ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ডিএনএ বিপ্লব ॥ অপার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৩০ আগস্ট ২০১৬

ডিএনএ বিপ্লব ॥ অপার সম্ভাবনা

ডিএনএ জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে। জিন রূপান্তরিত বা পরিবর্তনের এক নতুন উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে এবং তার ফলে প্রকৃতি জগতের ওপর এক নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এসে গেছে মানুষের হাতে। এই কিছুদিন আগেও যে বিষয়টি তাত্ত্বি¡ক জগতে বিচরণ করছিল তাই এখন অতিদ্রুত বাস্তব হয়ে উঠছে। বিগত শতাব্দীতে আর কোন আবিষ্কারই এত অপার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়নি, মানুষের হাতে অসাধারণ এক নতুন ক্ষমতাও এনে দেয়নি, যা এনে দিয়েছে এই কৌশল। বিজ্ঞানীরা একে কাজে লাগিয়ে আজ মানুষসহ যে কোন জীবন্ত প্রাণীর ডিএনএ অতি দ্রুত ও নিখুঁতভাবে বদলে বা বাদ দিতে এবং পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আর তারই ফল হতে যাচ্ছে অভাবনীয়, বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন। মানুষ এইডসসহ নানাবিধ রোগের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। রোগের চিকিৎসা হয়ে উঠবে অতি সহজ। শুধু তাই নয়, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধী জিন প্রকৃতি জগতের মশার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষ আজ প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুন গুনিয়া, জিকা, নাইল ভাইরাসের মৃত্যু ও আক্রান্তের ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনতে এবং একইভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ বদলে দিতে পারে। খরা ও বন্যাসহ এবং অন্যান্য অতি প্রতিকূল অবস্থায় বেঁচে থাকতে সক্ষম ফসল উদ্ভাবনেও এই কৌশল ব্যবহৃত হতে পারে। সে কারণে আগামী দিনে খাদ্য সঙ্কট ও বুভুক্ষা দূর করার সম্ভাবনা ধারণ করে আছে এই প্রযুক্তি। বায়োলজি বা জীববিজ্ঞানেরও এটা রূপান্তর ঘটিয়েছে। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এই কৌশল ল্যাবরেটরিতে প্রাণীদের ওপর প্রয়োগ করে জিনগত ত্রুটি সারিয়ে তুলছেন। এতে করে মানবদেহে ভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পথে অন্তরায় দূর হবে। আরও যে কত কল্যাণ এই প্রযুক্তি বয়ে আনবে তার শেষ নেই। কি সেই কৌশল সেই নতুন বৈপ্লবিক প্রযুক্তি বা কৌশলটা হলো ক্রিসপার সিএএস৯। ক্রিসপার একটা লম্বা শব্দমালার সংক্ষেপ, যেমন ক্লাস্টার্ড রেগুলারলি ইন্টারসেড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিটস। ক্রিসপারের দুটি উপাদান। একটি হলো সিএএস৯ নামের একটি এনজাইম, যা ডিএনএকে কেটে ফেলার জন্য সেলুলার স্কালপেল হিসেবে কাজ করে। অন্যটি হলো আরএনএ গাইড। এর কাজ হচ্ছে ডিএনএর যে রাসায়নিক বর্ণ তথা নিউক্লিওটাইডগুলোকে কেটে বাদ দেয়ার জন্য সিএএস৯কে পাঠানো হয়েছে সেটিকে সেই নির্দিষ্ট জায়গাটিতে নিয়ে যাওয়া। একটা জেনম কয়েক বিলিয়ন নিউক্লিওটাইডে তৈরি করে। সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার পর সিএএস৯ এনসাইজমটি ডিএনএর অবাঞ্ছিত সিকোয়েন্সকে ছিন্ন করে ফেলে। তারপর ছিন্ন স্থান জোড়া লাগানোর জন্য ক্রিসপার প্যাকেজে আগে থেকে পাঠানো সিনথেটিক নিউক্লিওটাইড দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেয়। এভাবেই এই পদ্ধতিতে জিনেটিক ত্রুটি সারিয়ে রোগ নিরাময় থেকে শুরু করে খাদ্যোৎপাদন পর্যন্ত অসংখ্য কাজে অসাধ্য সাধনের পথ খুলে গেছে। এরই প্রভাবে আগামী দু’চার বছরের মধ্যে চিকিৎসা জগতে নাটকীয় অগ্রগতি দেখতে পাওয়া যাবে। অচিরেই ডাক্তাররা ক্রিসপার পদ্ধতিতে কিছু