ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নৈঃশব্দের প্রতীক শিল্পী

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২৬ আগস্ট ২০১৬

নৈঃশব্দের প্রতীক শিল্পী

একটি ছবি অনেক কথাই বলে। অনেক অর্থ বহন করে। কথা বলে সুখ-দুঃখ, হাসি ও কান্নার। বলে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার কষ্টের কথা। সেই সঙ্গে বলে অনাগত ভবিষ্যতের কথাও। হোক সে কথাগুলো দৃশ্যমান বা কল্পনায় আঁকা। ছবি তার কথা নিজস্ব ভাষাতেই বলতে চেষ্টা করে। তাইতো ছবিরও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। তবে সেই ভাষা বোঝার মতো সক্ষমতা অনেকের নেই। আর নেই বলেই হয়তো অনেকেই শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন কিন্তু ব্যর্থ হন ছবির ভাষা বুঝতে। কি প্রেক্ষাপটে সে ছবি আঁকা হয়েছে তাও বোঝেন না অনেকেই। আর এখানেই বোঝা যায় দর্শক ও শিল্পী মনের পার্থক্য। দর্শক যেটা ভাবেন অনেক সময় শিল্পীর কল্পনায় আঁকা ছবির ধারে কাছেও হয়তো তা পৌঁছায় না। কিন্তু আবার কেউ ছবি দেখেই বলতে পারেন কি অর্থে আঁকা হয়েছে সেই ছবি। কি বোঝাতে চেয়েছেন শিল্পী। শিল্পী রোকেয়া সুলতানা ও তাঁর চিত্রকর্ম ‘একদা সময়’ শিল্পী রোকেয়া সুলতানা রঙ তুলি দিয়ে ক্যানভাসে মনের ভাব প্রকাশ করেন। প্রতিদিনের আঁকা ছবিই হচ্ছে তাঁর প্রতিদিনের জীবনের পা-ুলিপির খাতা। এতে বাংলার আকাশ, বাতাস, মনের অনুভূতি, আবেগ, মানুষ হিসেবে চাওয়া-পাওয়া সবই থাকে। আর এ সবই তিনি প্রকাশ করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। কোন বিশেষ গ-িতে আবদ্ধ নন শিল্পী রোকেয়া সুলতানা। সর্বদা উত্তরণ প্রয়াসী তিনি, জীবনের নিত্যনতুন বোধ তাঁকে তাড়িত করে। সে জন্যই তাঁর সৃষ্টি হয়ে ওঠে মনোগ্রানী ও সংবেদনময়। শিল্পী রোকেয়ার ছবিতে তাঁর নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ থাকে বলেই তা অন্যদের ছবির চেয়ে একবারে আলাদা। শিল্পীর ছবিতে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার জগৎ নানারূপে প্রকাশ পেয়েছে। এতে দেশের মাটি, বাতাসের ছোঁয়া ও শিল্পীর মনের অনুভূতি ও মানসিকতার প্রতিফলনের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ পাওয়া যায়। শিল্পী রোকেয়া সুলতানা সমকালীন শিল্প আন্দোলনের একটি বিশিষ্ট মুখ, যিনি ছাপচিত্র, তেলচিত্র, জলরঙ এই তিন মাধ্যমে সমানভাবেই সাবলীল। হাতের দক্ষতার চেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতের মননশীল রূপ সৃষ্টিই তাঁর বিশেষ প্রিয়। তাঁর কাজের মূল বৈশিষ্ট্য ছন্দময় কম্পোজিশন আর উষ্ণ রঙের ব্যবহার। নারী ও প্রকৃতি তাঁর কাজের প্রধান বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা তাঁর কর্মের অনুপ্রেরণা। টেম্পারা, মিক্স মিডিয়া, এক্রেলিকে তিনি বেশিরভাগ ছবি এঁকেছেন। ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, ফোরগ্রাউন্ডের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রভেদের অনুপস্থিতি, ছন্দময় রেখার মাধ্যমে ফিগারের উপস্থাপন শিল্পীর কাজে এনে দিয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাই কাজের ভিড়েও তাঁর কাজকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। বড় ক্যানভাসে আঁকা ‘একদা সময়’ শিরোনামের ছবিতে দেখা যায় ক্যানভাসের কেন্দ্রে মা ও শিশু। চারপাশে রিকশাসহ রাজপথের ভিড়। বিশাল ক্যানভাসে দক্ষতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করেছেন শিল্পী, যেন রহস্যময় এক রঙিন নাগরিক জীবন আঁকা হয়েছে সেখানে। ধূসর শহুরে বাস্তবতার সঙ্গে তার কোন মিল নেই। আরেকটি ছবি তেলরঙ ও টেম্পারায় আঁকা ‘গ্রামের পথে একদিন’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্রাম-বাংলার চিরন্তনরূপ। বিষয় ভিত্তিকতা ও শিল্প জাগরণে রোকেয়া সুলতানা এক নিরন্তর যোদ্ধা। তাঁর শিল্পচর্চা এগিয়েছে স্বকীয়, স্বাধীন ও নন্দিত গতিময়তা। তাঁর সৃজন সত্তায় প্রাধান্য দিয়েছেন মৌলিকত্ব, সারল্য ও নিজস্বতা। তাঁর ক্যানভাস বন্দনা করেছে প্রকৃতি, নারী ও তীব্র মনুষ্যত্ববাদ। রোকেয়ার কাজ সতেজ ও জীবন্ত। অভিব্যক্তিতে সরলীকৃত। জীবনের সমস্ত রূপকে যেন শিশু সুলভ দৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন। যার মধ্যে আছে এক ধরনের আশা এবং নির্মলতা। প্রতিদিনের অধ্যায়গুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে কোন না কোন উদ্দেশ্য। যেখানে দ্বিমাত্রিক অবয়বগুলো ত্রিমাত্রিক জগতে ক্রিয়াশীল। তবে এই শিশুসুলভ ড্রইংগুলো প্রমাণ করে না যে, তাঁর ড্র্ইং দুর্বল। পক্ষান্তরে এটা শিল্পীর জন্য একটি জোড়ালো মাত্রা সংযোজন করে। একাডেমিক রীতির ভাংচুর ও পরিবর্তন করে আয়ত্ত করেন দৃশ্যমান জগৎকে উপেক্ষা করে অন্তঃলোকের রূপদান। আশির দশকে ম্যাডোনা সিরিজ এঁকে বিখ্যাত হয়েছিলেন এ শিল্পী। তাঁর কয়েকটি সিরিজ হলো জল, বায়ু, মাটি সম্পর্ক। জীবন-পরিক্রমায় একজন নারীর সময়খনন ও ক্রমপরিবর্তন প্রক্রিয়ার রাস্তবতা ও আবেগ প্রতিফলিত হয়েছে ছাপচিত্র মধ্যমে আঁকা ‘ম্যাডোন’ সিরিজে। উড এন্টাগ্লিও অবলম্বনে আঁকা ‘ম্যাডোন-১’ চিত্রে মায়ের অবয়বকে কেন্দ্র করে মাছ ও গাছের পাতা দিয়ে যে পরিবেশ তৈরি করেছেন শিল্পী, সেটি যেন কলাবতী মাতৃকামূর্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের। এখানে আছে মায়ের কাছে সন্তানের আকাক্সক্ষার প্রকাশ। কোন রকম দৈহিক ছন্দের আভাস না এঁকেও শিল্পী এই জননীকে রূপবতী করে তুলেছেন অনায়াসে। শিশু কন্যার অবুঝ সান্নিধ্যেই জননীর বয়স ও রূপ লাবণ্য বৃদ্ধি পেয়েছে নিঃসন্দেহে। অদ্ভুত আঁধার ঘেরা বৃষ্টিতে ভেজা রাতে শিশুকন্যা নিয়ে একাই দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডোনা। নিকষ কালরাতে অশুভ বাতাবরণে বাঁকা চাঁদের নিষ্প্রভ উপস্থিতি ঐ জননীর প্রতীক্ষার আরও নিঃসঙ্গ রূপ দিয়েছে। খুব সচেতনভাবে তিনি এখানে জননী ও শিশুকন্যার দেহে ও পোশাকে লাল রঙ লাগিয়েছেন। রাত্রির কামনা ভরা অন্ধকারে রমণীর রক্তিম দেহাবরণ আরও অসহায় করে তুলেছে