে সংসদীয় তথ্য বীক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়। এই কর্মশালায় সংসদের জন্য সংসদীয় বাজেট অফিস স্থাপন করার প্রস্তাব দেয়া হয় এবং জাতীয় জরুরী পরিস্থিতিতে সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটির ভূমিকাকে শনাক্ত ও পরিব্যাপ্ত করার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করা হয়। পাশাপাশি মুখ্য প্রকল্পসমূহ নিরিখ করার পথ-নির্দেশিকা আলোচিত হয় এবং সাহায্য দেয়া ও ব্যবহার করার প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আমি ও মেজর জেনারেল ভূঁইয়া (অব) বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করে এসব বিষয়ের প্রতি কমনওয়েলথের দেশসমূহের সংসদ সদস্যের এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণা সাহায্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এই কর্মশালায় অন্যদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের হাউজ অফ লর্ডসের সদস্য লর্ড ব্রুস ও লর্ড চিজি, হাউজ অফ কমন্সের সদস্য হেলেন গুডম্যান, স্টিফান হ্যামোনড, মেঘ হিলিয়ার, আইয়ান লিড্ডেল গ্রেন্ডার ও এন্ডু মিচেল, যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরিখ সংগঠনের পরিচালক টম ম্যাকডোনাল্ড, তিউনিসিয়ান সংসদের সদস্য ওলফা সুকরী শেরীফ এবং যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের উপমন্ত্রী ব্যারনেস সন্দ্বীপ বর্মা অংশগ্রহণ করেন। ২০০৫ সালে প্যারিসে সাহায্য ফলশ্রুতিতার কর্মসূচী সম্পর্কিত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর পরে ঘানার আক্রাতে ২০০৮ সালে কার্যক্রমের বিষয়সূচী নির্ধারণের লক্ষ্যে প্যারিসে সম্মেলনে উপনীত ঐকমত্যের কার্যক্রম পরিশীলিত হয়। এই দুটি সম্মেলনের পর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সভা সম্মেলনে বিদেশী সহায়তায় ফলশ্রুতিতা ও নিপুণতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে সাংসদদের ভূমিকা স্বীকৃতি লাভ করে এসেছে। একই সূত্র অনুসরণ করে ২০১৬ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পোষকতায় এই ষষ্ঠ ওয়েস্ট মিনিস্টার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ পৃথিবীব্যাপী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিচয় বিধৃত ও গ্রহণ করে। এরপর একই বছরের ডিসেম্বরে প্যারিসে সম্পাদিত জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে টেকসই উন্নয়নের চুক্তি লক্ষ্য নিচয় সমর্থন লাভ করে ও পরিশীলিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে পৃথিবীব্যাপী জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিচয় অর্জনে জাতীয় কার্যক্রমের পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকে। টেকসই উন্নয়নের ওপর জাতিসংঘের ২০১৬-এর শেষদিকে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের আগে ইথওপিয়ার আদিস আবাবায়ে উন্নয়নের জন্য অর্থ সংস্থান শীর্ষক সম্মেলনে উন্নয়ন অর্থায়নে সমকালীন অপ্রতুলতা, তা বাড়ানোর প্রয়োজন এবং একই লক্ষ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ প্রসারণের ওপর জোর দেয়া হয়। আশা করা হয়, বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তায় অন্তপ্রবাহের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়ানোর উৎসাদি অধিকতর কার্যকর করা হবে। এই কর্মশালায় কমনওয়েলথের সংসদীয় সমিতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সমিতি কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত ৫৩টি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে কাজ করে আসছে। তাদের কাজের মাধ্যমে কমনওয়েলথের দেশসমূহের সংসদ সদস্যরা গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কর্মশালায় উপস্থাপিত ও আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ১৯৭০ সালে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্যের পরিমাণ সাহায্যদাতা দেশসমূহের মোট জাতীয় আয়ের ০.