রোগব্যাধি সারিয়ে তুলতে পারবেন। ক্রিসপারের পটভূমি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় হলো বিজ্ঞানীরা কাক্সিক্ষত জিনেটিক বৈশিষ্ট্য লাভ করার জন্য এক প্রাণীর জিন থেকে নিউক্লিওটাইড কিভাবে কেটে বাদ দিয়ে অন্য এক প্রাণীর জিনের নিউক্লিওটাইডে লাগিয়ে দিতে হয় সেই কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। পদ্ধতিটা ছিল বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ডিএনএ স্থানান্তর করা। বিজ্ঞানীরা তখন এই কৌশলের সম্ভাবনাময় ব্যবহারের কথা ভেবে শিহরণ বোধ যেমন করেছিলেন, তেমনি আবার এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন যে, এতে করে একের ভাইরাস ও প্যালোজেন অন্যের মধ্যে চলে যাবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এমন রোগব্যাধি হতে পারে যা আগে থেকে ধারণার অতীত এবং সেগুলোর স্বাভাবিক চিকিৎসা নিরাময় ও সুরক্ষা হয়ত থাকবে না। এই আশঙ্কা থেকে বহু সভা-সেমিনার করে এবং অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু নিরাপত্তামূলক সুরক্ষা সম্পর্কে একমত হন। শুরু হয়ে যায় জিন প্রকৌশল, যা কোটি কোটি মানুষের জীবনে অভাবনীয় উন্নতি আনে। যেমন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বের হলো জিন প্রকৌশলগত ইনসুুলিন। জিন প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়ে বের হলো অধিক ফলনশীল ও রোগবালাই প্রতিরোধী ফসল। বিশ্বব্যাপী কৃষির চেহারাই গেল পাল্টে। কিন্তু জিন প্রকৌশলঘটিত ওষুধ ব্যাপকভাবে গৃহীত হলেও জিনেটিক ফসল আদৃত হলো না। এটা মানবদেহ এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকরÑ এমন অভিযোগে আন্দোলন হলো, এখনও চলছে। মানুষ জিএম খাদ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাল। এই বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক চোরাবালি থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ যোগাতে পারে ক্রিসপার। কিভাবে? সেটা জানতে হলে দেখতে হবে আগের জিনেটিক প্রকৌশল যা কিনা জিনেটিকেলি মডিফায়েড অর্গানিজম বা জিএমও নামে পরিচিত তার সঙ্গে এখনকার জিনেটিক প্রকৌশল তথা ক্রিসপারের পার্থক্য বা অসঙ্গতিটা কোথায়? দু’য়ের পার্থক্য যেখানে জিএমও হলো ট্রান্সজেনিক। অর্থাৎ বিভিন্ন বা একাধিক প্রজাতির জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিশেল ঘটিয়ে ডিএনএর পুনর্বিন্যাস ঘটানো যার ফলে ওই প্রজাতিগুলো আর কখনই প্রকৃতিতে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে না। কিন্তু ক্রিসপারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ডিএনএ তার নিজের মধ্যেই পুনর্বিন্যাস করা যাবে। অন্য প্রজাতির ডিএনএ নিয়ে আসা হবে না। ডিএনএর এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে এটাই দু’য়ের মধ্যে প্রধান পার্থক্য। ‘অভিশাপ’ থেকে মিলবে মুক্তি ক্রিসপার ইতোমধ্যে ক্যান্সার গবেষণায় রূপান্তর এনেছে। ল্যাবে টিউমার কোষ পৃথক করে ফেলা এবং তারপর সেগুলোর বৃদ্ধি রোধ করার উপায় উদ্ভাবনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো সহজতর হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে গবেষকরা প্রাণীদেহের বড় ধরনের জিনেটিক ত্রুটি সারাতে এই কৌশল সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছেন। ত্রুটিগুলোর মধ্যে আছে মাসকিউলার ডিসট্রফি, সিসটিক ফাইক্রোসিস ও এক ধরনের হেপাটাইটিস। মানব কোষের ডিএনএ থেকে এইচআইভি দূর করার চেষ্টা করে এই কৌশলে আংশিক সাফল্য পাওয়া গেছে। তবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত এ কৌশলে এক সময় এইডস নিরাময় করা যাবে। শরীরের বিকল অঙ্গ যেমন হৃৎপি-, লিভার, কিডনি, ফুসফুস ইত্যাদির বদলে অন্যের সুস্থ অঙ্গ প্রতিস্থাপনে অনেক অগ্রগতি ঘটলেও মস্ত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেই অঙ্গ পাওয়া নিয়ে। স্বেচ্ছায় অঙ্গ দানকারী মানুষটি না মরলে কিংবা দুর্ঘটনায় কারোর মৃত্যু না হলে তো সেই তরতাজা অঙ্গ পাওয়ার উপায় নেই। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, এ মুহূর্তে ১ লাখ ২০ হাজার আমেরিকান অঙ্গ ট্রান্সপ্লান্টের অপেক্ষায় আছে। তালিকার ওপরের দিকে আসার আগেই তাদের মধ্যে হাজার হাজার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে স্রেফ অঙ্গ না পাওয়ার কারণে। এখন এই অঙ্গ সঙ্কট মোকাবেলায় বিজ্ঞানীরা প্রাণীদের অঙ্গ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। তাদের বিবেচনায় এক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীটি হলো শূকর। তার আরেকটি কারণ শূকরের অঙ্গগুলো আকারে মানুষের অঙ্গের মতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শূকরের জেনম ‘পার্ভ’ নামক রেটোভাইরাসে জর্জরিত, যা এইডসের ভাইরাসের অনুরূপ। এতদিন পর্যন্ত কেউ শূকরকে রেট্রোভাইরাস থেকে মুক্ত করতে পারেননি। এখন ক্রিসপারের সাহায্যে শূকরের অঙ্গের জেনমের ত্রুটি সংশোধন করে সমস্যা সমাধানের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন বিজ্ঞানী মহল। এভাবে জেনম সংশোধিত একটি শূকরের কিডনি কোষের সঙ্গে মানব কোষ মিশিয়ে দেখা গেছে মানব কোষটি ভাইরাস সংক্রমিত হয়নি। অন্য এক পরীক্ষায় শূকরের দেহের ২০টি জিন বদলে দেয়া হয়েছে, যেগুলো মানুষের ইমিউন ব্যবস্থায় নিরাপদ রিএ্যাকশন ঘটায়। পরীক্ষায় সাফল্য এসেছে এবং মানবদেহে নিরাপদ ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির পথে অগ্রগতি ঘটিয়েছে। এখন এসব ক্লোন কোষ শূকরের ভ্রƒণে জন্মানো হচ্ছে। তারপর দু’এক বছরের মধ্যে প্রাইমেটের দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে। সাফল্য পাওয়া গেলে তারপর ঘটবে মানবদেহে। ফলে ভবিষ্যতে নিরাপদে প্রতিস্থাপিত হওয়ার মতো অঙ্গের আর অভাব হবে না। ম্যালেরিয়া, জিকা দূর হবে ক্রিসপার পদ্ধতিতে ম্যালেরিয়া, জিকা, চিকুন গুনিয়া, নাইল ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী রোগগুলোকে দুনিয়া থেকে মুছে দেয়ার অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা আছে। তার মধ্যে কয়েকটিই শুধু প্রাণঘাতী রোগের কারণ ঘটায়। যেমন এনাফিলিস, এডিস ইত্যাদি। ওদের পরিবাহিত প্যারাসাইট ও ভাইরাসে প্রতি বছর লাখ লাখ লোক মারা যায়। ডেঙ্গুতে সারা বিশ্বে বছরে ৪০ কোটি লোক আক্রান্ত হয়। জিকা ভাইরাসে মস্তিষ্কঘটিত বৈকল্য এবং নবজাতকের মাইক্রোসেফালি নামে এক বিরল ত্রুটি দেখা দেয়। এ রোগে শিশু অস্বাভাবিক ছোট মাথা ও অবিকশিত মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মে। এসব রোগ থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে আসছিলেন মশার জিন এমনভাবে বদলে দিতে যাতে এই রোগগুলোর আর বিস্তার না ঘটতে পারে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা বা চিকুন গুনিয়া থেকে রক্ষা পেতে এ মুহূর্তে যে উপায়টি আছে তাহলো এগুলোর বাহক মশা তাড়ানোর জন্য উপদ্রুত এলাকা তথা গোটা দেশকে কীটনাশকে স্নাত করে দেয়া। তবে এর ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের যে কি ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে সেটাও কারো অজানা নয়। অথচ ক্রিসপার পদ্ধতিতে মশার কিছু জিন স্থায়ীভাবে বাদ দিলে বা বদলে দিলে সমস্যার হাজার গুণ ভাল সমাধান হতে পারে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সে জাতের মশা বেরও করা হয়েছে। গত বছর জেমস নামে এক বিজ্ঞানী ক্রিসপার পদ্ধতিতে