ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার থেকে সেলুন-বিউটিপার্লার গুরুত্বপূর্ণ?

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৯ আগস্ট ২০১৬

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার থেকে সেলুন-বিউটিপার্লার গুরুত্বপূর্ণ?

(শেষাংশ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে এর জন্য জায়গার প্রয়োজন পড়ে। সরকার প্রথমে জনতা টাওয়ারে ও পরে আবদুল গনি রোডের পুরনো এক ভবনে ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে মনস্থ করে। কারণ, এই বিচারকার্য সম্পর্কে মন্ত্রী বা আমলাদের কোন ধারণা ছিল না। সাধারণ ফৌজদারি হিসেবে তা ধরা হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রীকে অনেক অনুরোধ করেও ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তরের সুপারিশ পাওয়া যায়নি। তখন ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং শাহরিয়ার কবির এর প্রতিবাদ করি এবং লিখি এই জনকণ্ঠেই। আমাদের মূল বক্তব্য ছিল, দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম এ ধরনের বিচার হচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলের এটি অন্যতম কীর্তি। এ ধরনের অপরাধের বিচার হওয়া উচিত এমন এক ভবনে যার ঐতিহাসিকতা আছে, ভাবগাম্ভীর্য আছে। যে কারণে, নুরেমবার্গ বিচারের জন্য তাদের পুরনো ভাবগম্ভীর আলাদা ভবন বেছে নেয়া হয়েছিল। এ কারণে পুরনো গবর্নরের ভবনটিই উপযুক্ত। নিরাপত্তার দিক থেকেও। নির্মূল কমিটি থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই দাবি জানান হয়। আমি আরও অনুরোধ জানিয়েছিলাম, বিচার শেষে যেন এই বিচারের স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে একটি আর্কাইভ ও জাদুঘর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হওয়াতে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। বর্তমান আইনমন্ত্রীকেও চারবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম একটি কক্ষে আর্কাইভের কাজটি শুরু করে দেয়ার। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তা কার্যকর করেননি। সাধারণের সঙ্গে মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতারা প্রায় ক্ষেত্রেই এ রকম করেন। ফলে, আমরা বিস্মিত নই। এটি প্রয়োজনীয় কারণ, এটি আমাদের রক্তস্নাত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত ও আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতির আধার। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকন্যা যে অতুলনীয় কাজটি করে গেছেন তারও সাক্ষী থাকত এটি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে এবং প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়েই এখানে ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনাল শুরুর আগে এখানে ল’ কমিশন ও জুডিশিয়াল সার্ভিসের অফিস ছিল। সে জন্য প্রধান বিচারপতির অনুমতি নেয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, এখানেও ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও বিচার সংশ্লিষ্টদের জন্য জায়গা হচ্ছে না। অসুবিধা প্রচুর, তবুও ইতিহাস ও জাতির প্রতি দায়বোধ থেকে ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করে যাচ্ছেন। ॥ তিন ॥ প্রধান বিচারপতির এই নির্দেশকে সন্দেহের চোখে দেখার অনেক কারণ আছে। আদালতে তিনি নিজ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা এই সন্দেহের উৎস। তিনি বলেছিলেন, তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। এটি সরল স্বীকারোক্তি। তিনি অন্য পদে থাকলে এ নিয়ে তেমন কথা উঠত না। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের আপীল তিনি শুনছেন। সেখানে কনফ্লিকট অব ইন্টারেস্টের প্রশ্ন ওঠে। নৈতিকতারও। সে জন্য প্রায় সবাইকে উপদেশ দেয়া ও বিভিন্ন মন্তব্য করা উচিত নয়। সরকার যেখানে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সেখানে সরকারের এই নিয়োগ, সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। প্রশ্ন উঠছে এবং উঠবেই, কেন তিনি এমন নির্দেশ দিলেন? তখন অনেক প্রসঙ্গ চলে আসে। আসলেই কি জায়গার অপ্রতুলতা এর কারণ না অন্তর্নিহিত বিরাগ এই নির্দেশের ভিত্তি? এতো বোঝা নিয়ে নির্বিঘেœ বিচার করা দুরূহ। বর্তমান ট্রাইব্যুনাল তো সুপ্রিমকোর্টের অংশ। যারা বিচার করছেন এবং এর সঙ্গে জড়িত তারা আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিচারক তিনজন হাইকোর্টের। সুতরাং তিনি যে বলছেন, কর্মচারী ও বিচারকদের জায়গার প্রয়োজনে এটি সরাতে হবে তা যৌক্তিক বিচারে টেকে না। এদের সরিয়ে যাদের দিতে চান তারা তো আবার হাইকোর্টেরই হবেন। আর এ বিচার তো সুপ্রিমকোর্টের বিরাট অর্জন। এ অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কী দরকার? সড়ক ভবনে যে জায়গা তা সুপ্রিমকোর্টের ব্যবহৃত জায়গার আয়তনের তুলনায় কম নয়। জায়গার অপ্রতুলতার যুক্তি দিয়েই তো তা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে এজলাস ও বিচারকদের ব্যবস্থা কেন করা হয়নি এ প্রশ্ন এখন চলে এসেছে। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে, সেলুন, বিউটি পার্লার, খেলার ঘর, জিমনেশিয়াম, ব্যাংকোয়েট হল, অডিটোরিয়াম [সুপ্রিমকোর্ট ভবনে একটি অডিটোরিয়াম আছে] যা মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হবে, জাদুঘর প্রভৃতি। এসব করার সময় বিচারক বা কর্মচারীদের বসার কথা মনে হয়নি কোন প্রধান বিচারপতির। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারটি চোখে লাগছে। রবীন্দ্রনাথ কি না বুঝে ‘দুই বিঘা জমি’ লিখেছিলেন? এগুলো সরিয়ে সেখানে কেন বিচারক ও সংশ্লিষ্টদের জায়গা করা হচ্ছে না? এ প্রশ্নের জবাব কী হবে? কথায় কথায় ‘আইনের হাত লম্বা’, ‘কনটেম্পট অব কোর্ট’ করে কি আর সব প্রশ্ন চাপা দেয়া যায়? আর এসব জবরদস্তি মানুষ নিতান্ত অপছন্দ করে। বিশ্বের কোন সুপ্রিমকোর্ট কথায় কথায় আদালত অবমাননা বলে মানুষের কণ্ঠ রোধ করে না। কেননা তারা নিজেদের ইনসিকিউরড ভাবে না। নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে তাদের মনে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আমাদের এখানে যে প্রক্রিয়ায় এ ধরনের নিয়োগ হয় তাতে দ্বন্দ্ব থাকাই স্বাভাবিক। যা হোক, প্রশ্ন জাগছে, তাহলে কি ধরে নিতে হবে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার থেকে বিউটি পার্লার, সেলুন বেশি জরুরী? বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আগেই বলেছি, যে দেশে অনেক মানুষ এখনও পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন সেখানে নানা অজুহাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বাধাগ্রস্ত হবে। ১৯৭৫ সালের পর এদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, উচ্চপদে গেছে। এখনও খুব একটা ব্যতিক্রম হয়েছে কি? নিজেদের কথা বলি। সামরিক শাসনের সময় শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য আবেদনপত্রে স্বাক্ষর না করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন যিনি, শেখ হাসিনা তাকে দু’বার উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাকে কখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হয়ে সোচ্চার হতে দেখিনি তিনি উপাচার্য হয়েছেন, আর যারা শেখ হাসিনার জন্য স্বাক্ষর যোগাড়ে উদ্যোগী ছিলেন তাদের পশ্চাৎদেশে লাথি জুটেছে। জাতীয় জাদুঘরে যারা ট্রাস্টি থাকার সময় জিয়া কর্নার হয়েছে এ সরকারের মন্ত্রীরা কি তাদেরই বার বার ট্রাস্টি করেনি? শাহরিয়ার কবিরের প্রামাণ্যচিত্রে ব্রিটিশ এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনাল গণআন্দোলনের ফলে হয়েছে যা এক ইউনিক ঘটনা। কোন ধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নয়। বাইরের লোকজন বোঝেন আমাদের দেশের কিছু লোক বোঝেন না বা বুঝেও বুঝতে চান না। যাক, ফিরে আসি পুরনো প্রসঙ্গে। আমরা মনে করি, জাতীয় স্বার্থে প্রধান বিচারপতির নির্দেশ প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। না হলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হবে এবং সুপ্রিমকোর্টকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি করা হবে। এটি আমাদের কাম্য নয়। একটি কথা মনে রাখা দরকার, আমরা যারা এ দাবি করছি তারা দীর্ঘদিন গণতন্ত্রায়ন ও মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাস অটুট রাখার আন্দোলন করছি। আমাদের কারণেই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। যারা পদে আছেন তারা কখনও কোন কিছুর জন্য সংগ্রাম করেননি। সুতরাং অন্যায় নির্দেশ দিলেই তা মানতে হবে এটি ভাবা ঠিক নয়। আমাদের মনে হয়েছে এ ধরনের নির্দেশ মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের বিরুদ্ধবাদীদের হাত জোরদার করবে, জঙ্গীদের উৎসাহ দেবে। জিয়াউর রহমান শিশুপার্ক করেছিলেন পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের স্মৃতি মুছে দেয়ার জন্য এবং তাতে সফল হয়েছেন। এই ভবন থেকে বিচার স্থানান্তরে অর্থ শেখ হাসিনার অতুলনীয় কীর্তির স্বাক্ষরটি অপসারণ, আর কিছু নয়। তিন দশক আগে আমি দুটি লেখা লিখেছিলাম, মনে হচ্ছে, এখনও তা প্রাসঙ্গিক। একটিতে লিখেছিলাম বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। অন্যটিতে ছিল যে দেশে রাজাকার বড়। কেননা তারা এত প্রভাবশালী যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনও তাদের তোয়াজ করে ধন্য হয়। তাতে অবশ্য ইতিহাসের কিছু আসে যায় না। ইতিহাস বলে, যে একবার রাজাকার সে সবসময়ই রাজাকার।
×