ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাকুড়িয়া গণহত্যা দিবস আজ

বুকে স্বজন হারানোর কষ্ট- বেঁচে আছেন সংগ্রাম করে

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৮ আগস্ট ২০১৬

বুকে স্বজন হারানোর কষ্ট- বেঁচে আছেন সংগ্রাম করে

বিশ্বজিৎ মনি ॥ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। আজও মেলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বীকৃতি। পাকুড়িয়া গণহত্যায় শহীদ কয়েকজনের স্ত্রীর জীবন চলছে অতিকষ্টে। জোটেনি বয়স্ক কিংবা বিধবাভাতাও। বয়সের ভারে ন্যুব্জ অনেকে বেঁচে আছেন অন্যের কৃপায়। এ অবস্থায় আজ রবিবার বর্বরোচিত পাকুড়িয়া গণহত্যা দিবসের ৪৫তম বার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে নওগাঁর মান্দার পাকুড়িয়া গ্রামের বধ্যভূমিতে। একাত্তরের ২৮ আগস্ট। বাংলা ১১ ভাদ্র। শনিবার। কাকডাকা ভোর। এদিন পাকহানাদার বাহিনী নওগাঁর মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। এ হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন এলাকার ১২৮ জন মুক্তিকামী মানুষ। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন ১৮ জন। তাদের একজন মমতাজ উদ্দিন। কোমরে বুলেট নিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন। পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ে অফিস সহকারীর চাকরি করতেন। গত বছরের ৩০ জুন চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তিনিই জানালেন, গণহত্যার সেই বর্বরতার কথা। মমতাজ উদ্দিন জানান, প্রতিদিনের মতো সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় সবেমাত্র ঘুম ভাঙছে গ্রামবাসীর। হঠাৎ গুলির শব্দ। গ্রামবাসী ঠিক ঠাহর করতে পারেন না, কোথায় এ অশনিসঙ্কেত। গ্রামের স্কুল মাঠের দিকে নয় তো! এরপর আর ফুরসত নেই। ততক্ষণে বন্দুকের নল উঁচিয়ে পাকি সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়েছে গ্রামের ভেতরে। একটু চালাকি করলেই বুক ভেদ করবে ঘাতকদের বুলেট। নিরুপায় গ্রামবাসী বন্দুকের নলের ইশারায় হাঁটতে থাকে গ্রামের স্কুল মাঠের দিকে। যুবক থেকে বৃদ্ধ প্রায় সকলকেই সমবেত করা হয় সেখানে। তাদের বুঝতে বাকি থাকে না, কী ঘটতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্যে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মমতাজ উদ্দিন জানান, মিটিংয়ের নামে মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর সারিবদ্ধভাবে বসানো হয় তাদের। শ্মশানের মতো নিথর মাঠ। হঠাৎ অচেনা ভাষায় গর্জে উঠল মেজরের কণ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগান হাতে মাঠে শুয়ে পড়লেন কয়েকজন ঘাতক কমান্ডার। মেজরের নির্দেশ মাত্রই গর্জে উঠল মেশিনগান। চারদিক থেকে নামে গুলির বৃষ্টি। মুহূর্তে রক্তের বন্যায় ডুবে যায় মাঠের সবুজ ঘাস। সেদিন শরীরের বিভিন্ন স্থানে চারটি গুলি লাগলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ছাবেদ আলী (৬৫)। এ হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন তার বাবা লহির উদ্দিন ও ভাই আবেদ আলী। এদিন গুলিবিদ্ধ হাছেন আলী, আশরাফুল ইসলাম, আফসার আলী, আফজাল হোসেন, ইমান আলী ও নাছের উদ্দিন পঙ্গুত্ব বরণ করে কালের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন। পঙ্গুত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করে ইতোমধ্যে শমসের আলী, হেদায়েতুল্লা, জোনাব আলী, মেরুল্লা শাহ, আকন্দি, গাবু পাথর, নসরতুল্লাসহ অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সেদিনের হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন নহির উদ্দিন, সাবির উদ্দিন, মসলেম উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, মহির সরদার, আব্বাস আলী, ফজের আলী চৌকিদার, সরুজ ম-ল, ঝরু ম-ল, বজের পাথর, প্রফুল্ল দেওয়ান, মাদার বক্সসহ ১২৮ জন। ঘাতকরা এদিন ফজের চৌকিদারের বিধবা মা বুলন বেওয়াকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। বধ্যভূমির সরকারী একটি ফলক থেকে জানা যায় এসব তথ্য। তবে ১২৮ জনের মধ্যে ৭৩ জনের নাম দেখা গেলেও বাকিদের পরিচয় উল্লেখ নেই ফলকে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পাকুড়িয়ার এই শহীদ পল্লীতে সরকারের দৃষ্টি পড়েনি। বধ্যভূমির একপাশে মাত্র কয়েক বর্গফুট গণকবরে এসব শহীদদের সমাধিস্থ করা হয়। স্থানীয় উদ্যোগে গণকবরটি ঘেরা হয়েছে আড়াই ফুট উঁচু যেনতেন একটি ইটের প্রাচীর দিয়ে। সরকারী উদ্যোগে নির্মিত একমাত্র তোরণটি দেখে বোঝা যায় পাকি হানাদার বাহিনী সেখানে বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরা একবার পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান পেয়েছিলেন। এটিই তাদের প্রথম ও শেষ পাওয়া। গণহত্যার দিনটিকে স্মরণ করতে শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রতিবছর বাড়ি বাড়ি থেকে চাঁদা তুলে মিলাদ মাহফিল করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজও ‘শহীদ পরিবার কল্যাণ ব্যবস্থাপনা কমিটি’ এ বধ্যভূমিতে তাদের প্রিয় স্বজনদের স্মরণে দোয়া মাহফিল করবে। এখানে সরকারীভাবে কখনও পালন করা হয় না এ দিনটি!। এই মাটিতেই জন্ম বর্তমান পাট ও বস্ত্র মন্ত্রীর। তিনিও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখেন না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। শনিবার শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, ’৭১ থেকে আজোবধি তারা সংগ্রাম করেই বেঁচে আছেন। স্বজন হারানোর কষ্ট পাথরচাপা দিয়ে রেখেছেন বুকে। পাওয়া না পাওয়ার কথাও আর তুলতে চান না। তারা দাবি করেন, অন্তত এখানকার শহীদদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হোক। শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানালেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউএনওর দফতর থেকে এ লক্ষ্যে একটি তালিকা করা হয়েছিল। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি ওই তালিকা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুর রহমান খান জানান, শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে পাকুড়িয়া শহীদ বাজারে একটি মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদন না হওয়ায় সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফাইলটি এখন তার দফতরেই রয়েছে বলে জানান তিনি।
×