এনোফিলিস মশার এমন এক সংস্করণ বের করেন যেগুলো ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট ছড়িয়ে দিতে অক্ষম বা অপারগ। জেমস বলেন, আমরা ওই মশককুলের ডিএনএতে সামান্য ক’টা জিন যোগ করে দিয়েছি। এর ফলে এ মশাগুলো অন্য সব কিছুই করতে পেরেছে। শুধু ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট এক দেহ থেকে অন্য দেহে সংক্রমিত করতে বা ছড়াতে পারেনি। মশাবাহিত জিকা বা ডেঙ্গু ভাইরাসের বেলায়ও মশার ডিএনএতে একই ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসব রোগের সংক্রমণ বা বিস্তার রোধ করা যেতে পারে। বিজ্ঞানী জেমস ও তার দল এই লক্ষ্যে কাজও করে চলেছেন। তারা ক্রিসপার পদ্ধতিতে মশার ডিএনএর এমন রদবদল আনার চেষ্টা করছেন, যাতে এদের বংশধরদের বংশবিস্তার করার ক্ষমতা না থাকে। জিনের এই বৈশিষ্ট্য সংবলিত মশা যদি বিপুল সংখ্যায় বাইরে ছেড়ে দিয়ে প্রজনন করতে দেয়া হয় তাহলে কয়েক প্রজন্মের মধ্যে গোটা প্রজাতিটি ডিএনএর এই সংশোধিত সংস্করণ বহন করবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মশার এক একটি প্রজন্মের স্থায়িত্বকাল ২ থেকে ৩ সপ্তাহ। তবে এ জাতীয় জিনেটিক পরিবর্তন অভাবিত পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যার সংশোধন করার পথ না-ও থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক উপায়ে বংশপরম্পরায় জিনগত বৈশিষ্ট্য লাভ আর জিন প্রকৌশলগতভাবে যেসব বৈশিষ্ট্য লাভের মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য সে প্রসঙ্গে দুটো কথা বলে নেয়া ভাল। একটা প্রজাতির বেশিরভাগ জিন সন্তান-সন্ততির ধারণ করার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ। কিন্তু ক্রিসপার পদ্ধতি এ অবস্থাটা পাল্টে দিয়েছে। ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে ক্রিসপার-সিএএস৯ ছাড়া কোন প্রজাতির এক বা একাধিক জিন পাল্টে বা বাদ দিয়ে অথবা কাক্সিক্ষত জিন সংযোজন করে সেই সংশোধিত জিন যদি ওই প্রজাতির একাংশের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেই পরিবর্তিত জিনেটিক বৈশিষ্ট্য পরের বংশধরদের মধ্যে শতকরা প্রায় এক শ’ ভাগ সঞ্চারিত হবে। এ এক সুনিশ্চিত প্রক্রিয়া, যা বংশ পরম্পরায় অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে। মানুষও এ থেকে কোন ব্যতিক্রম হবে না। বিপন্ন প্রজাতি রক্ষা পাবে ক্রিসপার পদ্ধতিতে বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে রক্ষা করা যাবে। নকুল জাতীয় প্রাণী কালো পা’ওলা ফেরেট হলো উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর একটি। এক সময় এই প্রাণীটি প্রচুর দেখতে পাওয়া যেত, বিশেষ করে গ্রেট প্লেইনসের গোটা তল্লাটে। এখন সেটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অল্প কিছু যা আছে ফেরেটের জিনেটিক বৈচিত্র্য না থাকায় এর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। রায়ান ফেলান নামে এক বিজ্ঞানীর মতে সমস্ত প্রজাতির মধ্যে ফেরেটই হলো ক্লাসিক দৃষ্টান্ত, যেটাকে ক্রিসপার জেনম প্রযুক্তির দ্বারা রক্ষা করা যেতে পারে। ফেলান ত্রিশ বছর আগে সংরক্ষিত তাদের নমুনা থেকে নেয়া জেনম ফেরেটের ডিএনএতে যুক্ত করে প্রাণীটির বৈচিত্র্য বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কালো পেয়ে ফেরেটই একমাত্র বিপন্ন প্রাণী নয়। এমন বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় আরও অনেক নাম আছে। যেমন হাওয়াই দ্বীপের পাখিরা। সেখানে শতাধিক পাখির মধ্যে এখন মাত্র ৪২টি প্রজাতি আছে এবং এদেরও আবার তিন-চতুর্থাংশ বিপন্ন। এর জন্য দায়ী এভিয়ান ম্যালেরিয়া। মানবদেহে ম্যালেরিয়া চিকিৎসার সত্যিকারের একমাত্র ওষুধ হলো