০৭% উন্নীতকরণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত। দেখা গেছে, ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট ৭টি দেশ যথা : সুইডেন, নরওয়ে, লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের মোট জাতীয় আয়ের ০.০৭% দরিদ্র দেশসমূহে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে দিয়েছে। এরূপ উন্নয়ন সহায়তার মধ্যে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক গ্রহীতা দেশকে অনুদান ও বাজারদর থেকে নি¤œ সুদহার সংবলিত ঋণ গ্রহীতা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও কুশলসাধনে প্রযুক্ত। এর মধ্যে অসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত অনুদান বা ঋণ, বেসরকারী বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংক থেকে প্রদত্ত ঋণ সহায়তা অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুরূপ মাত্রায় বৈদেশিক সাহায্য দেয়ার দেশসমূহের তালিকায় সুইডেন মোট জাতীয় আয়ের ১.৩% সহায়তা দিয়ে সবচেয়ে ওপরে অবস্থান করছে। এরপর রয়েছে নরওয়ে, যে দেশ তার মোট জাতীয় আয়ের ১% অনুন্নত দেশসমূহের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে দিয়ে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য তার মোট জাতীয় আয়ের ০.০৭% এমনি বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে দিয়ে আসছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ০.০৭% বিদেশী সাহায্য হিসেবে দরিদ্র দেশে দেয়া শুরু করেছে। তবে এই বিদেশী সহায়তার মধ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ, অসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাহায্য তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলি যে, ১৯৭০ সালে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি আনুষ্ঠানিক সহায়তা দেয়ার অঙ্কে বিবৃত। এই সহায়তার মধ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ বা অসরকারী প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তা অন্তর্ভুক্ত করে সার্বিক সহায়তার অঙ্কে গোঁজামিল দেয়ার কোন অবকাশ নেই। উন্নত দেশসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ন্যূনপক্ষে ০.০৭% বিদেশী সাহায্য হিসেবে দিয়ে এ বিষয়ে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা বিধেয় হবে। আমার এ বক্তব্য অন্যান্যের মধ্যে সুইডেনের সংসদ সদস্য মারিয়া এন্ডারসন উইলিয়াম এবং ভারতের প্রতিনিধি লোকসভার সদস্য ভারুতাহারী মাহতাব ও আফ্রিকার প্রতিনিধিরা সমর্থন করেন এবং সকলে বলেন যে, বিদ্যমান প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট উন্নত দেশসমূহ থেকে উন্নয়নশীল দেশে সহায়তা বাড়ানোর নৈতিক ও অর্থনৈতিক যুক্তি অনুসরণের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমি বলেছি যে, অনুন্নত দেশসমূহের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রসারিত হবে। এর ফলশ্রুতিতে উন্নত দেশসমূহ সারা বিশ্বে প্রবৃদ্ধি প্রসূত আয় বা উপযোগ লাভ করবে। আমি বলেছি যে, বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা বাড়িয়ে এবং আঞ্চলিক সংঘাত যথাসম্ভব কমিয়ে সার্বিকভাবে অনুৎপাদনশীল ব্যয় কমাতে পারলে সকল দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে। এই প্রেক্ষিতে উন্নত দেশসমূহ থেকে উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রদানীয় সাহায্যের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ানো হলে সকল দেশের জন্য কল্যাণকর হবে বলে আমি মত প্রকাশ করি। আমি এও বলি যে, সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিচয় বাস্তবায়ন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু সম্পর্কিত সম্পাদিত চুক্তির আলোকে পৃথিবীব্যাপী সব দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য জোরদার করা ও প্রসারণ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কর্মশালায় যুক্তরাজ্যের সাহায্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে বলা যায় যে, সাম্প্রতিককালে উন্নয়ন দেশসমূহ কর্তৃক অনুন্নত দেশসমূহে প্রদত্ত সাহায্য দেয়া বা ব্যবহার