ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ র. ই. শামীম

বন্যা ঝুঁকিতে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৮ আগস্ট ২০১৬

বন্যা ঝুঁকিতে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা

বাংলাদেশে প্রতিবছরই বন্যা হয়। বন্যা বাংলাদেশের চিরচেনা নিয়মিত এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশকে প্রতিবছরই বন্যার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়। অতীতকাল থেকেই বন্যা এদেশের কৃষি, কৃষকের জানমাল, জনস¦াস্থ্য, অবকাঠামো, জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। কোন কোন বছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি সহনশীল মাত্রায় থাকলেও কয়েক বছর পর পর সৃষ্ট বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে লেগে যায় আরও কয়েক বছর। প্রতিবছরের মৌসুমী বন্যা, আকস্মিক বন্যায়ও আমাদের কৃষিখাত ও কৃষক নানাভাবে ক্ষতির শিকার হয়। কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হয় বন্যার কারণে। প্রতিবছর নিঃস্ব হয় বহু কৃষক। ফসলের ক্ষেত, নদীপাড়ের জমি, ঘরবাড়ি, গাছপালা সবই নদীতে বিলীন হয়। ধানের ক্ষেত তলিয়ে যায়, বীজতল, মৎস্য ও পশুসম্পদ ধ্বংস হয়। এসব ক্ষতির সঠিক অর্থনৈতিক পরিমাপ করাও কঠিন। সাধারণত প্রতি দশ বছরে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) মতে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বন্যা ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ৬ষ্ঠ অবস্থানে আছে। চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান হতে ৫৭টি আন্তঃদেশীয় নদী বাংলাদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা রিভার সিস্টেমের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার শতকরা ৯৩ ভাগই বাংলাদেশের বাইরে। এসব এলাকার প্রচুর বৃষ্টিপাত ও অতিবৃষ্টির পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো বিস্তৃত নদীগুলোর কূল উপচে তখন দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। অসময়ের ঢলে কখনও দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা, তলিয়ে যায় ফসল, জনপদ। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকাই প্লাবন ভূমি। এসব এলাকা বন্যার পানিতে সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে বসবাসরত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাই খুব সহজেই বন্যার নানা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সাধারণত ভয়াবহ বন্যায় দেশের ৬০ ভাগের অধিক এলাকা তলিয়ে যায়, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং গড়ে এক তৃতীয়াংশ এলাকা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দেশে বন্যায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় কৃষিখাত। অতীতকাল থেকেই তা হয়ে আসছে। অতীতের ভয়াবহ বন্যায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে এ বাংলায় লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। ১৮২২ সালের (বাংলা ১২২৯ ) ভয়ঙ্কর বন্যায় ১ লাখ মানুষ মারা যায়। কৃষি প্রধান এ বাংলার সর্বস্ব বার বার কেড়ে নিয়েছে বন্যা। এক মৌসুমে কখনও দুই দফা বন্যাও হয়। সাম্প্রতিক ২০০৭ সালের বন্যায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৪ হাজার ৪৮১ টন। এর আর্থিক মূল্য প্রায় পাঁচ দশমিক ৯ বিলিয়ন টাকা। এই বছর দেশের ৪২ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এছাড়া ২০০৪ সালের বন্যায় শতকরা ৩৮ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে যে বন্যা হয়েছিল তাতে শতকরা ৬৮ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এর ফলে কৃষি উৎপাদন শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ কম হয়েছিল। এ বন্যায় খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২১৮ লাখ টন। ৬৫ হাজার হেক্টর জমি দীর্ঘদিন বন্যায় তলিয়ে ছিল। আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। ১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবনে ফসলের ক্ষতি হয় ২০ লাখ টন। দেশের ৬১ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। সম্পদ নষ্ট হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকার। এক কোটি কৃষক ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। এই বছর দেশের ১৬টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এবং প্রায় ৩৪ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্গত হয়েছে। এই বন্যায় জামালপুর জেলায় বন্যার পানি কোন কোন স্থানে ১৯৮৮ সালের চেয়েও বেশি হয়েছে। এ বছর আবারও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পেছনের অন্যতম আরেকটি কারণ, বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম জনাকীর্ণ দেশ। যেখানে শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। ৬০ ভাগ মানুষ কৃষিখাতে সরাসরি জড়িত। কর্মজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্রও কৃষিখাত। শতকরা প্রায় ৪৯ ভাগ শ্রমজীবীর কর্মসংস্থান কৃষিক্ষেত্রে। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকার এখাত বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে আছে সবসময়। এটাই আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের চলতে হচ্ছে বিধায় আমরা এখনও অর্থনৈতিক সফলতাকে টেকসই করতে পারি নাই। বন্যা আমাদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও স্বপ্নকে বার বার ভেঙ্গেচুড়ে আরও নাজুক অবস্থায় ঠেলে দেয়। বিপুল জনগোষ্ঠীর কৃষিখাত বার বার লোকাসানে পড়ে। যদিও এ রকম আরও বাস্তবতায় এ খাতে যারা আছেন তারা বাধ্য হয়েই আছেন। তারাই টিকিয়ে রেখেছেন অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষিখাতকে। ১৯৫৬ সালে বন্যানিয়ন্ত্রণে ক্রুগ কমিশনের মন্তব্য ছিল ‘এদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে বন্যা। তাই ভবিষ্যতের সকল কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল বিষয় হওয়া উচিত বন্যানিয়ন্ত্রণ।’ এখনও বন্যা বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাই রয়ে গেছে। এজন্য আমাদের কৃষক ও কৃষিখাতকে বাঁচাতে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে বন্যা ব্যবস্থাপনাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ কৃষক সমাজই এখনও আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় প্রধান ভরসা। তারাই এদেশের অর্থনীতির প্রকৃত নায়ক।
×