ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রণি

হৃদয়ে হলুদ ডাকটিকেট : কবিতায় স্মৃতিপাঠ

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২৬ আগস্ট ২০১৬

হৃদয়ে হলুদ ডাকটিকেট : কবিতায় স্মৃতিপাঠ

‘কবিতা হচ্ছে শক্তিশালী অনুভূতিসমূহের একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ; এর উৎস হচ্ছে প্রশান্তির অবস্থায় স্মরণকৃত আবেগ।’ রোমন্টিক কাব্যের যুগস্রষ্টা, ইংরেজী সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায় কবি মাসুদ হাসানের ‘পোড়া বাতাসে আমিও’ কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে- ‘বস্তুত পোড়া বাতাসে আমিও ঘ্রাণ নেই, আগুনের নাকি জলের। সে পুড়তে পুড়তে ভাবালুতা শেখায়। নদীর জোয়ারের মতো প্রসারিত কর তোমার ওষ্ঠাধর। হাসো ক্ষুধা ও চুম্বনে- দেখবে উৎসবে যাওয়া জ্যোৎস্নার আলো জোনাকির ঔরসে নিভে নিভে জ্বলে।’ কবিতার পথে মাসুদ হাসানকে অনেকদিন ধরে হাঁটতে দেখা গেলেও তার একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীর আলো দেখেছে। অনন্যা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সে গ্রন্থের নাম- হৃদয়ে হলুদ ডাকটিকেট। মাসুদ হাসানকে ‘হৃদয়ে হলুদ ডাকটিকেট’ কাব্যের রথে চড়ে, নক্ষত্রের মাঝে শুয়ে দারুচিনি দ্বীপের রূপ দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতে দেখা গেলেও পাঠকের চোখে তার নৈরাশ্যময়তা ও স্মৃতিকাতরতার জলছবিই খুব সহজে ধরা পড়ে। আশা এবং হতাশার মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি কাব্যের যে পশরা সাজিয়ে রাখেন- সেখানে তার স্বকীয়তা স্পষ্ট। তাই কবি যখন বলেন ‘ভালবাসার পাঠে তারে আমি বাঁধি- সে আরও দূরে যায়, মরীচিকা হতে হতে জোনাকতলায় বীজ বোনে আকাক্সক্ষার সব রঙ মুছে’ তখন পাঠকমনে দুঃখবোধ নাড়া দিলেও; কৈশোরের বারান্দায় ডেকে নিয়ে কবি পাঠককে আবার আশার আলো দেখিয়ে দেন। বলেন- ‘রাত্রি এলে সন্ধ্যানদীর হাটভাঙার সাহসে তৃষ্ণার জল নিয়ে বাড়ি ফিরলে খুশিতে মা উনুনে শূন্য হাঁড়ি ভরতে থাকেন আনন্দে। খোকা ফিরেছে রাতের আঙিনা দিয়ে। অশুভ সব থাক হুতোম্ প্যাঁচার ঠোঁটে। নিভু নিভু দীপ জ্বেলে যাক জোনাকির আলোয়।/ আঁজলাভরা মাছ আর টাটকা সবজির ঘ্রাণ; খলুই থেকে নেড়ে পান-সুপারি হাতে, মা বলেন- খোকা এলি রাত্রি গায়ে থুতু ছিটিয়ে, সেই কখন থেকে আঙিনায় জোনাক জ্বেলে প্রহর গুনি ।’ জীবনের নানামুখী ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে এসে এবং নির্মম বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কবির কাছে শহরের অচেনা বাড়ির দরজা এখন আর বিষণœ মনে হয় না। আজকাল অচেনা দরজা বিষণ্ণ মনে না হলেও একজন ডাকপিয়নের জন্যে সর্বদা তার মনটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সংবাদ নিয়ে যে ডাকপিয়ন একসময় ছুটে আসত পরম আত্মীয়র মতো, সময়ের বিবর্তনে তা হারিয়ে যাওয়ায় কবির সব চাওয়া-পাওয়া বিষণ্ণ নিঃশ্বাসের ঘ্রাণে পরিণত হয়ে পড়েছে যেন। তাই ভুল বানানে, ভুল ঠিকানাতেই বার বার চিঠি লিখেন এবং পোস্ট করেন তিনি। সব হারিয়ে গেলেও তার হৃদয়ের মণিকোঠায় যে হলুদ ডাকটিকেট আছে তা কখনই হারিয়ে যাবে না। আত্মার প্রশান্তির জন্যে এবং কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করতে মাসুদ হাসান কখনও কখনও অগ্রজদের আশীর্বাদ কুড়াতে ছুটে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, জীবননান্দ দাশ, আবুল হাসান এবং ওমর আলীকে তার কবিতায় নান্দনিকভাবে খুঁজে পাই আমরা। আলোচ্যগ্রন্থে কবির আঞ্চলিকভাষায় লেখা ‘আমি তো আন্ধারেই আছিলাম’ কবিতা থেকে কিঞ্চিৎ পাঠ নিলে বোঝা যায় উপস্থাপনশৈলি কতটা চমৎকার- ‘হঠাৎ বৃষ্টির মতো ক্যান দু’চোখ দিয়া অশ্রু ঝইরা পড়ে দু’গাল বেয়ে, বুকের মধ্যি দিয়া যে নদী বয়ে যায় তাকে নিনাদ নদ বলে। কী কথা তুমি বইসা বইসা মনে করছিলা, আমারে, না অন্য কারও?/আমি তো আন্ধারেই আছিলাম, পূর্ণিমায় এলে দেখি চান্দের আলোয় করুণ জোছনা ঝরে দু’পাহাড়ের মধ্যিখান দিয়া।’ আমরা ‘হৃদয়ে হলুদ ডাকটিকেট’ গ্রন্থের সাফল্য এবং পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি।
×