করার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যুক্তরাজ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হয় যে, বিদিত দুর্নীতি দূর না করা গেলে উন্নত দেশসমূহের করদাতাগণ উন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিক সহায়তা বৃদ্ধির প্রস্তাব বা কার্যক্রম সমর্থন করবে না। এরই প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যের সাংসদগণ বলেন, উন্নত দেশসমূহকে প্রদত্ত সহায়তা ব্যবহারের ওপর গ্রহীতা দেশের সাংসদের অধিকতর অধিদর্শন ও তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। উন্নত দেশ হতে প্রাপ্তব্য সহায়তা ব্যবহারের ওপর সংসদীয় তত্ত্বাবধান পরিবর্ধন করা যুক্তিযুক্ত বলে তাদের এই অবস্থান আমি সমর্থন করি। আমি এও বলি যে, সংসদীয় তত্ত্বাবধান এক্ষেত্রে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের যথাযথ দায়িত্ব পালনের বিকল্প উপায় নয়। সংসদীয় তত্ত্বাবধান এক্ষেত্রে বিদেশী সহায়তার যথাযথভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্পূরক মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে বলে আমি মত প্রকাশ করি । সাহায্য কার্যক্রমে দুর্নীতি রোধকরণের বিষয়ে আমি বলি যে, উন্নত দেশসমূহ হতে প্রদত্ত আনুষ্ঠানিক সাহায্য অনুন্নত দেশসমূহে ব্যবহারকারী পর্যায়ে সৃষ্ট দুর্নীতি দৃঢ়ভাবে সাহায্যদানকারী ও গ্রহণকারী উভয় দেশের তরফ থেকে দমন করা প্রয়োজন হবে। এই প্রক্রিয়ায় অনুন্নত দেশসমূহের স্বৈরশাসকগণ বা তাদের সহযোগীরা উন্নত দেশে তাদের দেশ থেকে লুণ্ঠন করে যে সম্পদ পাচার করেছে তা উন্নত দেশের তরফ হতে যথাযথভাবে পরিবীক্ষণের মাধ্যমে শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অনুন্নত দেশে ফিরিয়ে দেয়া সঙ্গত হবে। আমি এও বলি যে, ভিয়েতনামের নাগো দিন দিয়েম হতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের ও আফ্রিকায় এককালীন স্বৈরশাসকগণ তাদের দরিদ্র দেশে প্রদত্ত বিদেশী সাহায্য, এমনকি তাদের দেশীয় সম্পদ আত্মসাত করে উন্নত দেশসমূহে গচ্ছিত রেখেছে। এসব সম্পদ সংশ্লিষ্ট দরিদ্র দেশে ফিরিয়ে দিলে সাহায্য ব্যবহারকরণের প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট দুর্নীতি অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে এবং দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি থেকে দূরে সরে যাবে। এই প্রসঙ্গে আমি সুস্পষ্টভাবে বলি যে, আমরা পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের দেশ থেকে সাবেক স্বৈরশাসক ও তার সহযোগী ও উত্তরসূরিরা সংশ্লিষ্ট উন্নত দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে সেই দেশে তাদের পাচারকৃত সম্পদ ভোগ করছে। এসব স্বৈরশাসককে উন্নত দেশে আশ্রয় না দিয়ে বা আশ্রিত স্বৈরশাসক বা তাদের উত্তরাধিকারীদের আয়ের উৎসাদি ভালভাবে পরিবীক্ষণ করলে উন্নত দেশ হতে প্রদত্ত সহায়তা ও সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের সম্পদ সকলের সুষ্ঠু ব্যবহারকরণে ইতিবাচক হবে। কর্মশালায় বৈদেশিক সহায়তা প্রদান ও ব্যবহারকরণে অধিকতর স¦চ্ছতা আনার উপর জোর দেয়া হয়। বলা হয় যে, আক্রা সম্মেলনে এই উদ্দেশ্যে গ্রহণীয় কার্যক্রমের সূচী এবং পরবর্তীকালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান সম্মেলনে অধিকাংশ বড় সহায়তাকারী দেশ কর্তৃক সহায়তা প্রদান প্রক্রিয়া স¦চ্ছকরণের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এক্ষেত্রে বা লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশী সহায়তা প্রদানের মোড়কে যাতে দাতা দেশসমূহের সামরিক বা রাজনৈতিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য লুক্কায়িত না থাকে তার প্রতি দাতা ও গ্রহীতা উভয় দেশসমূহকে সচেতন থাকতে হবে। এই প্রেক্ষিতে আমি বলি যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপকে পুনর্গঠন করার জন্য মার্শাল পরিকল্পনার আওতায় যেভাবে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল সেভাবে অনুন্নত দেশের পুনর্গঠনে উন্নত দেশসমূহ হতে দ্বিপাক্ষিক বা সামষ্টিক জন-উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক স¦চ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সমকালীন