ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পদে পদে হয়রানি

প্রকাশিত: ০২:১১, ২৯ আগস্ট ২০১৬

ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পদে পদে হয়রানি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ী ও ইনানী মৌজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক এবং ওই সড়কের পার্শ্বে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ পেতে কতিপয় সার্ভেয়ার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ঘুষের টাকা দিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অনেকে ক্ষেতখামার, চাষাবাদকারী ও অশিক্ষিত ব্যক্তি। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা (চেক) কিভাবে আদায় করতে হয়, তা মোটেও জানে না তারা। ওসব ভূমি মালিক তাদের স্বজনদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষিত লোককে অফিসিয়াল কাজ সারতে তাদের প্রতিনিধি নিয়োগ করে থাকেন। ভূমির ক্ষতিপূরণের চেক পেতে সাহায্যকারী হিসেবে ওই স্বজনকে সঙ্গে আনলে দায়িত্বরত ওসব সার্ভেয়ার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। ক্ষতিপূরণের টাকায় ভাগ বসাতে দুর্নীতিবাজ সার্ভেয়ারগণ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বণ করে থাকে। এ কাজে তারা কয়েকজন দালাল নিয়োগ করে মূল প্রাপ্ত টাকার উপর শতকরা হিসেবে ঘুষের জন্য প্রস্তাব দেয় ভূমি মালিকদের। সার্ভেয়ারদের নিয়োজিত দালালের প্রস্তাব তথা দাবীকৃত ঘুষের টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না মোটেও। চেক প্রাপ্তির আগেই ঘুষের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ ভূমি মালিকদের কেউ অন্য জমি-জমা বন্ধক রেখে নতুবা ধারকর্জ করে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে নিচ্ছে। আবার কেউ ধনাঢ্যশালীদের কাছে ধর্না দিয়ে থাকে। প্রভাবশালীরা সুযোগ বুঝে নগদ টাকা প্রদানে শতকরা ২০ভাগ টাকা আদায়ের শর্ত জুড়ে দেয়। অনেক সময় ওই দালালদের মাধ্যমে বহু জমি এ্যাসেসমেন্ট করে সার্ভেয়াররা উৎকোচ পেতে ‘ধরি মাছ-না ছুঁই পানি’ অবস্থায় একাধিক ফাইল লাল ফিতায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। মেরিন ড্রাইভ তথা ইনানী এলাকার নীরিহ ভূমি মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে এভাবে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সার্ভেয়ার মুজিবুর রহমান ঘুষ গ্রহণের কথা সত্য নয় দাবী করেছেন। নিয়ম রয়েছে, অধিগ্রহণকৃত জমি সার্ভেয়ারগণ সরেজমিনে পরিমাপ করে রিপোর্ট দেবে। কানুনগো এ্যাসেসমেন্ট করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট ফাইল প্রেরণ করবেন। কিন্তু কক্সবাজারে তা মানা হচ্ছে না। সার্ভেয়াররাই পরিমাপ নির্ণয় সবকাজই করে চলছে। এ কারণে সার্ভেয়ারদের পোয়াবারো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে জমির রেকর্ডে জটিলতা, খতিয়ানে গরমিল, জমির বিরুদ্ধে আপত্তি এবং মামলা রয়েছে ইত্যাদি জানিয়ে ভূমি মালিকদের হয়রানি করা হয় বলে জানা গেছে। একাধিক ভূমি মালিক জানান, সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রতি সন্মান দেখিয়ে পুরো জাতির জন্য মালিকানাধীন জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য ক্ষতিগ্রস্ত জমি মালিকরা। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতি পরায়ন সার্ভেয়ার ও কর্মচারীদের (উচ্চমান সহকারী) হয়রানির কারণে ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনে বিভিষিকাময় পরিণতির শিকার হচ্ছেন ভূমি মালিকরা। অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের আগেই জমি মালিকদের প্রদান করতে হয় প্রাপ্ত আসল টাকার উপর ২০ থেকে শতকরা ৩০ভাগ পর্যন্ত উৎকোচ। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইনানী মেরিন ড্রাইভ সড়ক ও শীলখালী মৌজার কিছু ভূমি অধিগ্রহণ করে প্রতিকানি জমির মূল্য বাবদ ৭২ লক্ষাধিক টাকা হিসেবে ধার্য করে স্থিত ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করে আসছে। নিয়ম রয়েছে, সরেজমিনে তদন্ত, দখল, জমির রেকর্ডপত্র যাচাই শেষে সার্ভেয়ারগণ রিপোর্ট দেবে। কিন্তু দায়িত্ব প্রাপ্ত সর্ভেয়ার (অস্থায়ী) মুজিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান ও মনিরুজ্জামানসহ অনেকে রিপোর্ট প্রদানের পূর্বে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে শতকরা ২০-৩০ ভাগ হারে উৎকোচ আদায় করে চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চাহিদা মতে টাকা প্রদানে গড়িমসি বা দাবীকৃত উৎকোচ কম দিতে চাইলে মামলা, নিষেধাজ্ঞা ও আপত্তি আছে বলে মাসের পর মাস হয়রানি করে থাকে। শেষ পর্যন্ত শতকরা হিসেবে ওদের দাবীকৃত টাকা প্রদান করে হলেও ইতোপূর্বে চেক পেয়েছে অধিগ্রহণকৃত ভূমির গরীব অসহায় মালিকরা। এদিকে বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: আনোয়ারুল নাসের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সার্ভেয়ারদের হয়রানি থেকে হয়ত রক্ষা পাবে বলে আশায় বুক বাঁধছে ইনানী মেরিন ড্রাইভ এলাকার ভূমি মালিকগণ। অভিযোগ উঠেছে, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পাথুরেবিচ ইনানীর রিসিভারকৃত কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমি জাল কবলা, কাগজপত্র সৃজন এবং ওই জমির ভূয়া মালিক সাঁজিয়ে সমুদয় টাকা উত্তোলন করে ২জন সার্ভেয়ারসহ ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগে ইনানী এলাকার বিরোধপূর্ণ কয়েক কোটি টাকার রিসিভারকৃত ওই জমি সরকারের তত্ত্ববধানে নিয়ে আসা হয়েছে, যা এখনও দু’পক্ষের বিরোধ নিস্পত্তি হয়নি। জানা যায়, সরকারের প্রকল্প ও অধিগ্রহণকৃত ভূমির যাবতীয় কাজ তরান্বিত করতে ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসন অস্থায়ীভাবে সার্ভেয়ার মাহবুবুর রহমান ও মুজিবুর রহমানকে কক্সবাজারে নিয়োজিত করেন। বর্তমানে তাদের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হচ্ছে জেনে তারা পুনরায় কক্সবাজারে বহাল থাকার তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তাদের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি বলে মুঠোফোনে দাবী করেন সার্ভেয়ার মুজিবুর রহমান। ভূক্তভোগীদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কতিপয় সার্ভেয়ার নিজেদের মন্ত্রী-সচিবের স্বজন দাবী এবং দম্ভোক্তি করে বলে বেড়ায়, শতকরা ২০থেকে ৩০ভাগ পর্যন্ত উৎকোচ না দিলে ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে মাসের পর মাস ঘুরতে হবে। এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত এলএ চেক কোনভাবেই এ অফিস হতে আদায় করা সম্ভব হবেনা। এমনকি সার্ভেয়াররা তাদের ঘুষ আদায়ে আপত্তি বা কোন ধরণের চালাকি করতে চেষ্টা করলে ভূমি মালিকদের জেল হাজতে পাঠানোরও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। সার্ভেয়ারদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ নীরিহ ভূমি মালিকরা জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পাবার আশায় কক্সবাজার শহরে প্রত্যেহ আসা-যাওয়া এবং হোটেল ভাড়ায় অবস্থান করতে করতে ক্ষতিপূরণের সমপরিমাণ টাকা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। শতকরা নির্ধারিত হারে হারে ঘুষ গ্রহণ ও হয়রানির বিষয়ে ভূক্তভোগীরা জেলা প্রশাসক বরাবরে ইতোপূর্বে অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরে অধিগ্রহণকৃত জায়গায় ইতোপূর্বে বসতি কয়েকজনের কাছ থেকে তাদের দখল কিনে নিয়েছে একাধিক সার্ভেয়ার। তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করার পর তাদের কাছে প্রদান এবং এ ঘটনা ফাঁস না করার শর্তে ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প নিয়ে রেখেছেন ওই সার্ভেয়াররা।
×