কৃত্রিম রূপের আর্টেমিসিনিন। পাখির ক্ষেত্রে সেটা চলবে না। ম্যালেরিয়া থেকে পক্ষীকুল রক্ষার যে পদ্ধতিটা এখন চালু আছে তাহলো বিশাল এলাকাজুড়ে শক্তিশালী কীটনাশক ছিটিয়ে মশা মেরে ফেলা। এতে আংশিক সফলতা আসে বটে। তবে উদ্ভিদ জগত এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের নিদারুণ ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে মশার জিন এডিটিং অসাধারণ কাজ করতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে এমন মশা জন্মানো হবে যা আর সব কিছু করতে পারলেও ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট ছড়াতে পারবে না। এতে করে পাখিরা যেমন বাঁচবে তেমনি বাঁচবে পরিবেশ। শুধু বিপন্ন পাখিরাইবা কেন, বিপন্ন উদ্ভিদও ক্রিসপার পদ্ধতিতে রক্ষা করা যাবে। উদ্ভিদের একটা শত্রু কীটপতঙ্গ। উদ্ভিদের মধ্যে একটা জিন আছে, যার জন্য কীটপতঙ্গ উদ্ভিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এখন জিন বিজ্ঞানীরা কীটপতঙ্গ আকৃষ্টকারী সেই জিন উদ্ভিদের ডিএনএ থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেটাতে সফল হলে উদ্ভিদ কীটপতঙ্গের হাত থেকে বাঁচবে এবং কীটপতঙ্গ মারার ওষুধের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমবে। ক্রিসপার পদ্ধতিতে ধানের ডিএনএ এডিটিং করে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ অধিক ফলনশীল ধান উৎপাদন করা সম্ভব। এই ভিটামিনের অভাবে প্রতি বছর উন্নয়নশীল বিশ্বে ৫ লাখ শিশু অন্ধত্ববরণ করে। অবশ্য গোল্ডেন রাইস নামে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ ধান বেরিয়েছিল। তবে সেটা ছিল জিএমও পদ্ধতিতে। সোজা কথায় জিএম ফসল। বিরোধিতার মুখে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন বন্ধ আছে। ক্রিসপার পদ্ধতি গ্রহণে কারো কোন বিরোধিতা থাকার কথা নয়। কারণ এটা মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের কোন ক্ষতি করবে না, যেমনটি জিএম ফসল করছে বলে অভিযোগ আছে। হাজার হাজার বছর ধরে কৃষকরা নিজেরাই অজ্ঞাতসারে ক্রিসপার পদ্ধতি অনুসরণ করে এসেছেন। তারা সংস্কারের মাধ্যমে একই প্রজাতির ফসলের জিনে রদবদল ঘটিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছেন। ক্রিসপারও সেই একই কাজ করছে তবে সেটা আরও সুনির্দিষ্ট উপায়ে। ক্রিসপার পদ্ধতিতে জিন এডিটিংয়ের দ্বারা জাপানী বিজ্ঞানীরা পাকার কাজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এমন জিন নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে টমেটোর আয়ু অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলেছেন। আমেরিকার বিজ্ঞানীরা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বারা অন্য দুই প্রজাতির মাছের জিনেটিক উপাদান আটলান্টিকের স্যামন মাছের ডিএনএতে যুক্ত করে এক নতুন জাতের স্যামন সৃষ্টি করেছেন, যেটি দ্রুত বর্ধনশীল। এটি বাজারের সাইজের মাছের তুলনায় অনেক সময় দ্বিগুণ বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু ট্রান্সজেনিক বলেই এই মাছ শরীরের জন্য কতখানি ক্ষতিকর তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অথচ একই কাজ হয়ত করা সম্ভব হবে ক্রিসপার পদ্ধতির জিন এডিটিংয়ে। তাতে এই মাছ খেতে কোন সমস্যা হবে না। সোজা কথায় ক্রিসপার প্রযুক্তি নিয়ে এখন ব্যাপক কাজ হচ্ছে। মুরগি থেকে শুরু করে গরু, মহিষ, মাশরুম, গম, ক্যাটফিশ, বানর এবং আরও অসংখ্য প্রাণীর ওপর ডিএনএ এডিটিংয়ের সফল প্রয়োগ হয়েছে। মানবদেহে প্রয়োগেও আর বেশিদিন বাকি নেই। তখন অভাবনীয় সব পরিবর্তন ঘটবে আমাদের জীবনে ও চারপাশে। ডিএনএ তখন সত্যিকারেই বিপ্লব আনবে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×