দুঃসহ প্রতীক্ষা। মাথায় কালো ছাতা বৃষ্টির সজল রূপ, সব মিলিয়ে এক চমৎকার শিল্পচিন্তা। রোকেয়ার ক্যানভাস যেন তাঁর অন্তর্নিহিত চিন্তাধারার প্রকাশ। একজন নারীর নানা মাত্রার চিন্তার প্রতিফলন উঠে এসছে তাঁর ক্যানভাসে। নারীর প্রতিটি পরিচয় এবং একজন মানুষ হিসেবে তাঁর একক সত্তা যেন ভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সেই সঙ্গে বিমূর্ত চিত্রগুলো যেন সেই নারীর ভাবনারই স্ফুরণ। যাপিত জীবনে নারী এবং তার অন্তর্মুখী চরিত্র, বাইরেও তার কাজের পরিধি ও তার লড়াই সব কিছুই যেন ভাষা পায় ক্যানভাসে। ‘দেবী -৩’ চিত্রে দেখা যায় এক সারিতে তিন নারীর আদুল শরীর, দুই প্রান্তের দুজনের হাতের জায়গায় দুটি ডানা। যেন সদ্যই উড়াল থেকে নেমে এসেছে মর্ত্য।ে শিল্পীর নিজের অভিজ্ঞতাকে অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে কিংবদন্তিকে সমকালের নারী জীবনের সঙ্গে একাকার করে দেখা-বিষয়টি বেশ চমকপদ। স্যুরিয়ালিস্টিক ধারায় রোকেয়া প্রকাশ করেছেন অনুচ্চাকিত ভঙ্গিমায় এক তীব্র মানবতার জয়গান। প্রকৃতি, নারী, প্রেমের এক অপূর্ব লীলয়ে সম্পৃক্ত হয়েছে মাতৃত্ব ও মানবতাবাদের তীব্র কণ্ঠস্বর। রোকেয়ার ক্যানভাসে নারীরা কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি। নারীর কমনীয়তা, লাবণ্য, রোমান্টিকতা থেকে শুরু করে নারীর জীবন সংগ্রাম ও প্রতিকূলতা তাঁর সৃষ্টিতে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে। তাঁর আঁকা নারী শ্বাশত বাঙালী নারী। দৈনন্দিন সামাজিক আচার, ব্যবহার, নারীর ওপর সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্ন মৌলবাদী শক্তির নিপীড়ন নির্যাতন তাঁকে প্রচ- রকম আলোড়িত করে। তিনি নির্যাতিত নারীদের যন্ত্রণার কথা বলার চেষ্টা করেছেন তাঁর চিত্রকর্মের মাধ্যমে। সে কারণেই তাঁর ছবিতে বালিকা, শিশু, নারী চরিত্র বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। আমাদের সমাজ বাস্তবতার নানা বিবর্তন ও নারী শিশুদের অসহায়ত্ব তাঁর চিত্রে মৌন অথচ বলিষ্ঠ প্রতিবাদের আবহ নির্মাণ করেছে। বিশাল ক্যানভাসে ‘ধরণী’ নামের চিত্রকর্মটিতে একটি নারী ফিগারকে চিত্রায়িত করেছেন। ফিগারটির পাশেই একটি কালো রঙের চেয়ার। নারী ফিগারটির দেহের বিভিন্ন অংশ ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে ভাগ করে আঁকা হয়েছে। লাল আর হলুদ রঙে আঁকা চিত্রটি শিল্পীর সংবেদনশীল সত্তার প্রকাশ করেছে। রোকেয়া মূর্ত- বির্মূত একই মানবিক সত্তা থেকে নির্মাণ করেছেন। তাঁর ছবি চিত্রজ গুণের মধ্যে দিয়েই ভাষ্য তৈরি করে। ফিগারের নাটকীয়তা ত্রতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাঁর চিত্রকর্মে নারীরা এসেছে মাতৃত্ব ও জয়িতার ভূমিকায়। ব্যক্তি জীবনাচরণেও রোকেয়া একজন তীব্র মানবতাবাদী নিভৃতচারী শিল্পযাত্রী। নিরহঙ্কার, শিল্পে নিমগ্ন শিল্পী রোকেয়া সুলতানার চিত্রমালা নন্দিত মাতৃত্ব, প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণাঢ্যতায় এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁর ম্যাডোনারা সকলেই সাধারণ রমণী। সমাজে কর্মজীবী মহিলাদের নানামুখী সমস্যা হতে তিনি ম্যাডোনা সিরিজের কাজ করেছেন। তিনি তাদের দেখতে পান পথে ঘাটে, সমাজের নানা কোণে। সংসারে যাতাকলে নিষ্পেষিত অথচ সুকঠিন প্রাণশক্তির অধিকারী রমণীসত্তা। কখনও তিনি মাকে স্থাপন করেছেন নগরের মধ্যে। যে মা তাঁর শিশুকে নিয়ে কখনও নিদারুণ দুর্দশায় সংগ্রামরত, যা একজন কর্মী মাকে স্মরণ করায় ম্যাডোনা সিরিজের একটি ছবিতে শিল্পী এঁকেছেন নগরবাসে আরোহী ‘ম্যাডোনা’। দ্রুতগতি যন্ত্রদানবের ঝাকুনির হাত থেকে রক্ষা পেতে দু,হাতে বাসের রড দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সহযাত্রিনী একাধিক ম্যাডোনা। শরীর বা পোশাকে নেই দেহরূপের বৈশিষ্ট্য। আছে উত্থিত দুই হাতের ভঙ্গিতে। রমণীর দুই হাত এভাবে তুলে ধরে থাকার মধ্য দিয়ে তার অসহায়ত্বের কথাই মনে করায়। মনে পড়ে খ্রিস্টমূর্তির রূপ। ‘ম্যাডোনা’ সিরিজের ছবিগুলোতে শিল্পী তাঁর মা, মেয়ে ও নিজেকে বিভিন্ন রূপে আবিষ্কার করেছেন। ছবিগুলোর নারী চরিত্র কখনও প্রকৃতি মাঝে আনন্দে নীল, কখনও তাদের মুখ বিষাদে মলিন। কখনও তারা কন্যা, কখনও জননী। ‘মাটি-জল-বাতাস’ সিরিজ এঁকেছেন ক্যানভাসে টেম্পেরা রঙে। চিত্রপটে নানা বর্ণের মিশ্রণের বাহারি খেলা, টেক্সচার আর রঙের পরতে পরতে অভিনব কিছু তৈরির চেষ্টায় এই কাজগুলো হয়েছে নৈর্ব্যক্তিক ও দৃষ্টি নন্দন। রিলেশান্স সিরিজের ছবিগুলোতে শিল্পী বলেছেন মানুষে-মানুষে সম্পর্কের আদি ও আসল রূপ। ছবিগুলো দেখলে মনে হয় যেন গতি ও সময়ের ধারা একই সঙ্গে চলমান। আছে অন্তর্নিহিত সমুদ্রের অতলতা, গভীর মগ্নতাতেই তা অনুধাবন করা যায়। সচেতনভাবে শিল্পী চিত্রপটে মানুষের আবয়ব ও চলমান সময় কালকে তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন চিত্রপটে। অপরদিকে প্রকৃতির এমন সব উপাদান-ও কর্ম প্রয়োগ করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন যা সত্যিই বিস্ময়কর। চিত্রপটের বিষয়বস্তুর বাইরে দেখা যায় আধা বিমূর্ত আবহ। অবয়বের মধ্যে সরল চাহনি,অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অঙ্কনেও সেই সারল্য বিদ্যমান। অঙ্কনের এই ধরন তাঁর কাজে স্বকীয়তা তৈরি করেছে। রোকেয়া সুলতানা নৈঃশব্দের প্রতীক শিল্পী। দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যিনি পরিচিত। পুরস্কারের সংখ্যাও কম নয়। তিনি তাঁর ক্যানভাসে এই শহরের দানবিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। অসীম শূন্যতার যে আকাশ, সেই সীমানাও বহুতল ভবনের ইমেজ। রোকেয়া যথার্থই এ বিষয়কে উপজীব্য করেছেন। প্রতিযোগিতা আর স্থান-কালের মধ্যে পীড়িত জীবনের দিনলিপির মতো তাঁর স্থাপনাগুলো। রোকেয়ার কাজগুলো সাধারণ জনজীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি বলে সহজে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তাঁর স্থাপনার সারল্য আমাদের মনে আঁচড় টানে।
×