ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু এবং এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৩০ আগস্ট ২০১৬

রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু এবং এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ

আগস্ট মাসটা বাঙালী জাতির জন্য সুখের নয়, শোকের; এ যেন আগমনের মাস নয়, তিরোধানের। এ মাসেই মহাপ্রয়াণ ঘটেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই বাঙালী রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গবন্ধুর। শোকের মাসে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের এ স্বল্প পরিসরে আমি তুলে ধরব বিশ্বসভায় সমস্ত বাঙালীর গৌরব, ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার গর্ব, প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, চেতনা ও গানকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালী কিভাবে ব্যবহার করেছে নিজেদের মহাজাগরণ সৃষ্টিতে, যার সফল পরিণতি মহান মুক্তিযুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ এমন এক মানুষ ছিলেন যাকে নিয়ে কোন কিছু লেখা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তিনি ছিলেন মহাসমুদ্রের মতো, যে কোন দিকে তাকালেই যার বিবিধ রূপ সহজেই ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের ঠিক ত্রিশ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় এমন আর এক বাঙালীর নেতৃত্বে কালের বিবর্তনে তাকে মনে করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো কালজয়ী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে ডিঙ্গিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে এক কথায় অভিহিত করা যায় দেশপ্রেমের অবতার হিসেবে। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা কিংবদন্তিতুল্য। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের কতশত সংগ্রামের শীর্ষ যিনি রচনা করেছিলেন, বাংলাকে তাঁর মতো আর কে ভালবেসেছে? সাংবাদিক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, হে মহানায়ক আপনার শক্তি কোথায়? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি, সেই আমার শক্তি। সাংবাদিকের আবার প্রশ্ন, আর আপনার দুর্বলতা? তাঁর উত্তর, বাংলার মানুষকে আমি বড় বেশি ভালবাসি, সেই আমার দুর্বলতা। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণের কথা বলতে গিয়ে ৫ এপ্রিল সংখ্যায় মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ লিখেছিল, ‘রাজনীতির প্রকৌশলী নন মুজিব, মুজিব হচ্ছেন রাজনীতির কবি; বাঙালীর স্বাভাবিক প্রবণতা প্রায়োগিক নয়, শৈল্পিক; তাই মনে হয়, বাংলাদেশের সকল মানুষ, শ্রেণী ও মতাদর্শকে এক সূত্রে গাঁথা হয়ত কেবল মুজিবের মতো রাজনৈতিক কবির পক্ষেই সম্ভব।’ বস্তুত বঙ্গবন্ধু এমন এক জাতীয়তাবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন যার সন্ধানে গেলে নেতাজী সুভাষ বসুর কাছে গিয়ে পৌঁছতে হয়। অনেকটা অসচেতনভাবেই তিনি ওই মহান বাঙালীর জাতীয়তাবাদী মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন। প্রখ্যাত আমেরিকান লেখক জেমস জে নোভাকের ভাষায়, ‘দু’জনের মধ্যে পার্থক্য ছিল কেবল এক জায়গায়, বসু সব সময় ছিলেন অভিজাত, আর মুজিব কথা বলতেন সাধারণ মানুষের ভাষায়। তা সত্ত্বেও দু’জনই বাঙালী জাতীয়তাবাদের গভীরতম প্রদেশে নাড়া দেন। সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভিত্তিক ভ্রাতৃত্ববোধের দিকে এগিয়ে যান। যাঁর ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড বাঙালী মানসের গভীরতম প্রদেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ছিলেন এক নৌকা যাতে চেপে জনগণের আকাক্সক্ষা বয়ে যেতে পারত।’ বাংলাদেশের জন্য বাঙালীর ভালবাসা অফুরন্ত, বাংলাদেশ তার স্বপ্ন এবং স্বর্গ। ইতিহাস খুললেই চোখে পড়ে বাঙালীর দেশপ্রেম। নোভাকের ভাষায়, ‘এই ভালবাসার নজির, গাঙ্গেয় লোকদের হাতে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের পরাজয়, ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াকু বাঙালীর মরণপণ সংগ্রাম ও ট্র্যাজিক পরাভব, ১৯১৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বাঙালী জাতির ব্রিটিশবিরোধী সক্রিয়তা, দ্রোহ ও আন্দোলন এবং সর্বশেষে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতায়। বাঙালীরা সবসময়ই লড়েছে এই স্বপ্নঘেরা ভূখ-টির জন্য; কখনও জয় হয়েছে, কখনও পরাজয়, কিন্তু দেশটাকে ছেড়ে দেয়নি। সেই ভালবাসাই তাদের গানে, কবিতায়, চিত্র, কথকতায় ব্যক্ত। বাংলা ভাষাতে যত দেশাত্মবোধক গান রচিত হয়েছে অন্যকোন ভাষাতে এটা হয়েছে কিনা সন্দেহ।’ বাঙালীরা যেমন ভালবাসে তাদের দেশকে, তেমনি ভাষাকেও। বাঙালী পৃথিবীতে একমাত্র জাতি যার সন্তানেরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে নিজের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। ভাষার জন্য সেই আত্মদানকে শ্রদ্ধা জানিয়েই আজকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। নতুন করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বীজ ওই রক্ত দেয়ার মধ্য দিয়ে রোপিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি সেদিনের পূর্ববাংলার রাজনীতিতে টেনে আনে পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে। ওই সময় পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টিভিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গান নিষিদ্ধ করে দেয়; কিন্তু বাঙালীরা রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রচার করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাংলার এক অভ্রান্ত প্রতীক, রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে অভিব্যক্তি পায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য- পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব