ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে দেয়া অনুদান নিয়ে নতুন বিতর্কে ইউনূস

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৭ আগস্ট ২০১৬

ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে দেয়া অনুদান নিয়ে নতুন বিতর্কে ইউনূস

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সঙ্গে যারা ব্যক্তিগত কারণে দেখা করেছেন, তাঁদের বেশিরভাগই হিলারির পারিবারিক দাতব্য সংস্থা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়েছেন। এসব ব্যক্তির মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামও রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘটনাপঞ্জির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এ তথ্য জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে অনুদানের এই অর্থ নিয়ে সারাবিশ্বে এখন চলছে তুমুল বিতর্ক। গ্রামীণ ব্যাংকের কোন কোন সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে এই অর্থ দেয়া হয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশেও নতুন করে ইউনূস বিতর্ক শুরু হয়েছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প শিবির ক্লিনটন ফাউন্ডেশন ইস্যুতে হিলারিকে চাপে ফেলতে চাইছে। নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে অর্থ দিয়েছেন এমন দাবি করে ট্রাম্প এ নিয়ে তদন্তের দাবি করেছেন। তবে এপির এই প্রতিবেদনের বিষয়ে গ্রামীণ আমেরিকা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। গ্রামীণ আমেরিকা বলেছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত একটি স্বাধীন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে গ্রামীণ আমেরিকার দেয়া সব করযোগ্য অর্থই প্রদান করা হয় ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ বার্ষিক সভায় যোগদানের ফি হিসেবে। এসব সভায় গ্রামীণের করা অঙ্গীকারগুলো গ্রামীণ আমেরিকার স্বাধীন কর্মসূচীবিষয়ক এবং তার সঙ্গে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের আর্থিক লেনদেনের কোন সম্পর্ক নেই। অনুরূপ একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি উদ্ধৃত করে বলা হয়, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে গ্রামীণ আমেরিকাকে উল্লেখ করা হয়েছে একান্তই সদস্যপদ, স্পনসরশিপ ও কনফারেন্স ফি বিভাগে চাঁদাদানকারী হিসেবে। ওয়েবসাইটের কোথাও মুহাম্মদ ইউনূসকে দাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে দেয়া সর্বশেষ সাক্ষাতকারে হিলারি ক্লিনটন বলেন, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এলি উইজেল বা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে তাঁদের কাজ নিয়ে কথা বলতে শুধু তিনি কেন, যেকোন পররাষ্ট্রমন্ত্রীই আগ্রহী হবেন। এমন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগকে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অর্থের বিনিময়ে সাক্ষাত বলে বর্ণনা করেছেন, হিলারি তা হাস্যকর বলেও উড়িয়ে দেন। এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় হিলারি ক্লিনটন যেসব বেসরকারী অতিথির সঙ্গে সাক্ষাত করেন, তাদের অর্ধেকের বেশি ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের আশায় ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়েছেন। এ প্রতিবেদনে যাদের নাম রয়েছে তাঁদের অন্যতম ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গবেষণা সংস্থা এপির ওই প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিমূলক বলে বর্ণনা করেছে। উদারনৈতিক হিসেবে বিবেচিত গবেষণা সংস্থা মিডিয়া ম্যাটারস বলেছে, ইউনূস যেসব সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেগুলো ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ৩ লাখ ডলার দিয়েছে। তবে এ অর্থের প্রায় সবটাই ছিল ফাউন্ডেশন প্রতিবছর যে ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক বৈঠকের আয়োজন করে, তাতে অংশগ্রহণের ফি হিসেবে। ক্লিনটন দম্পতির সঙ্গে ড. ইউনূসের পরিচয় দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে মিডিয়া ম্যাটারস বলেছে, ক্লিনটন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকে এ সম্পর্ক শুরু। ১৯৮৩ সালে বিল ক্লিনটন যখন আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের গবর্নর ছিলেন, তখন তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইউনূসকে সেখানে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে পরিচিত হন। পত্রিকা পলিটিকো লিখেছে, বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব থেকে ইউনূসকে অপসারণ করার পর তিনি হিলারির সাহায্য চেয়েছিলেন। তাঁকে সাহায্য করে হিলারি ঠিক কাজ করেছেন, তা না লিখে এপির প্রতিবেদনে তাকে ‘হিলারির দুষ্কর্মের সাথী’ হিসেবে দেখানো খুবই বিস্ময়কর। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণের আরেকটি উদ্যোগ ‘গ্রামীণ রিসার্চ’ও (যার চেয়ারম্যান ড. ইউনূস) ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দেয়। তবে গ্রামীণ আমেরিকার মুখপাত্র বেকি এ্যাশ বলছেন, ফাউন্ডেশনের সিজিআই সম্মেলনে অংশগ্রহণের ফি হিসেবেই ওই অর্থ দেয়া হয়েছে। এই হিসেবে ড. ইউনূস যদি ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে সর্বোচ্চ তিন লাখ ডলারও দিয়ে থাকেন, তাতে বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এপির তথ্য অনুযায়ী, হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ড. ইউনূস তাঁর সঙ্গে তিনবার দেখা করেছেন এবং কয়েকবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময় মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাংলাদেশ সরকার চাপ দিচ্ছিল। এ কারণে তিনি হিলারির সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চেয়েছিলেন। আর হিলারি তাঁকে সাহায্য করার পন্থা খুঁজে বের করতে সহকারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এপি বলছে, এ সময় গ্রামীণ আমেরিকা (যে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. ইউনূস) ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ১ লাখ থেকে আড়াই লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। এদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত কারণে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দেখা করা বা ফোনে আলাপ করা ১৫৪ জনের মধ্যে ৮৫ জনই তাঁদের পারিবারিক ওই ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়েছেন। তাঁদের মোট অনুদানের পরিমাণ ১৫ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। এপি বলছে, হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি বা ফোনে ব্যক্তিগত কারণে আলাপ করেছেন আর যাঁরা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দৃশ্যত একটি যোগসূত্র রয়েছে। এর ফলে মার্কিন কোন আইন ভঙ্গ হয়নি। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে এমন একটি ইঙ্গিত রয়েছে যে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাক্ষাতের বিনিময়েই যেন তাঁরা ওই অনুদান দিয়েছেন। তবে হিলারি ক্লিনটনের মুখপাত্র ব্রায়ান ফ্যালোন এপির এ বিশ্লেষণকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, হিলারি ক্লিনটনের বৈঠকগুলোকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং তাঁকে একপক্ষীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের প্রথম অর্ধেকটা সময় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, পুরো সময়টা নয়। এদিকে এই ঘটনার জেরে সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলছেন, এখন এটা বোঝা খুবই কঠিন যে, কোথায় ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের শেষ আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শুরু। কারণ হিলারি ক্লিনটন পাবলিক অফিস ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের আমেরিকান শাখা গ্রামীণ আমেরিকা ২০০৫ সালের শুরুর দিক থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভস’ (সিজিআই) কর্মসূচীর সঙ্গে কাজ করে আসছে। এর লক্ষ্য ছিল কয়েক মিলিয়ন ক্ষুদ্র ঋণের তহবিল গড়ে তোলা। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনূসের সঙ্গে ক্লিনটন পরিবারের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ২০০৯ সালে হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানে ভূষিত করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংককে ইউরোপের দেয়া তহবিল সরানোর অভিযোগ উঠার প্রেক্ষাপটে বয়সসীমা অতিক্রমের কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরানোর পর হিলারির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছিল। শুধু তাই নয়, ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের পদ হারানোর পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তার নানা প্রতিষ্ঠানকে ইউএসএআইডিসহ ১৮টি সংস্থার মাধ্যমে অনুদান, ঋণ কিংবা কাজ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া চেয়েও পাওয়া যায়নি বলে ডেইলি কলার জানিয়েছে। হিলারির প্রচার দল কিংবা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনও কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। এ বিষয়ে ডেইলি কলারের বক্তব্য হচ্ছে, ইউএসএআইডি যে অর্থ দিয়েছিল তা প্রধানত চুক্তি ও বিনিয়োগ এবং ছোট একটি অংশ অনুদান ছিল বলে ইউনূস সেন্টারের দাবিও নাকচ করেছে নিউজ পোর্টালটি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ওয়েবসাইটকে উদ্ধৃত করে তারা বলছে, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া ১৮টির মধ্যে ১২টি অর্থায়ন ছিল অনুদান এবং কেবল তিনটি ছিল ঋণ। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ১৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ‘স্বৈরাচারী কায়দায়’ ইউনূসের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন লেছে ডেইলি কলার। সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ‘সামরিক কর্মকর্তাদের দিকে ইউনূসের অতি আগ্রহ’ নিয়ে কিছু বলা থেকেও ইউনূস সেন্টার নীরব থেকেছে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রটি।
×