ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তামিমের সঙ্গেই কী শেষ হবে নব্য জেএমবি অধ্যায়?

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৯ আগস্ট ২০১৬

তামিমের সঙ্গেই কী শেষ হবে নব্য জেএমবি  অধ্যায়?

রশিদ মামুন ॥ খানিকটা স্বস্তি। জঙ্গী নেতা তামিম চৌধুরী পুলিশের এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে। পুলিশ বলছে তামিম নিউ জেএমবির প্রধান। সিরিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছিল খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে। লক্ষ্য ছিল আফগান থেকে বার্মা পর্যন্ত নিজেদের আয়ত্তে নেয়া। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রকাশনা দাবিকের এ বক্তব্য সত্য হলে তামিমেই কি নিউ জেএমবি অধ্যায়ের শেষ? নাকি আরও অনেকে রয়েছে- তাদের একজন মাত্র তামিম। পুলিশ তো বলছেই মারজান আর জিয়া সাম্প্রতিক জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের আরও দুই হোতা। গত কয়েক মাসের অভিযানের সূত্র ধরে বলা যায়, একজন জঙ্গীকে ধরলে আরেকজনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আন্যজনকে ধরলে আবার শোনা যাচ্ছে নতুন নাম। শায়খ রহমানে থেমে যাওয়া জেএমবি থেকে তামিম নিয়ে আসে নিউ জেএমবি। এ ধারা লক্ষ্য করলে আতঙ্ক রয়েই যাচ্ছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘তামিম চৌধুরীর চ্যাপ্টার শেষ।’ এরপর কী সব জঙ্গী তৎপরতা থেমে যাবে, তা বলা কঠিন। তবে গত দুই বছরের জঙ্গী তৎপরতার ঘটনা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একের পর এক ব্লগার, লেখক এবং প্রকাশককে হত্যা করা হচ্ছিল। সেখানে আস্তিক-নাস্তিক ইস্যুটিই বারবার জঙ্গীরা সামনে আনছিল। তবে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর বলা যায় এর ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী বেশকিছু জঙ্গী আস্তানা তছনছ করে দেয়। এর মধ্যে আর জঙ্গী হামলা হয়নি। এতে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়, দেশের জঙ্গী হামলাগুলোর পেছনে তৎপর ছিল নিউ জেএমবি, যার নেতৃত্বে ছিল তামিম চৌধুরী। তামিম চৌধুরীর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে তামিমের সম্পর্ক বলতে তার বাবা-মা এ দেশের মানুষ ছিল। তবে তার বাবা-মা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার ১৫ বছর পর ১৯৮৬ সালে কানাডার ওন্টারিওর উইন্ডসর শহরে তামিমের জন্ম। কানাডায় বেড়ে ওঠা তামিম সেখান থেকে সিরিয়া যায়। জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে আসে। কী অদ্ভুত ঘটনা বাংলাদেশে না জন্ম না বেড়ে ওঠা। তারপরও এ দেশের মানুষকেই কেন সে টার্গেট করল। অন্তত গুলশান হামলার পর সারাবিশ্বে বাংলাদেশ শিরোনাম হয়। গুলশান শিরোনাম হয়। এর আগেও ইতালি এবং জাপানী দুজন নাগরিককে হত্যা করা হয়। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদার ধর্মনিরপেক্ষ এবং অতিথিবৎসল বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। তবে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ায় বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। তারা বুঝতে পারছেন বাংলাদেশ জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি হবে না কোন দিন। শায়খ রহমানরাও পারেনি, তামিম চৌধুরীরাও পারবে না। এই খানিকটা স্বস্তিকে স্থায়িত্ব দিতে হবে। এজন্য শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে হবে না। এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। সামগ্রিকভাবে দেশে জঙ্গীবাদবিরোধী একটি অবস্থার তৈরি হয়েছে। তা আরও বিস্তৃত করতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণের শুরুতেই খুন হয়েছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার। কিন্তু রাজীবেই সতর্ক হয়নি সরকার। ব্লগার হত্যাকা-ের পর তাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে প্রচার চালায় একটি গোষ্ঠী। ফলে খুনীর চাপাতি রক্তে ভিজে ওঠে। ব্লগার, লেখক, পুরোহিত, পীর, বিদেশী নাগরিক, যাজক কেউ বাদ পড়েনি। চাপাতির আঘাতে বাংলাদেশের হৃদয় বিক্ষত হয়। শেষটায় এসে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গীপনার আত্মঘাতী চিত্র ফুটে ওঠে। এ হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দেন বীর দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে জঙ্গীরা। আলোচনায় আসে তামিম চৌধুরী আর তার নতুন জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া কবরস্থানের পাশের তিনতলা বাড়িটি ঘিরে পুলিশের এ অভিযানের নাম ‘অপারেশন হিট স্ট্রং টোয়েন্টি সেভেন’। এ অপারেশনের শেষে আইজিপি একেএম শহিদুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, অপারেশন শেষে আমরা ভেতরে ঢুকে দেখতে পাই তিন জঙ্গী নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের চেহারা তামিম চৌধুরীর যে ছবি আমাদের কাছে আছে তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এতে স্পষ্ট সে তামিম চৌধুরীই হবে। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একসঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল জেএমবির সর্বোচ্চ নেতা শায়খ আবদুর রহমান। দেশজুড়ে বোমা হামলা চালানোর সময় প্রতিটি স্থানে ছড়ানো প্রচারপত্রে জেএমবি নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে। মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলার প্রায় ৫০০ জায়গায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটেনি। সে সময়কার সরকারের সঙ্গে জেএমবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ ছিল। এরপর জেএমবি আদালতপাড়া থেকে সিনেমা হলÑ বোমা হামলা করে একের পর এক আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ওই সময়ের সরকার শুরুতে বলে আসছিল জঙ্গী মিডিয়ার সৃষ্টি; দেশে কোন জঙ্গী নেই। শেষ পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে। ঝালকাঠির দুই বিচারকের হত্যা মামলায় জেএমবি প্রধান আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, থিংক-ট্যাংক আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালাহউদ্দিনকে ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ফাঁসি দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে তখন জেএমবি অধ্যায়ের শেষ হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে তখনও স্বস্তি বোধ করতে দেখা যায়। কিন্তু এখন সেই জেএমবি আবার নতুন নামে, বলা হচ্ছে তামিম চৌধুরীই তাদের নেতা। তাহলে কি শঙ্কার শেষ নেই, নাকি স্বস্তি প্রকাশ স্থায়ী হবে না। তামিমের পর আবার নতুন কোন তামিমের জন্ম হবে না তো?
×