ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. হাসিবুল আলম প্রধান

অভিমত ॥ একটি শোক উপাখ্যান

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৩১ আগস্ট ২০১৬

অভিমত ॥ একটি শোক উপাখ্যান

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট এই বাংলার মাটিতে যে ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে সমূলে বিনাশ করতে ইতিহাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল, সেই চক্রের দোসররা ২১ আগস্ট ২০০৪ শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের মিছিলপূর্ব সমাবেশে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালায়। শুধু গ্রেনেডই নয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য তাঁর বুলেট প্রুফ গাড়িতেও পরিকল্পিতভাবে চালানো হয় একের পর এক গুলি। ২১ আগস্ট যেন আর এক ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডিরই পুনরাবৃত্তি। শেখ হাসিনার দেহরক্ষী মাহবুব নিজের বুকের রক্ত দিয়ে ও আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের জীবনকে মৃত্যুর সঙ্গে বাজি রেখে মানববর্ম তৈরি করে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই শেখ হাসিনা সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। দেশের গর্বিত সন্তান মাহবুব তাঁর এ অমর কীর্তির জন্য দেশবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রদীপ শেখ হাসিনা যদি ২১ আগস্ট নিভে যেতেন, তাহলে সমগ্র বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে উঠত, রক্তের স্রোতধারায় ভেসে যেত বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বোমা, গ্রেনেড হামলা ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় নতুন কোন সংবাদ ছিল না। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কেবল আশঙ্কায় থাকত কখন কোথায় রক্তের স্রোতে ভেসে যায় বাংলার সবুজ মাটি। আমরা আশঙ্কায় থাকতাম বোমা, গ্রেনেডের আঘাতে আরও কত মানুষ লাশ হবে, বাংলাদেশের বুক থেকে আরও কত রক্ত ক্ষরণ হবে। এ সময় ধ্বংসাত্মক বোমা হামলার বিস্তার ঘটেছিল রমনার বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে গির্জায়, মাজারে, সিনেমা হলে, রাজনৈতিক সমাবেশে এবং আদালতের ভেতরে। দেশজুড়ে জেএমবির আত্মঘাতী বোমা হামলার কথা তো সকলের জানা। জোট সরকারের আমলে সিলেটে বোমা হামলার শিকার হয়েছিলেন বাঙালী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আমরা দেখেছি কি নৃশংস কায়দায় বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছে দেশের সৎ রাজনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ শাহ এএসএম কিবরিয়াকে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘাতকরা ২১ আগস্ট ২০০৪ বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতৃত্বকে হত্যার উদ্দেশ্যে জনসমাবেশ চলাকালীন সভা মঞ্চে সুপরিকল্পিতভাবে নারকীয় বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। জোট সরকারের আমলে বোমা হামলাকারীরা যে কত সুসংগঠিত ও শক্তিধর তার সর্বশেষ প্রমাণ মেলে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে দেশব্যাপী নজিরবিহীন বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়। এর পর দেশবাসী দেখেছে আদালতের ভেতরে ও বাইরে কিভাবে নৃশংস কায়দায় বিচারক, আইনজীবী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত তো হয়ইনি, বরং খুনীদের বাঁচানোর জন্য ছিল রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা। যখনই কোন স্থানে বোমা হামলা সংগঠিত হয়েছে তখনই প্রশাসন কর্তৃক প্রকৃত সস্ত্রাসীদের আড়াল করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হয়রানি ও নির্যাতন করাসহ কোন কোন ঘটনাকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বলে চালিয়ে দেয়া হতো। যখন বাংলা ভাইরা দেশে জেএমবির নামে একের পর এক নৃশংস বোমা হামলা পরিচালনা করেছিল, তখন জোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী জামায়াতের আমির ও ’৭১-এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’। ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে বিএনপির ভেতরে স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির ধারাটি এতই প্রবল যে, দেশে উগ্রবাদী মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে জোট সরকারের আমলে লালন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘায়েল করতে। জোট সরকারের আমলে তাদের ছত্রছায়ায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও উগ্র মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলো দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল লেখক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে নির্মূল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালিয়েছে এখনও চালাচ্ছে। ২১ আগস্ট ট্র্যাজেডি ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির মতো বাঙালীর জন্য আর একটি শোক উপাখ্যান। ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার দায়ে খুনীদের বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় ও কয়েকজন খুনীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় জাতি হিসেবে যেমন জাতীয় দায়মুক্তি ঘটেছে, তেমনি আমরা গ্লানিমুক্ত হয়েছি। ঠিক তেমনি আর একবার গ্লানিমুক্ত হতে ২১ আগস্ট ট্র্যাজেডির হোতাসহ সকল ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখার অপেক্ষায় গোটা জাতি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে হলে, বাংলাদেশ থেকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চিরদিনের মতো উৎপাটন করতে হলে, দেশকে জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করতে হলে এবং বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত চেতনায় পরিচালিত করতে হলে ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির মতো অবশ্যই বাংলার মাটিতে ২১ আগস্ট ট্র্যাজেডির বিচার হতেই হবে। লেখক : প্রফেসর, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×