ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

এই কান্না শোকের না ব্যর্থতার?

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৭ আগস্ট ২০১৬

এই কান্না শোকের না ব্যর্থতার?

রাজনীতিতে হাসিকান্না খুব বেশিদিন টেকে না। এই যে আমরা দেখলাম মির্জা ফখরুল কাঁদছেন তার চোখের পানিকে সত্য মেনে নিয়েই বলি, এ কান্না কি শোকের না ব্যর্থতার? কারণ আছে এই প্রশ্নের। খুব বেশিদিনের কথা নয়। এদেশের মানুষ জীবনে প্রথমবারের মতো দেখেছিল তাদের স্বজাতি স্বগোত্রীয় ভাইদের তা-ব। সেকি আগুন আর আগুন। বাসে গাড়িতে ট্রেনে আগুনের দাহ। না প্রকৃতি বা অন্যকিছুর নয়, এ আগুন লাগিয়েছিল ফখরুল বাহিনী। তাদের রাগ-অভিমান ব্যর্থতার ব্যাপার থাকতেই পারে। রাজনীতির নাম যদি হয় জনকল্যাণ তাহলে তারা জনগণের কাছে তুলে ধরবেন নিজেদের অভিযোগ। নালিশ জানাবেন সরকারকে। সরকার যদি না শোনে তো মালিক জনগণই তার বিহিত করবে। কিন্তু সব রাস্তা তারা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে মুখে ফেনা তোলা আর ক্রেডিট নেয়া বিএনপি নেমে এলো বর্বরের ভূমিকায়। ফখরুল সাহেবরা যে বলেন, সাইলেন্ট মেজরিটি তাদের সঙ্গে বা এখনও ভোট হলে তারাই জিতবেন যদি তা সত্য হয়Ñ জনগণের প্রতি এই আক্রোশের কারণ কি? জনগণের প্রতি আক্রোশের কথাটা কি তারা অস্বীকার করতে পারবেন? আমরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি তাদের নৈরাজ্যে একজন আওয়ামী নেতার একটি চুলও ছিঁড়তে পারেননি। তারা নিজেদের প্রটেকশন দিতে জানে। কারণ তারাও রাজনীতি করে। তাদের আছে নিজস্ব বাহিনী। আছে পুলিশ বা নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিতদের সহায়তা। মরেনি, পুড়ে খাক হয়নি মন্ত্রী-মিনিস্টারদের কিছুই। মাঝখান থেকে প্রাণ হারিয়েছে বড় নিরীহ আর সাধারণ কিছু মানুষ। তখন মিডিয়ায় চোখ রাখা যেত না। এ যেন এক জ্বলন্ত নরককু-। দাউ দাউ করে জ্বলা যানবাহনে মানুষের আহাজারি। বাতাস ভারি হয়ে ওঠা বার্ন ইউনিটের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন মি. ফখরুল? যখনই এদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়টা নিশ্চিত হচ্ছিল বিএনপি আর জামায়াত মিলে তৈরি করেছিল নারকীয় পরিবেশ। বিএনপি নেত্রী দু-দুবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শাপলার ঘটনার আগে বিশাল জনসভায় কি বলেছিলেন ভুলে গেছেন? টিভিতে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছিল প্রবাসীদেরও। তিনি বয়সের ভারে স্মৃতিভ্রষ্ট বা ভুলে যাবার কারণে নামগুলো বলতে পারছিলেন না। পেছন থেকে ছুটে এসে সাদেক হোসেন খোকা বার বার ঠিক করে দিচ্ছিলেন। বেগম জিয়ার ভাষায় মৌলভীগুলোকে যেন খাবার দাবার দিয়ে সাহায্য করা হয় এমন বক্তব্য যে কোন দিক থেকে আপত্তিকর। হেফাজতকে মৌলভী সম্বোধনের ভেতর দিয়ে তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন স্বার্থ উদ্ধারের