ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর আজিজুর রহমান

অভিমত ॥ অনৈতিকতা রোধে দরকার মানবিকতার জাগরণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৮ আগস্ট ২০১৬

অভিমত ॥ অনৈতিকতা রোধে দরকার মানবিকতার জাগরণ

বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানবিক দিকগুলো উপলব্ধিকল্পে নৈতিক আচার-আচরণ প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অনৈতিকতা রোধ করা সম্ভব। ধর্মের অপব্যবহার, রাজনৈতিক অসদাচরণ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, জঙ্গীবাদ ইত্যাদি দমন ও রোধকল্পে সকলকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, অন্যথা আমাদের প্রাচীনকালের দিকে ফিরে যেতে হবে। প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলেও মানসিক উন্নতি হয়নি। এজন্য বর্তমান বিশ্ব অনৈতিকতার সম্মুখীন। মানুষের মনুষ্যত্বের পাল্লা ভারি হলে তার কাছ থেকে সদাচরণ পাওয়া যায়। পাশবিকতার ওজন বেশি হলে তার কাছ থেকে পাশবিক আচরণ পাই। যুক্তিবিদ্যায় একটা কথা আছে গুণ (ঈড়হহড়ঃধঃরড়হ) বাড়লে পরিমাণ (উবহড়ঃধঃরড়হ) কমে । পরিমাণ বাড়লে গুণ কমে। মানুষ জন্মগ্রহণ করার পর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে এবং পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণ তার ওপর প্রভাব ফেলে। পারিবারিক দিকনির্দেশনা আত্মস্থ করতে থাকে। একটা শিশু জন্মগ্রহণ করার পর দেখল তার অভিভাবক অনৈতিক কাজে লিপ্ত। ফলে অনৈতিক উপকরণাদি সে সংগ্রহ করতে অভ্যস্ত হয়। সে যখন বড় হয়ে ওঠে তখন তার কাছ থেকে অপকর্ম পাওয়া যায়। অনৈতিকতা রোধকল্পে শিক্ষাকেই মুখ্য প্রতিষেধক হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। স্রষ্টা নিজেই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। মানবতাবোধ জাগ্রত করে অনৈতিকতা রোধে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন কর্যক্রমের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তোলা অভিভাবকদের দায়িত্ব। সামাজিকভাবে সেরকম মূল্যবোধ উদ্বুদ্ধকরণে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আচার-আচরণে ন্যায়নিষ্ঠা আনা সম্ভব। তরুণ প্রজন্মে স্বভাব পরিবর্তনে নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করে শিক্ষা। এজন্য একটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করে তার ভবিষ্যত প্রজন্মের নির্দেশনা। পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির বহুদিন পর পর্যন্ত কোন শিক্ষানীতি ছিল না। এ দেশে শিক্ষকরাই জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিলেন এবং এ অবস্থাতেও শিক্ষার কিছুটা মূল্যবোধ ছিল। নৈতিকতাবোধ নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশের এসব ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি স্তর আছে। এসব স্তরে শিক্ষকদের মান নিয়েও প্রশ্ন আসা স¦াভাবিক। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক অনৈতিকতায় লিপ্ত। শিক্ষার যে স্তরগুলো সরকার দেখভাল ও খরচ বহন করে সে অংশে সুষ্ঠু তদারকির ব্যবস্থা থাকা উচিত। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সচেতন থাকা দরকার। বিশেষ করে প্রতিটি স্তরে শিক্ষার মান মূল্যবোধের মাধ্যমে যাচাইয়ে যত্নশীল হওয়া উচিত। বাংলাদেশে অন্যতম শিক্ষার স্তর ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থাধীন আলীয়া মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু কওমী মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে কি? বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা এবং পাঠ্যসূচী সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরোপুরি অবহিত নয়। সরকারের কাছে মাদ্রাসাগুলোর জবাবদিহি করতে হয় না। আমার জানা মতে, একজন ব্যক্তি একটি মাদ্রাসা চালায় এমনও আছে। তার মাসিক আয় প্রায় দুই লাখ টাকা। কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। এমন অনেক মাদ্রাসা আছে যারা সরকারের অধীন হতে চায় না। কারণ তাদের বিশাল আয়ের ফিরিস্তি সরকার না জানুক সেটাই তারা চায়। তাছাড়া এমন মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মের এবাদত-বন্দেগীর চর্চা কম হয়। অনেক শিক্ষার্থী বের হন যারা এবাদতে দৃষ্টি না দিয়ে ইহলৌকিক কর্মকা- নিয়েই ব্যস্ত থাকতে তৎপর। ফলে ধর্মের অপব্যবহার হরহামেশা দেখা যায়। ধর্মকে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থে থাকে ব্যস্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নিবন্ধনকল্পে এ জাতীয় মাদ্রাসাগুলো তদারকির ব্যবস্থা করা। এ জাতীয় মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। সরকার সব কিছুতে দেখভাল করার অধিকার রাখে। কওমী মাদ্রাসার যে অংশ সরকারের অধীনে আসতে নারাজ তাদের নিয়ম-শৃঙ্খলার স্বার্থেই আয়ত্তে আনতে হবে। কারণ ইচ্ছামাফিক দেখাশোনা করার দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে সরকারের ওপর ন্যস্ত। যারা সরকারের ইচ্ছাকে অবমাননা করে তাদের ইমানে ঘাটতি রয়েছে। যে নাগরিক যে দেশে বাস করে ইসলাম ধর্ম অনুসারে সেই দেশের সরকারের ওপর আস্থা স্থাপন ইমানেরই তাগিদ। তাই আমাদের দেশের যে মাদ্রাসাগুলো সরকারের অধীনে আসতে চায় না সেগুলোকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তদারকির সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তাহলে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব। কোচিং সেন্টার, ইংলিশ মিডিয়ামেও সরকারের তদারকির ব্যবস্থা থাকা দরকার। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সনদ তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার না করে সময় উপযোগী শিক্ষাসূচীর প্রচলনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত। রাজনৈতিক আদর্শ স্বচ্ছ হলে বিশ্বে অনৈতিকতা রোধ করা যাবে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করায় অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কল্যাণ সাধিত হয় না। ফলে মানবতাবোধের অবক্ষয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। তাই সমাজে সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, যৌন হয়রানি ইত্যাদি সংঘটিত হয়। সুতরাং রাজনীতিবিদদের স্বশিক্ষিত হয়ে দেশ পরিচালনার আদর্শকে সমুন্নত রেখে মানুষের কল্যাণ সাধনে তৎপর হলে মানবতাবোধ জাগ্রত হবে। অনৈতিকতা রোধে তা রাখবে বড় ভূমিকা। লেখক : শিক্ষাবিদ
×