ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুহীন প্রাণ এক কবির মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৩১ আগস্ট ২০১৬

মৃত্যুহীন প্রাণ এক কবির মৃত্যু

কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কে যখন কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় তখনও সে গুরুতর কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং হুইল চেয়ারে তার চলাফেরা। তার স্ত্রী নীরা তাকে একদিন রুটিন চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। আমিও তখন একটু অসুস্থ ছিলাম। নীরা বললো, চলুন চাচা, আপনাকেও ডাক্তার দেখাই। নীরা বাংলাদেশের প্রয়াত বামপন্থী নেতা দেওয়ান মাহবুব আলীর মেয়ে। শহীদের দ্বিতীয় স্ত্রী, আমাকে চাচা বলে ডাকে। যদিও শহীদ আমাকে ডাকে গাফ্্ফার। তুমি সম্বোধন। এবং আমরা দীর্ঘকালের বন্ধু। সেদিন নীরাদের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। শহীদ এবং আমি দুজনেই ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে উঠেছি (নীরাই আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজেদের বাসায় চলে যাবে) তখন সে বলে উঠলো, “জানো দোস্ত, আমরা বিমানে শূন্যে ওড়ার জন্য এয়ারপোর্টে বসে আছি। আমরা এখন প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে। কার কখন ডাক পড়বে জানি না।” শহীদ কাদরী আমার চাইতে অন্তত সাত আট বছরের ছোট। তাই তার কথা শুনে বলেছিলাম, বয়সের বিবেচনায় তোমার আগেই আমার যাওয়ার কথা। শহীদ বললো,“না দোস্ত, না। আমি আজ দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হার্ট ইত্যাদি নানা রোগে ভুগছি। সপ্তাহে দু’বার ডায়ালিসিসের জন্য যাই। হাঁটাচলা করতে পারি না, নীরার সেবা-শুশ্রƒষায় বেঁচে আছি। যে কোনো সময় চলে যেতে পারি। তোমার তো সে অবস্থা নয়।” শহীদের এই কথাটাই সত্য হয়েছে। গত সোমবার (২৯ আগস্ট) লন্ডনে বসে শুনলাম, তার আগের দিন নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। সে আমার ওবিচুয়ারি নয়, আমি তার ওবিচুয়ারি লিখছি। নিউইয়র্কে ওই দেখা হওয়ার পর তার সঙ্গে সম্ভবত আমার আর দেখা হয়নি। তবে টেলিফোনে কথা হয়েছে বহুবার। প্রথম দিকে নীরার বাসাতেও গেছি একাধিকবার। শহীদ কাদরী আমেরিকায় গিয়ে প্রথম থাকত বোস্টনে। সেখানেই দীর্ঘ কয়েক বছর আগে সে অসুস্থ ও চলৎশক্তিরহিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তরুণী নীরা তাকে ভালোবেসে বিয়ে করে তার নিউইয়র্কের বাসায় নিয়ে আসে। তার সেবাযতেœই শহীদ এতোকাল বেঁচে ছিল। এমন একজন অসুস্থ কবিকে কেউ শুধুমাত্র তার কবিতা পড়ে মুগ্ধ ভালোবাসার জন্য বিয়ে করতে পারে এবং বছরের পর বছর নিজের এবং সংসারের কাজকর্মের মধ্যেও অসুস্থ মানুষটির চব্বিশ ঘণ্টা দেখাশোনা করতে পারে, এটা নীরাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বে¡ও শহীদ ও নীরার মধ্যে মনের মিল হওয়ার বড় কারণ সম্ভবত ছিল দুজনেই দ্রোহী মনোভাবের মানুষ। শহীদ কাদরী আধুনিকতম কবি (উত্তর আধুনিক নয়) এবং দীর্ঘকাল প্রবাস জীবন যাপন করলেও দেশ ও সমাজ ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তা তার কবিতায় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রƒপাত্মক মনোভাব থেকে বুঝা যায়। নীরাও মুক্তমননের নারী। তার বাসা রেডিকেল বই পুস্তকে ঠাসা। আমাকেও সে মাঝে মাঝে এসব বইপত্র পাঠাতো। শহীদের মৃত্যুতে আমি শোকাহত। কিন্তু তার চাইতেও উদ্বিগ্ন নীরার জীবনটা এখন কিভাবে কাটবে তা ভেবে। শহীদের সঙ্গে আমার কবে পরিচয়? পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তো বটেই। শহীদও পঞ্চাশের দশকের কবি। সম্ভবত এখন পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশের প্রধান কবিদের একজন বলা যায়। তার কবিতা নিয়ে এখন আলোচনায় যাব না। এই বিয়োগ ব্যথায় আচ্ছন্নতা কাটলে তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এই আলোচনা হওয়া উচিৎ। শহীদ লিখেছে কম, যুবা বয়সেই দেশ ছেড়েছে। অভিমান করে বহুকাল কিছুই লেখেনি। মাঝে মধ্যে দু’একটা যা লিখেছে তাতেই তার বিস্ময়কর প্রতিভা ও মেধার বিচ্ছুরণ দেখা গেছে। পঞ্চাশের দশকের সেই মাঝামাঝি সময়ে মাসিক ‘সওগাতের’ আমি ছিলাম নির্বাহী সম্পাদক। মাথার উপরে সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন তো ছিলেনই। পুরনো ঢাকায় পাটুয়াটুলিতে (লয়াল স্ট্রিট) সওগাত অফিসে তখন প্রায় প্রতিদিন প্রগতিপন্থী তরুণ সাহিত্যিকদের আড্ডা জমতো। আসতেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রাবেয়া খাতুন এবং আরো অনেকে। এই আসরেই সবচাইতে কম বয়সী কিশোর কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। যদিও বয়সে কিশোর, দেখতে গোলগাল এবং গাট্টাগোট্টা বলে তাকে একটু বেশি বয়সের মনে হত। তাই প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হতেই একদিন যখন সে আমাকে জানাল, তার বয়স ষোল, তখন আমি বিশ্বাস করিনি। সওগাতে ছাপার জন্য সে আমাকে যে কবিতাটি দিয়েছিলো, তাতে এতোটাই আধুনিকতা ও পরিপক্ক মননের ছাপ ছিলো যে, তা একজন কিশোর কবির লেখা বলে বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই আমার ভুল ভাঙে। মনে হলো কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কিশোর কবি শহীদ কাদরীও মননে ও প্রজ্ঞায় অনেক আগেই কৈশোর পেরিয়ে এসেছে। যদিও শহীদ কাদরী সুভাষ-সুকান্ত ধারার কবি ছিলো না; ছিলো তিরিশের প্রধান ধারার অনুসারী কবি। কিন্তু তার চিন্তা চেতনে সুভাষ-সুকান্তের দ্রোহের ধারাটি উচ্চারিত ছিল। সওগাতের আড্ডাটি ভেঙে যাওয়ার পর কিছুকালের মধ্যে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে বিউটি বোর্ডিংয়ে তরুণ সাহিত্যিকদের নতুন আড্ডা গড়ে ওঠে। এই আড্ডাতে মধ্যমণি হয়ে ওঠে শহীদ কাদরী। বিউটি বোর্ডিংয়ের সাহিত্য রসিক মালিককে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তার শোকাহত, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া শহীদ তার একটি কবিতায় এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল যে, গোটা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিভাস তাতে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন কলকাতার কবি সাহিত্যিকেরা দলে দলে ঢাকায় আসতে থাকেন তখন শহীদ কাদরীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তার কবিতা পড়ে অনেকেই বিস্মিত হন। কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষ আমাকে বলেছিলেন, “শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ে বুঝতে পারছি, তোমাদের মধ্যেও শক্তি ও সুনীলের সমকক্ষ কবি আছে।” শহীদের প্রথম স্ত্রী নাজমুন্নেসা শিক্ষিতা এবং সুন্দরী মহিলা। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে এখনও তার নিবিড় সম্পর্ক। তাকে বিয়ে করেই শহীদ তার কর্মস্থল জার্মানিতে চলে যায়। তাদের একটি ছেলে আছে। এই বিয়ে টিকেনি। সম্ভবত আশির দশকের শেষ দিকে শহীদ কাদরী হঠাৎ লন্ডনে এসে হাজির। নাজমুনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়েছে। আমাকে বললো, “দোস্ত, কিছুদিনের জন্য লন্ডনে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দাও।” লন্ডনের ইস্টএন্ডে টয়েনবি হলে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। কয়েক মাস উদ্্ভ্রান্তভাবে সে কাটালো লন্ডনে। তারপরে হঠাৎ একদিন আমাকে জানালো, সে আমেরিকায় বোস্টনে চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? সে এক চমকপ্রদ কাহিনী। সদ্য প্রয়াত কবির সেই এডভেনচার নিয়ে এখানে কিছু লিখতে চাই না। পরে হয়তো লিখবো। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রবাস-জীবনের সঙ্গে এখানে শহীদ কাদরীর জীবনের কিছুটা মিল আছে। বোস্টন-জীবন শহীদের সুখের হয়নি। তাকে নানা শারীরিক ও মানসিক কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। বোস্টনে আমি দু’বার গেছি সাহিত্য সভায় আমন্ত্রিত হয়ে। দু’বারই শহীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। একবার সে সম্মেলনে কবিতা পাঠ করেছে। তাতে ছিল বাংলাদেশে বন্দুকের শাসন সম্পর্কে তীর্যক বিদ্রƒপ। বোস্টনেই শহীদ ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রায় পঙ্গু দশায় পৌঁছে। এই সময় তার জীবনে নীরার আবির্ভাব এবং নবজীবন লাভ। নিউইয়র্কে নীরার ফ্ল্যাট একটা বহুতল বিল্ডিংয়ের তেরো তলায়। লিফট দিয়ে উঠতে নামতে হয়। অসুস্থ শহীদ ওই তেরোতলাতেই কাটাতো। প্রায়ই যেতে হতো হাসপাতালে। তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে তেরোতলা থেকে লিফটে নামিয়ে হাসপাতালে আনা-নেয়া করতে হতো। তার মাঝেই ওই তেরোতলায় শহীদকে ঘিরে বসতো সাহিত্য-বৈঠক। নিউইয়র্কের বাঙালী কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন। আমিও একবার গেছি। আধুনিক বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে শহীদের আলোচনা শুনে বুঝা যেতো এ সম্পর্কে তার লেখাপড়া কতোটা গভীর। আমি একবার তাকে বলেছিলাম, তুমিতো সারাক্ষণই প্রায় অসুস্থ থাকো। তাহলে এতো লেখাপড়া করো কখন? শহীদ হেসে বলেছে, “দোস্ত, দুনিয়াটা এখন গ্লোবাল ভিলেজ। তাকে জানতে বেশি লেখাপড়া করতে হয় না।” আমি একবার নিউইয়র্কে থাকতেই শহীদ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়। তার বাঁচার আশা ছিলো না। কিন্তু অদম্য মানসিক শক্তির জোরে সে বেঁচে ওঠে। তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হওয়ার সময় সে হেসে উঠেছে। বলেছে, “দোস্ত আমিতো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। ব্যাটা মৃত্যু কাছে এসেও পালিয়ে যাচ্ছে।” তাকে তার বন্ধুরা কবিতা লেখা প্রায় বন্ধ করে ফেলার জন্য অনুযোগ করলে উদাস কণ্ঠে বলতো, কী জন্যে লিখবো? কার জন্যে লিখবো? তার কণ্ঠে একটা অভিমানের সুর বেজে উঠতো। গত বছর নিউইয়র্কে একটা বক্তৃতা দিতে গিয়ে আরবী ভাষা সম্পর্কে কিছু বলায় জামায়াতীদের ফাঁদে পড়েছিলাম। আমার বক্তব্যকে বিকৃতভাবে প্রচার করে নাস্তিক, মুরতাদ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে আমার উপর প্রায় হামলা চালানোর প্রয়াস করা হয়। এ সময় শহীদ কাদরীর টেলিফোন পেয়েছি। “দোস্ত, আমিতো রোগ শয্যায়, তাই তোমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারছি না। তবু তোমার সঙ্গে আছি। ভয় পেয়োনা। লড়াই চালিয়ে যাও।” এই সাহসী, সাহসদাতা কণ্ঠটি আজ স্তব্ধ। ৮২ বছর বয়সে ৭৫ বছর বয়সী শহীদ কাদরীর ওবিচুয়ারি আমাকে লিখতে হচ্ছে। এই শোক ও দুঃখ প্রকাশের ভাষা কোথায়? রবীন্দ্রনাথ যেসব মানুষকে “মৃত্যুহীন প্রাণের অধিকারী” বলেছেন, শহীদ কাদরী নিঃসন্দেহে তাদের একজন। এই মৃত্যুহীন প্রাণের মৃত্যু নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা সকলেই কৃতজ্ঞ, তিনি দীর্ঘ কয়েক যুগ স্বদেশ ছাড়া কবির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেছেন। দেশের মাটিতেই সমাহিত হবেন দেশের একজন প্রধান কবি। অনেক শোক ও বিষাদের মধ্যে এটাই এখন আমাদের একমাত্র সান্ত¡না। লন্ডন, ৩০ আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০১৬
×