দায় থাকলেও তাঁদের প্রতি তাঁর সম্মানবোধ নেই। আর পেছনে বসে মিটমিট করে হাসছিলেন মওদুদের মতো নেতারা। মি. ফখরুল আপনি পেছন ফিরে দেখুন, সেসব নেতা মাঠে নেমেছিলেন? তারা সুযোগ বুঝে হাওয়া হতে জানেন। আর আপনি? হুইল চেয়ারে বসে ঘোষণা দিলেন অনেক হয়েছে রাজনীতি আর তেমন টানছে না। শরীর খারাপ বলে চলে গেলেন সিঙ্গাপুর। আমরা আমজনতা অনেক কিছু বুঝি না এটা সত্য, কিন্তু এটা তো বুঝি কিসের টানে হুইল চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে যেতে পারেন আপনারা। আজ আপনার মতো ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের ভারমুক্তির কান্না তাই অনেক প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। সবাই আপনাকে একটু ভিন্নভাবে জানে। শুধু আপনি নন, আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিও অন্য ধরনের মানুষ। জাতীয় রাজনীতিতে মুখরতা, বাচালতা আর যা খুশি তা বলার প্রতিযোগিতামুক্ত আপনাদের জন্য সবার মনে একটা আলাদা জায়গা আছে। এটা পজিটিভ। এ যাবত আপনি ও সৈয়দ আশরাফের মুখে এমন কথা শোনা যায়নি যা দলের জন্য বা মানুষের জন্য গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। কিন্তু আপনার বিষয়ে আমাদের কৌতূহল যায় না। যে মেজাজ যে পোশাক যে বাচনভঙ্গি আর মার্জিত কথা তার সঙ্গে রাজনীতিটা কি বেমানান নয়? আপনি পাঞ্জাবি-পাজামা বা স্যুটকোট পরেন সাফারি পরেন না। অথচ আপনার আরাধ্য মানুষটি এদেশের রাজনীতি থেকে সফেদ পাঞ্জাবি-পায়জামার মহান নেতাকে সরিয়ে দিতে মাঠে নেমেছিলেন। আপনার দল এখনও এদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ে আছে। কয়েক দফায় দেশ শাসনের পরও আপনারা জনক, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত আর চেতনা বিষয়ে কনফিউজড। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিই যদি মানেন তবে এদেশের জাতীয়তা আর জাতীয় ইতিহাস মানেন না বা মানতে পারেন নাÑ এটা কি হিপোক্রেসি নয়? আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন আপনি জানেন না কার ডাকে এদেশ মুক্ত হয়েছিল? অতীতে যাব না। এখনকার কথা বলিÑ আপনি কি জানেন না বিএনপির মতো একটি জগাখিচুড়ি দল আধুনিক দেশের শাসনভার নিলেও চালাতে পারবে না? পাকিস্তান বা যেসব দেশের সহায়তা ও পরামর্শ আপনাদের আন্তর্জাতিক শক্তি তাদের ঘরের দিকে তাকান। বেলুচরা বলছে, আমাদের কুকুর ডাকলেও পাকিস্তানী ডেকো না। আপনি কি আমাদের সে বাস্তবতায় ফিরিয়ে নিতে চান? চান এদেশে আবার সামরিক জান্তার আমল ফিরে আসুক? আমরা দেখব ট্রায়ালের নামে জোয়ানদের মৃত্যু? চান এদেশের মাটি থেকে অসাম্প্রদায়িকতা আর উদারতা চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে যাক? ভারত তোষণে আপনাদের আন্তরিকতার কথা কে না জানে? সেটা প্রকাশ্য হবার পর না পারছেন প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা করতে না পারছেন তাদের