ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জ অভিযানে তামিমের সঙ্গে নিহত দুই জঙ্গীর পরিচয় শনাক্ত

এবার জিয়া ও মারজানের পালা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৯ আগস্ট ২০১৬

এবার জিয়া ও মারজানের পালা

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গীবিরোধী ‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’ অভিযান থেকে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭’ অভিযানে বড় ধরনের সাফল্যে দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিজানে ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জের জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে। এখন দুই মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও নুরুল ইসলাম মারজানসহ এক ডজন সুইসাইড স্কোয়াডের জঙ্গী গ্রেফতারই হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের বড় এজেন্ডা। এদিকে পাইকপাড়ায় হিট স্ট্রং ২৭ অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরীর দুই সহযোগীর পরিচয় পাওয়া গেছে, যার একজন হচ্ছে মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধানম-ির তাওসিফ হোসেন ও অপরজন হচ্ছে যশোরের এক কলেজ অধ্যক্ষের ছেলে কাজী ফজলে রাব্বি। বিদেশই দেশের জঙ্গী অর্থায়নের উৎস। তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় গত ১ জুলাই জঙ্গী হামলার পর বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত, বিত্তবান ঘরের সন্তানদের জঙ্গী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি প্রকাশ পেয়ে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা, যার সর্বশেষ সফল অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। গুলশান হামলার ২৬ দিন পর কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় ‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’ অভিযানে ৯ জঙ্গী নিহত ও এক জঙ্গী আহত অবস্থায় ধরা পড়ায় জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী সেদিন পালিয়ে গেলেও এক মাসের মাথায় গত ২৭ আগস্ট দুই সহযোগী তাওসিফ হোসেন ও কাজী ফজলে রাব্বিসহ তামিম চৌধুরী নিহত হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পাইকপাড়ায় অভিযান শেষে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তামিম চৌধুরীর চ্যাপ্টার শেষ হয়েছে। অন্য জঙ্গী ও মাস্টারমাইন্ডরাও ধরা পড়বে।’ কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সম্প্রতি জেএমবির এক সদস্যকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার ওই বাড়িটিতে অভিযান চালানো হয়েছে।’ ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছেন, ‘কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জের মতো অভিযানের ফলে জঙ্গীদের তৎপরতা অনেকাংশেই স্তিমিত হয়ে পড়বে। তারপরও জঙ্গীবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ কোথায় মেজর জিয়া ও মারজান ॥ পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ জঙ্গী নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরী পুলিশের ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭’-এ নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ মহলের টার্গেট হচ্ছে পুরস্কার ঘোষিত আরেক শীর্ষ জঙ্গী নেতা চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড দুর্ধর্ষ জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজানসহ আরও কয়েকজন। নারায়ণগঞ্জের অভিযানের মতো জঙ্গীবাদ দমনে হয়ত শীঘ্রই আরও কিছু সফলতা আসার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কল্যাণপুরের অভিযানকালে পালিয়ে যাওয়ার সময় আহতাবস্থায় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যান নব্য জেএমবির সম্ভাব্য কিছু আস্তানার সন্ধান দিয়েছে। এছাড়াও জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যায় গ্রেফতার হওয়া আনসার আল ইসলামের নেতা শামীম ওরফে সিফাতও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছে। মেজর জিয়া ও মারজান কোথায় কোথায় থাকতে পারে, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গী দমন ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা হিসেবে তামিম চৌধুরী গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্তরাঁ ও শোলাকিয়ায় হামলার মাস্টারমাইন্ড। গুলশান হামলার আগে হামলাকারীদের সে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দিয়েছিল। গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় সফল অভিযানের পর বেরিয়ে আসে তামিম আর মারজানের নাম। পলাতক মারজান নব্য জেএমবির ‘ন্যাশনাল অপারেশন কমান্ডার’। দেশে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার হত্যাকা-ের হোতা মেজর জিয়া। নিহত দুই জঙ্গীর পরিচয়, তাওসিফ ॥ মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে নিহত অপর দুই জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারী কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। একজনের নাম তাওসিফ হোসেন। ম্যাপেল লিফ নামে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করা তাওসিফ মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। ছুটিতে মাঝেমধ্যে সে দেশে আসত। এ বছর এমনই এক ছুটিতে দেশে ফিরে ৩ ফেব্রুয়ারি নাস্তা করার কথা বলে সে ধানম-ির বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর থেকেই সে নিখোঁজ ছিল। ধানম-ির ১৫ নম্বর সড়কের ১৯/২ নম্বরের বাসার চারতলার একটি ফ্ল্যাটে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত তাওসিফ। তবে ছুটিতে দেশে এলে এ বাসাটিতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে উঠত। নারায়ণগঞ্জের জঙ্গী আস্তানায় তাওসিফ নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাতেই তাওসিফের বাবা ডাঃ আজমল হোসেন ও মা ফরিদা হোসেন বাসা থেকে বের হয়ে যান। তারপর থেকেই বাসাটি তালাবদ্ধ বলে জানান বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী, কেয়ারটেকার। তারা জানান, তাওসিফ শুক্রাবাদের একটি মসজিদে নামাজ পড়ত। নামাজ পড়ে আবার চলে আসত। যাওয়ার সময় তার ব্যাগটি খুব হালকা দেখা গেছে। র‌্যাব থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত নিখোঁজের তালিকার ৭ নম্বরে রয়েছে তাওসিফ। তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহী। তাওসিফ নিখোঁজ হওয়ার পর তার বাবা ধানম-ি থানায় একটি জিডি করেছিলেন। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, তাওসিফের বিষয়ে আমরা ৯৫ ভাগ নিশ্চিত হয়েছি। বাকি ৫ ভাগ রবিবার ‘রিচেক’ করার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান তিনি। অপর জঙ্গী কাজি ফজলে রাব্বি ॥ ‘জিহাদে যাচ্ছি’ বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে নিহত জঙ্গী কাজী ফজলে রাব্বি। রাব্বির বাবা যশোর উপশহর ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কাজী হাবিবুল্লাহ ১০-১২ বছর আগে এখানে (কিসমত নওয়াপাড়া, বিশ্বাসপাড়া) জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন। রাব্বি এক সময় ছাত্রশিবিরের সমর্থক ছিল। পরে যশোরে থাকতেই সে এ সংগঠন ছেড়ে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। রাব্বি নামাজ-কালাম করত। মসজিদের ইমাম রাব্বিসহ আরও কয়েকজনকে জঙ্গী বানানোর জন্য তৎপরতা শুরু করে। কিন্তু অন্যরা এড়াতে পারলেও রাব্বি প্রভাবিত হয়ে যায়। গত এপ্রিলে সে বাড়ি ছেড়ে যায়। যে মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়ত সেখানকার কয়েকজন হুজুরের সঙ্গে বাড়ি ছাড়ে সে। রাব্বি এলাকার ছেলেদের সঙ্গে খুব একটা মিশত না। শুধু স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোঃ ইয়াহহিয়ার সঙ্গে সখ্য ছিল তার। ইমাম মোঃ ইয়াহহিয়া রাব্বিসহ চার-পাঁচজনকে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চালায়। বিষয়টি জানার পর স্থানীয় লোকজন ইয়াহহিয়াকে ওই মসজিদ থেকে বের করে দেন। গত মাসে যশোর পুলিশ যে পাঁচজনকে জঙ্গী হিসেবে সাব্যস্ত করে পোস্টার ছাপে, ফজলে রাব্বির নাম ও ছবি ওই তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে ছিল। যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজের পদার্থবিদ্যা (অনার্স) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল কাজী ফজলে রাব্বি। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, কাজী ফজলে রাব্বির পরিচয় বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহত জঙ্গী তামিম, তাওসিফ হোসেন ও কাজী ফজলে রাব্বির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গীবিরোধী সফল অভিযানের পর এখন পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে মেজর জিয়া, মারজানসহ প্রায় এক ডজন পলাতক জঙ্গী।
×