ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কে এই তামিম চৌধুরী ?

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৮ আগস্ট ২০১৬

কে এই তামিম চৌধুরী ?

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ পরিচয় দানকারী তামিম চৌধুরী অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটল। এখন অপর দুই মাস্টারমাইন্ড চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও নুরুল ইসলাম মারজান কোন্ জঙ্গী আস্তানায় লুকিয়ে আছে তার সন্ধান করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার হওয়া এক জঙ্গীর তথ্যের ভিত্তিতে না’গঞ্জের জঙ্গী আস্তানায় তামিম চৌধুরীর অবস্থান করার গোপন খবরে নিশ্চিত হওয়ার পর অপারেশন ‘হিট স্ট্রং ২৭’ পরিচালনা করা হয়। না’গঞ্জের পাইকপাড়ার জঙ্গী আস্তানায় তামিম চৌধুরীর সঙ্গে নিহত দুই জঙ্গীর একজন কল্যাণপুর আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গী ইকবালও রয়েছে। পাইকপাড়ায় যে দেওয়ান বাড়িতে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছিল ওই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল নিহত অপর জঙ্গী মানিক। হিট স্ট্রং ২৭ অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে আস্তানার নেপথ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর কাহিনী পাওয়া গেছে। শুক্রবার রাত আড়াইটায় পাইকপাড়ার দেওয়ান বাড়িটি ঘিরে ফেলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শনিবার সকাল নয়টা ৩৫ মিনিট থেকে অভিযান পরিচালনা করে সকাল দশটা ৩৫ মিনিটে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে ‘হিট স্ট্রং ২৭’ অপারেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। নুরুদ্দিন দেওয়ানের মালিকানাধীন দেওয়ান বাড়ির তৃতীয় তলায় অবস্থিত জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় গুলশান, শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও তার দুই সহযোগী জঙ্গী মানিক ও ইকবাল। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কানাডার পত্রিকা ন্যাশনাল পোস্টের এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী আইএসের কথিত ‘বাংলার খিলাফত দলের প্রধান’। তবে তার সাংগঠনিক নাম শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। তিনি কানাডা থেকে বাংলাদেশে গেছেন। গত ১৩ এপ্রিল আইএসের ‘কথিত’ মুখপত্র ‘দাবিক’-এর ১৪তম সংখ্যায় আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের (তামিম চৌধুরী) দীর্ঘ সাক্ষাতকার প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি করতে চায় আইএস। গুলশান, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন জঙ্গী হামলায় ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যাকা- ঘটার পর আইএস দায় স্বীকার করার নেপথ্য কারিগর বা কুশীলব বলে ধরে নেয়া হতো নিহত তামিম চৌধুরীকে। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার ঘটনা তদন্তে নেমে তামিমের ভয়ঙ্কর প্রকৃতি ও মাস্টারমাইন্ড পরিচয়ের তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তখনই নিখোঁজ ১০ তরুণের তালিকাতেও নাম দেখা যায় তার। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম বাংলাদেশে আসে। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল। তার পাসপোর্ট নম্বর এএফ-২৮৩৭০৭৬। পুরনো পাসপোর্ট নং এল-০৬৩৩৪৭৮। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ১৯৮৬০০৯১২৪১০০১৩৪২। জন্ম তারিখ ২৫ জুলাই ১৯৮৬। নতুন করে সংগঠিত জেএমবির অন্যতম নেতা তামিম। তার নেতৃত্বেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে জঙ্গীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের তথ্যমতে, জেএমবিকে নতুন করে সংগঠিত করে তামিম চৌধুরী। সে ছিল বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক। প্রায় তিন বছর আগে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসে সে। এরপর গত দুই বছরে জেএমবির বেশ কয়েকটি আলোচিত হামলার ঘটনায় নাম উঠে আসে তার। তবে গুলশান হামলার আগে তামিমের বিষয়ে তেমন কোন তথ্য জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রাম সাদিমাপুরের শফিক চৌধুরীর ছেলে তামিম। তার দাদার নাম আবদুল মজিদ চৌধুরী। তিনি একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তামিমের বাবা শফিক চৌধুরী চট্টগ্রামে জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পরিবার নিয়ে কানাডায় চলে যান। সর্বশেষ ২০০১ সালে সপরিবারে দেশে ফিরে আসেন তিনি। পরিবারের সঙ্গে কানাডার উইন্ডসরে থাকত তামিমও। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম বাংলাদেশে আসে। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল। দুবাই হয়ে তামিম চৌধুরী সিরিয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে আসে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ময়মনসিংহ থেকে আটক এক জঙ্গীর কাছে তথ্য পেয়েই পুলিশ নারায়ণগঞ্জের আস্তানার সন্ধান পায়। কল্যাণপুরে আস্তানায় থাকা জঙ্গীদেরই একটি অংশ পাইকপাড়ায় জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলে। অপর দুই জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়া ও নুরুল ইসলাম মারজান কোথাও না কোথাও জঙ্গী আস্তানা গড়ে তুলে লুকিয়ে আছে। ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয় সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার জন্যও। জিয়া আরেক জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতৃত্বে রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের নাম বলছে পুলিশ। এ দুই জঙ্গী মাস্টারমাইন্ডও নিহত তামিমের মতোই দেশের কোথাও না কোথাও গোপন আস্তানা গড়ে তুলে আত্মগোপন করে আছে, সে আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য অভিযান চলছে।
×