ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সোলার প্যানেল বেদে বস্তিতে

ঝুপড়িতে বিদ্যুতের আলো ঘুরছে পাখা, চলছে টিভি- উন্নত জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৭ আগস্ট ২০১৬

ঝুপড়িতে বিদ্যুতের আলো ঘুরছে পাখা, চলছে  টিভি- উন্নত জীবন

সমুদ্র হক ॥ বেদেদের জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। এরা আর অন্ধকারে নেই। পথের ধারে ঝুপড়ির মতো ঘরেও সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুতের বাতি জ্বালিয়েছে। এই ঘরে এরা টেলিভিশন দেখছে, পাখা ঘুরাচ্ছে। এদের অনেকে এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এদের দেখে সাধারণ মানুষ যতই টিপ্পনি কাটুক তার পরোয়া করে না। গালি দিলে তেড়ে আসে। বগুড়া নগরীর উপকণ্ঠে শাকপালায় বেদেদের বস্তিতে দেখা গেল প্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের কতটা ছোঁয়া পড়েছে তাদের জীবনে। ডাঙ্গার বেদেরা এখন আর নৌকায় থাকে না। একটা সময় নদী তীরেই এরা ঘরবসতি গড়ত। নদীর ঘাটে বেদের বহর এলে তারা মিশে যেত। দিনে দিনে বহরেরও পরিবর্তন হয়েছে। উপকূলীয় এলাকা ছাড়া বেদেদের নৌকার বহর তেমন দেখা যায় না। উত্তরাঞ্চলে বড় নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা এবং বাঙালী, নাগর, ইছামতি, যমুনেশ্বরী ইত্যাদি শাখা নদীর কোন ঘাটে বেদেদের বহর এসে ভিড়ত। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে নদ-নদীগুলোর ওপর। বেশির ভাগ নদীতে চর পড়েছে। শুকিয়ে গেছে। বেদেদের যাযাবর জীবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বেদেরা এখন আর কূল খুঁজে পায় না। এদিকে নগরায়ণের অগ্রযাত্রায় বেদেরাও ছুটছে শহর ও নগরীর দিকে। ছুটলেই তো হবে না, এদের আবাসনের ব্যবস্থা কে করবে! এরা সেদিকে তাকায় না। নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নেয়। প্রথমে মহাসড়কের ধারে কোন পরিত্যক্ত জমি খুঁজে নেয়। সেখানে কিছুদিন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেয়। কেউ কিছু না বললে এরা চাটাই দিয়ে নৌকার ছইয়ের মতো ঝুপড়ি বানিয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে আশ্রয় নেয়। মাটির চুলা বনিয়ে খড়কুটা কুড়িয়ে এনে রান্না করে। দিনভর এরা ঘুরে বেড়ায় শহরে ও গ্রামে। নারী বেদেরা ছোট বাক্সে সাপের ছানা ভরে দল বেঁধে এদিকে সেদিক ঘোরে। নীরবে নিভৃতে এদের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নারী বেদেদের অনেকে কাচের কাঠের বাক্সে চুড়ি ফিতা প্রসাধন নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যবসা করে। অনেকে আচরণ পাল্টে শহরের বাসাবাড়িতে কাজও করে। তবে এরা যে বেদে তা পরিচয় দেয় না। বেদে জুলেখা বলল, তাদের আসল পরিচয় শুনলে বাসাবাড়ির লোকজন সাপ আছে ভেবে কাজ দিত না। বস্তিতে থাকার পরিচয় দিলে গৃহকর্ত্রীরা কাজে নেয়। পুরুষ বেদেরা দিনমজুরি করে। অনেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালায়। এরা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হয়ে ড্রাইভিং শিখেছে। কেউ রিক্সা ঠেলা চালায়। এখন আর এদের দেখে সহজে চেনা যায় না কে বেদে আর কে বেদে নয়। বেদেদের সর্দার লিটন মিয়া জানালেন, কিশোর বেলায় নৌকায় থাকতেন। যুবক হওয়ার পর বেদেদের মধ্যে নেতাগিরি শুরু করেন। পরে বেদেরাই তাকে সর্দার বানায়। লিটন মিয়ার বয়স প্রায় ৪২। বেদে মেয়ে লতিফনকে বিয়ে করেছে। তার এক মেয়ে। সে শুনেছে সরকার দলিত সম্প্রদায়ের লোকজনকে বিভিন্ন পেশার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। লিটন বলল, সর্দার হিসেবে তার দায়িত্ব নিজে প্রশিক্ষণ নেবে অন্যদের প্রশিক্ষণ নিতে বলবে। বগুড়ার শাকপালায় আশ্রয় নেয়ার পর জীবনমান উন্নয়নে এরা ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে। শহরের বিদ্যুতের সরঞ্জামের দোকান থেকে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারি কিনে আনে। প্রতি ওয়াট সোলার প্যানেল কিনেছে ৭০ টাকা দরে। এই বস্তিতে কারও ঘরে এক শ’ কারও ঘরে দেড় শ’ ওয়াটের সোলার প্যানেল আছে। নিজেদের রোজগার থেকেই তারা সোলার প্যানেল কিনেছে। তবে এ সোলার তারা উপরে টাঙ্গাতে পারে না। ঝুপড়ি ঘরের কাছেই মাটিতে প্যানেলটি রাখে। হেসে বললেন, ছাদ কোথায় যে ছাদে রাখব! কথাটি রূপক অর্থের মতো। আসলে বেদেদের মাথার ওপর ছাদ কোথায়! তবু তারা জীবনমান উন্নয়নে সোলার প্যানেল বসিয়ে ঘরের বাতির সঙ্গে জীবনের আলো জ্বালিয়েছে। বেদে পরিবারে এখন টেলিভিশন আছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- কাছের কোন কেবল অপারেটরের কাছ থেকে তারা কেবল সংযোগও নিয়েছে। তারা এখন বিদেশী চ্যানেলও দেখে। অনেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করে। বেদেদের বিষয়ে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বললেন, চলতি বছর থেকেই দলিত সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বগুড়ায় হরিজন রবিদাস (মুচি) নাপিত হিজড়াদের ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ চলছে। অন্যান্য জেলার বেদেদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। বগুড়ায় পরবর্তী পর্যায়ে বেদেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বেদে সর্দার লিটন মিয়ার কথা- তাদের আর সাপ খেলা দেখানো, টোটকা চিকিৎসা শিকড়-বাকড় বেচতে ভাল লাগে না। তারাও চায় সমাজের আর দশজন মানুষের মতো সম্মানের সঙ্গে থাকুক। সোলার প্যানেল বেদেদের সেই জীবনেরই আলো জ্বালিয়েছে।
×