যুগে দাবি হয়ে উঠেছে। কর্মশালায় অন্য অংশগ্রহণকারীরা সাহায্য দেয়া ও নেয়ার প্রক্রিয়ায় দাতা ও গ্রহীতার জন্য প্রয়োজনীয় বা তাদের থেকে উৎসারিত সকল তথ্য উপাত্ত প্রকাশ ও লভ্য করার ওপর জোর দেন। এভাবে প্রাপ্ত উপাত্তের আলোকে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সংসদ সদস্যরা ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম বলে সকলে একমত হন। সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার ভিত্তিতে এই কর্মশালায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গৃহীত হয় : ১. সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেন যে, বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক সাহায্য ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সাংসদদিগকে অধিকতর সচেতন ও তৎপর হতে হবে। ২. এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সংসদসমূহকে রাষ্ট্রের মৌল প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীনভাবে ও স¦চ্ছতার সঙ্গে সব প্রকার সাহায্য, প্রস্তাব ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত এই প্রক্রিয়ায় গ্রহীতা দেশসমূহ উন্নত দেশসমূহ হতে সঞ্চালিত ঋণভিত্তিক অর্থায়ন এবং গৃহীতব্য জাতীয় ঋণের সময় ব্যাপ্ত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা বিধেয় হবে। ৩. বিদেশী সহায়তা সংবলিত সরকারের বাজেট স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করার জন্য সংসদের পৃথক বাজেট অফিস প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং অসরকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিদেশী সহায়তার অন্তপ্রবাহ সংসদের তত্ত্বাবধানে আনা যুক্তিযুক্ত হবে। এসব ক্ষেত্রে সংসদের স্থায়ী বা বিশেষ কমিটিসমূহকে অধিকতর তৎপর করা বিধেয় হবে। এক্ষেত্রে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ রোধকরণে সংসদের তরফ থেকে সাহায্য ব্যবস্থাপনায় অধিকতর তৎপর থাকতে হবে। ৪. টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে সংসদসমূহকে সুশীল সমাজ, বেসরকারী খাত ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সরকারের উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে ব্যক্তি খাতকে সংশ্লিষ্ট করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ষষ্ঠ ওয়েস্ট মিনিস্টার কর্মশালা ৭ জুলাই ২০১৬ তারিখে সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ও সহযোগিতার আবহে সমাপ্ত হয়। আশা করা যায়, এই ধরনের কর্মশালায় এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুষ্ঠিতব্য এসব বহুজাতিক সম্মেলনে এই কর্মশালায় উত্থাপিত মতামত ও ব্যক্ত ঐকমত্য ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কিত শীর্ষ সম্মেলনে যথাযথভাবে বিবেচিত হবে। একবিংশ শতাব্দীর এই প্রথম পঞ্চমাংশে এসে সকল দেশের নাগরিকদিগকে বিশ্বজনীন সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতার নিরিখে নিজেদের বিবেচনা করতে হবে। সমকালের বিশ্বের এক প্রান্তের দুর্যোগ অন্য প্রান্তে প্রভাব বিস্তার করে। এক এলাকার নৈরাজ্য অন্য এলাকায় স্থিতিশীলতা বিনষ্টকরণে উপকরণ যোগায়। তেমনি এক দেশের প্রবৃদ্ধি অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারণের ওপর নির্ভরশীল থাকে। এ প্রেক্ষিতে সকল দেশে গণতান্ত্রিক সরকার বিশ্বজনীন উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনে সহযোগী হয়। তাই জনপ্রতিনিধিদের মাঝে সহযোগিতার মনোভাব প্রসারণ করার লক্ষ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বা সংসদ সদস্যদিগকে কাজ করতে হবে। এই প্রেক্ষিতে ওয়েস্ট মিনিস্টার কর্মশালার ন্যায় পারস্পরিক মতবিনিময় ও সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে বিস্তৃতভাবে আলোচনার নিলয় গড়ে তোলা ও বিস্তৃত করা সকল দেশের সাংসদদের জন্য সঙ্গত হবে। আমার ধারণা ও আশা ষষ্ঠ ওয়েস্ট মিনিস্টার কর্মশালায় যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে তারা এই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×