ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসন ;###;অনুবাদ : সালেহা চৌধুরী

একটি ফারগাছের কথা

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৭ আগস্ট ২০১৬

একটি ফারগাছের কথা

(গত সংখ্যার পর) ওদের চারপাশে জমে উঠবে ক্রিসমাসের নানা ধরনের উপহার। ভীষণ ভাললাগে ওদের দেখতে তখন। এই কথা শুনে বলে সেই ঘ্যানঘেনে ফারগাছÑ ইস এমন ঘটনা আমার জীবনে ঘটে না কেন। পাল হওয়ার চাইতে মজার ক্রিসমাসের গাছ হওয়া। এই জঙ্গলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। তোমার যা আছে তাই নিয়েই তোমার খুশি থাকা উচিত। বলে সেই চড়–ইয়ের দল। কিন্তু সেই বোকাগাছ এসব কথায় খুশি হতে পারে না। সারা গ্রীষ্ম সেই ফারগাছ বড় হতে থাকে। চারপাশে ছড়িয়ে দেয় ডালপালা। তারপর আবার আসে ক্রিসমাসের সময়। একটি কাঠুরে এসে ওকে ঠিক করে ক্রিসমাসের গাছ হতে, কুড়োলের প্রথম আঘাত করে ওর শরীরে। এরপর জ্ঞান হারায় সেই গাছ। কিছু মনে থাকে না। তারপর যখন জ্ঞান ফেরে চেয়ে দেখে ও চলেছে সেই ঠেলাগাড়িতে চেপে শহরের কোনখানে। আর শহরে এসে পৌঁছায় ক্রিসমাস গাছের দোকানে। একটি ছোট্ট মেয়ে ওর দিকে ইশারা করে বলেÑ এই গাছটিই আমার চাই। এইটিই আমার ক্রিসমাসের গাছ। দু’জন ঝকঝকে শার্ট-কোট পরা চাকরের মতো মানুষ গাছটিকে আর একটি ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এক বিশাল বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই বাড়ির বসার ঘরের দেয়ালে দেয়ালে নানাসব ছবি। বড় দামী সোফা। সোফায় সিল্কের কুশন। নানা সব ভেলভেটের গদিমোড়া চেয়ার। চাকরের একজন একটি বড় কাঠের টবে মাটি বালু দিয়ে পুঁতে রাখে ওকে। এরপর নানা সব রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয় গাছটিকে। ওর শরীরে ঝিকমিক করে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাগজের নানা নকশা। টুকরো টুকরো আলোর বাতি জ্বলে। ওর চারপাশে জমে ওঠে উপহারের নানা সব সামগ্রি। মাথায় ওপরে একটি বড় সোনালি তারা ঝিকমিক করে। এরপর কি হবে? ইস, আমার এই অপরূপ শরীর যদি শালিক ও চড়–ই দেখতে পেত। বলে সেই গর্বিত ফারগাছ। অরণ্যের অন্যান্য গাছ যদি আমাকে দেখতে পেত কি যে মজা হতো। ভাবে সেই বোকা ফারগাছ। আপাতত যে নিজের এই ঝকমকে রূপে খুব খুশি। খানিকপরে অনেক কয়জন ছোট্ট ছেলেমেয়ে ওর চারপাশে ওকে ঘিরে নাচে। খুশিতে বক বক করতে করতে। ওদের খুশি তাকিয়ে দেখে সেই ফারগাছ। ছেলেমেয়েরা ওদের নতুন উপহারের প্যাকেট খোলে। নতুন খেলনা পেয়ে দারুণ খুশি হয়। তারপর সব খেলা আনন্দ শেষ করে ছেলেমেয়েরা যে যার ঘরে চলে যায়। একজন এসে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে সেই ফারগাছ। মনে মনে ভাবে সেই ফারগাছÑ হয়ত কালকে আরও মজা হবে। ছেলেমেয়েরা আবার আমাকে ঘিরে খেলবে। আমার চারপাশে ঘিরে নাচবে। পরদিন সেই চাকর ছেলেটি ঘরে ঢোকে। যে ওকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। মনে মনে ভাবে ফারগাছ ওরা আমাকে আবার সাজাবে। কিন্তু সাজানোর বদলে চাকর ছেলে দুটো ওকে টানতে টানতে উপরতলার অন্ধকার ছাদ ঘরে রেখে দেয়। ঘরের এককোণে একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে সেই ফারগাছ। Ñএরপর কি হবে? ভাবে সেই ফারগাছ। আমি জানি এখন শীত। এরপরে বসন্ত এলে কি হবে। হয়তো ওরা আমাকে নিয়ে অন্য কিছু করবে। কিংবা মানুষ আমাকে নিয়ে সেই অরণ্যে পুতে আসবে। আমি আবার সেখানে ফিরে যাব। এখানে একা থাকার চাইতে অরণ্যে থাকা অনেক ভাল। এখানে আমার বড় একা একা লাগছে। দুটো ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ওর চারপাশে ছুটোছুটি করে। বলে ফারগাছের দিকে তাকিয়েÑ এটি একটি চমৎকার থাকার জায়গা তাই না ফারগাছ? আমি এখনও বুড়ো হইনি। এর চাইতে ভাল জায়গা আমি জানি। সে জায়গায় সূর্য ওঠে। গাছে গাছে বাতাস খেলা করে। পাখিদের গান শোনা যায়। গাছ ওর জীবনের গল্প করে। নেংটি ইঁদুরেরা মনোযোগে সে গল্প শোনে। পরদিন দুটো ধাড়ি ইঁদুর নিয়ে আসে গল্প শুনতে। কিন্তু ধাড়ি ইঁদুরেরা ওইসব বনঝোপ গাছপালার গল্প শুনতে চায় না। ওরা বলেÑ ওসব শুনে আমরা কি করব? এমন জায়গার গল্প কর যেখানে পনির আর রুটি পাওয়া যায়। তুমি কি খাবারের গন্ধভরা কোন রান্নাঘরের গল্প জান না? না। বলে সেই ফারগাছ। তাহলে আমরা চললাম। এই বলে ধাড়ি ইঁদুর নেংটি ইঁদুর সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। আমি এবার একেবারেই একা। বলে সেই ফারগাছ। Ñইঁদুরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল কি অপূর্ব ছিল আমার ফেলে আসা গাছপালা ও সূর্যের জগত। পাখিরা আমার ডালে বসত। আমি ওদের সঙ্গে গল্প করতাম। খরগোশ খেলা করত আমি খরগোশকে জানতাম। এসব গল্প এখন অতীতের ব্যাপার। আমার কি আবার সেই গাছপালার জগতে ফিরে যাওয়া হবে? এরপরে যে ঘটনা ঘটল সে এমন। কিছু লোক একদিন এলো সেই ছাদঘরে। তারা সেই কোনে চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে থাকা ফারগাছটিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাইরের উঠানে। বইরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে সেÑ এবার হয়ত আবার আমাকে পুঁতে দেবে ওরা মাটিতে। আমি আবার বড় হতে থাকব। ওরা গাছটিকে ভালমতো দেখে। শীর্ণ বাদামি পাতা। এই এখন সেই গাছের বর্তমান রূপ। কিছু ছেলেমেয়ে উঠোনে খেলতে খেলতে গাছের দিকে তাকিয়ে বলেÑ দেখ দেখ কি বিশ্রি আর বুড়ো এই গাছটি। এই হতকুৎসিত গাছের মাথার ওপর এখনও সেই বড় তারাটি ঝিকমিক করছে। এই বলে ওরা গাছের মাথা থেকে একটানে তারাটি কেড়ে নেয়। আর জুতো দিয়ে গাছকে লাথি মারে। ওদের জুতোর আঘাতে ফারগাছ মাটিতে মুখথুবরে পড়ে। মনে পড়ে সেই সবদিন যখন ও অরণ্যের সুঘ্রাণে বেড়ে উঠছিল। বলেÑ ইস তখন যদি আমি আমার অরণ্যের সবুজ সুন্দর দিনরাত উপভোগ করতাম, ঘ্যান-ঘ্যান প্যান-প্যান না করতাম তাহলে কত ভাল হতো। সেই দুই চাকর এসে ফারগাছকে টুকরো টুকরো করে। তারপর আগুনে ছুড়ে দেয় ‘বনফায়ারের’ জন্য। ফারগাছের মনে পড়ে সূর্য, রোদ, পাখি, বসন্তের দিন, খরগোশ আর সব বন্ধুর মতো গাছপালা। তারপর সেই বোকা, অসুখী, আবদারে, অভিযোগ ভরা ফারগাছ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অরণ্যে তখন ঝকঝকে রোদ আর সবুজ দিন রাত। আর ফারগাছ? তখন ছাই।
×