ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাই দেশকাল পাত্রের ভেদ

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৭ আগস্ট ২০১৬

নাই দেশকাল পাত্রের ভেদ

বাঙালীর অফুরন্ত আবেগ, ‘বাঁধনহারা’ উচ্ছ্বাস আর প্রবল প্রাণশক্তিকে আপন আত্মায় ধারণ করে যিনি সারাজীবন দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার বাণী শুনিয়েছেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল এই মহান কবির আরাধ্য ছিল সত্য-শিব-সুন্দর। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ তিনি সাম্যবাদী কবিতায় আরও লিখেছেন : ‘গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। ............................................... যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রীস্টান।’ ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’-তে নজরুল লিখেছেন, ‘আমি কবি। আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী, সত্যের প্রকাশিকা। ভগবানের বাণী।’ সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবনচর্যায় তিনি দীর্ঘকাল থাকতে পারেননি; তবুও সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থা তাঁকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে করেছে বাংলা ও বাঙালীর কবি। তাই তো মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামে এবং পরমতসহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তাঁর কবিতা এবং গান বাঙালীকে যোগায় অনিঃশেষ প্রেরণা। নজরুল ইসলাম ছিলেন মূলত সকল ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক অমর প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রবল বাসনা তিনি সব সময়ই অনুভব করেছেন। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শুনে তিনি তাঁর দু’-যুগের কাব্য পরিক্রমায় মাঝে মাঝেই হয়ত পথ দর্শন, এমনকি ধর্মাদর্শ বদলিয়েছেন। কিন্তু ভেদবুদ্ধিহীন, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কখনও নিজেকে বদলাননি। ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানুষ। বিয়ে করেছেন মুসলমান নার্গিস আক্তার খানম ও হিন্দু প্রমীলা দেবীকে। তবে ‘আহলুল কিতাব’-এর মতানুসারেই কাজী নজরুল ইসলাম ও কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তের বিয়ে হয়েছিল কলকাতার ৬নং হাজী লেনের বাড়িতে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল। প্রমীলাকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করার কথা নজরুল চিন্তাও করেননি। এমনকি স্ত্রীর নামটিও পরিবর্তন করে মুসলিম নাম রাখেননি। নজরুলের সখ্য ও বন্ধুত্ব ছিল হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকের সঙ্গেই। শৈলজানন্দ মজুমদার, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মুজাফ্ফর আহমদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী মোতাহার হোসেন, দিলীপ কুমার রায় প্রমুখ ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু এবং অনেক শুভ কর্মের সহযাত্রী। নজরুল তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪ খ্রি.) ‘জগজ্জননীস্বরূপা মা মিসেস এম রহমানকে’, ‘চিত্তনামা’ (১৯২৫ খ্রি.) ‘মাতা বাসন্তী দেবীকে’ এবং ‘সর্বহারা’ (১৯২৬ খ্রি.) ‘মা বিরজা দেবীকে’ উৎসর্গ করেন। লক্ষণীয় এঁরা সকলেই ছিলেন নজরুলের কাছে মায়ের মতো। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত হলে যে অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয় তখন নজরুল রচনা করেন উদ্দীপ্ত সঙ্গীত। ১৯২৬-এর ২২ মে কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির বার্ষিক সম্মেলনে কবি নজরুল সবাইকে চমকে দিয়ে ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়ে শোনান। তিনি যখন উচ্চারণ করেন, হিন্দু না ওই মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন্ জন/কা-ারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’রÑ তখন হিন্দু-মুসলিম প্রত্যেকে একাত্ম হয়ে ওঠে। এর পর তিনি ‘হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ’, ‘পথের দিশা’ প্রভৃতি কবিতা এবং ‘মন্দির-মসজিদ’ প্রবন্ধ লিখে দেশবাসীকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। মানবতার আবেগেই তিনি সাম্যের গান গেয়েছেন। বুর্জোয়া সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে তিনি চেয়েছেন সাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়তে। তাই তাঁর কাব্য, গানে-গল্পে মানবতাবোধ থেকেই এসেছে বিদ্রোহ, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদের চেতনা। তিনি মনে করতেন যা কিছু মানুষের জন্য সুন্দর মহত্তর ও কল্যাণকর তাই ধর্ম। নজরুল-মানস পরিম-ল সার্বজনীন মানবতাবোধ দিয়ে বেষ্টিত। তিনি মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করেন কল্পনার উচ্চমার্গ থেকে প্রত্যক্ষ জীবনে-জনসাধারণের স্তরে। সমাজে যারা নির্যাতিত, অপমানিত, অবহেলিত তারাই কবিচিত্তকে আকৃষ্ট করেছে। এ সব মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে লাঘব করতে তাঁর লেখনী নিঃসৃত হয়েছে। নজরুল যা লিখেছেন তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন বলে তা জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। তাঁর জীবনসাধনাকে কোনভাবেই শিল্পসাধনা থেকে আলাদা করা যায় না। প্রেম ও দ্রোহের এই সাধক মানবতার সুউচ্চ মিনারে বসে সারাজীবন সাম্য-সম্প্রীতি ও মিলনের গান শুনিয়েছেন। কবিতা ও গানে তিনি ব্যবহার করেছেন হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ঐতিহ্য থেকে শব্দ ও ভাষা। কিন্তু মননে-মগজে ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য স্পর্শ করে তিনি চলে গেছেন অসাম্প্রদায়িকতা ও উদার মানবিকতার দিকে। তাঁর গান-গল্প-নাটক-চিঠিপত্র এক কথায় সমগ্র নজরুল সাহিত্যে দুটি ভাবকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। প্রথমটি সমাজের নানাবিধ বৈষম্যের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাতিÑধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি তাঁর অপার ভালবাসা। প্রথমটি থেকে তাঁর জন্ম নেয় সাম্যবাদী চেতনা আর দ্বিতীয়টি তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় বিশ্ব মানবধর্ম। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা যেমন তাঁদের সৃষ্টি মাহাত্ম্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন, তেমনই তাঁদের জীবনের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে সমালোচিত হন। কাজী নজরুল ইসলামের অলৌকিক কবিপ্রতিভা ও অসাধারণ বিদ্যাবুদ্ধির সঙ্গে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও চপলতা জড়িত ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নজরুলের চরিত্রের মহত্ত্ব, তেজস্বিতা, নিঃস্বার্থপরতা এবং সরলতা প্রভৃতি গুণের সমাবেশ বিবেচনা করলে তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অকিঞ্চিৎকর প্রতিভাত হয়। তিনি ছিলেন এক অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব, এমন মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তাঁর মতো স্বদেশানুরাগী ব্যক্তিত্ব একান্তই দুর্লভ- এক কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। নজরুলের জীবন নিয়ে চিন্তা করলে অবাক হতে হয়। বিস্ময়কর এই প্রতিভাবান মানুষটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন অতিসাধারণ একটি মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমেদ। দরিদ্র-সংসারে নজরুল ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান। তাই তার নাম রাখা হয়েছিল দুখু মিয়া। সত্যিই নজরুল ওরফে দুখু মিয়ার জীবনে আর যা কিছুরই অভাব হোক দুঃখের অভাব কোনদিন হয়নি। ৮ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে গ্রামের মাজারের খাদেম, তার পর মসজিদের মোয়াজ্জিন। স্কুল ছেড়ে কবি দলে যোগদান, পরে খ্রীস্টানদের রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানের কর্মচারী। যৌবনের প্রারম্ভেই সৈনিকের চাকরি। তার পর ফিরে এসে সাংবাদিকতায় বা পত্রিকার সম্পাদনায়। কত অসাধারণ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেন মাত্র ৪৩ বছরে। এর পর ৩৪ বছর নির্বাক-নিশ্চল থেকে মহান মানবতার কবি নজরুল চলে গেলেন পরলোকে। রেখে গেলেন মানবধর্মের মহান আদর্শ। যৎধযসধহ.ংধিঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়স
×