এভাবে অঙ্কিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাব্য ও গানের যে প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ সে প্রভাব সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রকাব্য আর রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালীদের বিদ্রোহ ঘোষণা করার এক মহান উজ্জীবিত শক্তি। রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতার মধ্যে বাঙালীর আত্ম আবিষ্কার সূচিত হলো যেন, ভিত্তি হয়ে উঠল এক রাজনৈতিক আন্দোলনের- ১৯৭১ সালের মহান মুক্তি সংগ্রামে এই দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা স্থান পায় মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে। বহু বছরের কারাকক্ষের নির্জন প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নিত্য সময়ের সঙ্গী ছিল, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘পবিত্র কোরান এবং গীতবিতান আমার জেলের স্যুটকেসে রাখা থাকত সবসময়, যা ছিল আমার কারাজীবনের নিত্য সময়ের সঙ্গী।’ ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তদানীন্তন পূর্ববাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেয়া এক সংবর্ধনার (আমি সে সভায় উপস্থিত ছিলাম) জবাব দিতে গিয়ে তাঁর বাংলায় দেয়া ভাষণের মাঝখানে রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গিয়ে তিনি ইংরেজীতে বললেন, ‘এড় ঃড় ধহুযিবৎব রহ ঃযব ড়িৎষফ ধহফ ঃবষষ ঃযবস ঃযধঃ ুড়ঁ যধাব পড়সব ভৎড়স ঃযব পড়ঁহঃৎু ড়ভ ঞধমড়ৎব, ঃযবু রিষষ ৎবংঢ়বপঃ ুড়ঁ.’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বাংলার সম্পর্ক ও এই পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশের মানুষকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ করে রাখে। সেজন্য সোনার বাংলার বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন বারবার এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ করেন দেশপ্রেমে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা খুব প্রত্যক্ষ, সেই রকম প্রভাব আর কোন প্রভাবের সঙ্গেই তুলনীয় নয়। কলকাতার কবি এষা দে তাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যা কিছু আছে তা মুসলিম বাংলাদেশে, যদিও তিনি জীবনের বিরাট অংশ কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে; তবু রবীন্দ্রনাথের ভাষাপ্রেম বাংলাদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্বাধীনতা লাভে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তার রোমান্টিকতা ও দেশপ্রেম এখনও এদেশের মনোলোকে স্থায়ী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।’ লেখক জেমস জে নোভাক কিভাবে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেছেন সেটা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আরেকটি বিষয় মুজিব উস্কে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছেÑ সামরিক ও যুদ্ধপ্রিয় পাকিস্তানী পাঞ্জাবীদের চেয়ে বাঙালী সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের বোধ। অকৃত্রিম বাঙালী মনের সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক গুণাবলী এবং সে মনের নৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কবিতার ভূমিকা কী তা মুজিব বুঝেছিলেন। বহুদিন আগে সক্রেটিস যেমনটা বুঝেছিলেন। তাই তিনি বাঙালীর সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে বাঙালী রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানের মহান কবি ইকবালের বিপরীতে প্রতিস্থাপন করেছেন।’ পরবর্তীকালে সেই একই ধারায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লিখিত কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গানকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে আমরা ধন্য হয়েছি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সম্ভবত বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিনে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতা পঙ্ক্তির ‘সাত কোটি বাঙালীকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি’ বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।’ এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে? ব্যক্তিগত পাদটীকা : সত্তর দশকের প্রথম দিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরেই আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে টহরাবৎংরঃু ড়ভ ওষষরহড়রং ধঃ টৎনধহধ-ঈযধসঢ়ধরমহ-এ পড়তে আসি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৎড়ংঢ়বপঃঁং-এর কভারে কবিগুরুর উক্তি দেখে একজন বাঙালী হিসেবে গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে জানতে পারি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছিলেন ১৯২৮-১৯৩২ সময়ে। কবিগুরু এখানে ১৯২৯ সালে এসে প্রায় এক বছর বাস করেন। এটা জানতে পেরে আমি যে বাড়িতে কবিগুরু ওই শহরে পুত্রের সঙ্গে বাস করেছিলেন সেটা খুঁজে বের করতে সক্ষম হই এবং সে বাড়ির ছবিসহ সে সময়ের সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে একটা নিবন্ধ লিখি। রথীন্দ্রনাথ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যের জন্য কসমোপলিটান ক্লাব নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। আমি যখন ওখানে যাই তখন প্রচণ্ড শীতের সময় ওরা আমাকে একটা সুন্দর শীতের কোট দান করেছিল। পরবর্তী সময়ে ওই কসমোপলিটান ক্লাবটি ঞধমড়ৎব ঈবহঃবৎ-এ রূপান্তরিত হয়। কবিগুরুর সার্ধশতবার্ষিকীতে ঞধমড়ৎব ঈবহঃবৎ-এর উদ্যোগে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয় এবং একজন এলামনাই হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। লেখক : কানাডাপ্রবাসী অধ্যাপক
×