সঙ্গে প্রভুত্বের দায় স্বীকার করতে। এ জায়গাটাকে আপনারা সরকারে যাবার প্রধান বাধা বা অন্তরায় মনে করে এতদিন যে রাজনীতি করলেন বা করছেন তার দায় চুকাতে হবে না? আজকের বাংলাদেশ এবং নতুন প্রজন্মের মন পড়তে পারা কঠিন তবে অসাধ্য কিছু না। আওয়ামী লীগেরও সবাই তা পারে না। কোন না কোনভাবে শেখ হাসিনা পারেন। তাঁদের ঘরেই তৈরি হয়ে আছে ইতিহাস। ভবিষ্যত কেউই বলতে পারে না তবে এটা তো বলতে পারি তাঁদের সন্তানরাও মেধা দিয়ে লড়াই করবে। সে জায়গায় আপনারা মানুষের সস্তা সাম্প্রদায়িকতা আর ভারত বিরোধিতার রাজনীতি ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে আর কতদিন টিকে থাকবেন? বিলেতে থাকা আপনাদের আগামী নেতার মুখে এখন অবধি এমন কি কথা শুনেছে তারুণ্য যাতে তার ওপর আস্থা রাখতে পারে? কি এমন ইমেজ বা ভাবমূর্তি যে তার বিরুদ্ধে খাম্বাসহ নানা জালিয়াতির বিষয় ভুলে যাবে মানুষ? আপনি ভালই জানেন এসব কারণে মানুষ জাগছে না। তাদের জাগবার কারণ যদি হয় অর্থনীতি সেটা এই সরকারের আমলে কেমন চলছে আপনাদের পোশাক চলন বলনেই তা স্পষ্ট। মানুষের অভাব না কমলে আপনাকে বলতে হতো না নিজেরাই মাঠে নেমে যেত। যাবতীয় দুর্নীতি আত্মসাত-গুম ইত্যাদির পরও মানুষের জীবনে সচ্ছলতা আর ভাল থাকার ব্যাপারটা তো উৎসবের সময়ই টের পাওয়া যায়। তখন ঘাতক থাকে না। তখন রাজনীতি থাকে না। তখন ঈদ-জন্মাষ্টমী-মহররম বা বৈশাখে মানুষ বুঝিয়ে দেয় এদেশ কতটা অসাম্প্রদায়িক আর মানবিক। আপনার চোখের পানি আর কিছু না হোক মিডিয়ায় খবর হয়েছে। ধরে নিলাম এই পানি আন্তরিক। আপনি যাদের কথা বলে কাঁদলেন তাদের এই সর্বনাশ বা রিক্সা চালানোর জন্য দায়ী কারা? রাজনীতির কাজ কি মানুষকে বড়লোক বানানো বা কাজকর্ম ছাড়া ধনী করা? সরকারী দল বা আপনাদের এটাই বড় সমস্যা। একসময় যুবকরা আদর্শ আর নীতির জন্য রাজনীতি করত। সে জায়গাটা নষ্ট করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এরশাদ তা চুরমার করে দিলে আজ এই অবস্থার সুযোগে যে যায় লঙ্কায় সেই তৈরি করে নতুন যুবক রাবণের দল। মির্জা সাহেব আপনি কাঁদছেন বটে আপনার দলের একজন নেতাও কি এদের দায় নিয়ে রাস্তায় নামবেন? নেমেছেন এ যাবত? ভুলে গেলেন সেই মেয়েটির কথা? চট্টগ্রামের বৌদ্ধ পরিবারের সেই কিশোরী। যাচ্ছিল পড়াশোনা করতে। রিক্সায় বোমা মেরে তার চোখ কেড়ে নিয়েছে এদেশের রাজনীতি। সেদিন তার নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি চোখের জন্য আপনারা কেউ টুঁ শব্দটিও করেননি। বিএনপির নেতা আপনি আপনার এখনও দুচোখের জল ফেলার অধিকার ও সুযোগ আছে। ভাবুন একবার ঐ মেয়েটি জীবনে কোনদিন দু’চোখের পানিতে বুক ভাসাতে পারবে না। আর যাদের চোখ ও জীবন গেছে তারা কান্নারও অনেক বাইরে। আপনার এই কান্নাকে তাই অনেকেই মায়াকান্না, কুমীরের কান্না বলছে। অতটা না হলেও বলি, অসময়ের এই কান্না কি আসলে দুঃখের না অকৃতকার্যতার সেটাই বোঝা গেল না।
×