ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বই ॥ বাংলাভাষা আপন মর্যাদায় টিকে থাকবে

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৬ আগস্ট ২০১৬

বই ॥ বাংলাভাষা আপন মর্যাদায় টিকে থাকবে

হোসনে আরা শাহেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ঢাকা শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন। সৃষ্টিশীল হোসনে আরা শাহেদ প্রায় ৭৬টি গ্রন্থের রচয়িতা। এ ছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরিশ্রমী পাঠক এবং নিবেদিত লেখক হোসনে আরা শাহেদের লেখার উপজীব্যই হলো মানুষ, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এবং জীবনযুদ্ধের নানা প্রাসঙ্গিকতা। তাঁর প্রকাশিত দুটো বই ‘বাংলাদেশে বাংলাভাষা’ এবং ‘শত পাতা’ নিয়ে এ আলোচনা। লেখকের ‘বাংলাদেশে বাংলাভাষা’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। গ্রন্থটি মূলত স্বদেশ প্রেম আর মাতৃভাষার এক বিশ্বস্ত দলিল। আমাদের বাংলাভাষার ঐতিহ্য এবং বর্তমানে কিছু পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে তার অঙ্গহানির আশঙ্কা তাঁকে নানা মাত্রিকে তাড়িত করে। তাঁর মতে বাংলা ভাষা এখনও যথার্থ অর্থে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার আসন নিতে পারেনি। শুধুমাত্র প্রতি বছর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পালন কিংবা ‘আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষার স্বীকৃতি’ বিশ্ব পরিসরে, তা দিয়ে ভাষার গুরুত্ব কিংবা মর্যাদার মূল্যায়ন করা যাবে না। ভাষার প্রতিটি জায়গায় তার যথাযথ অবস্থানে নিয়ে যেতে না পারলে ভাষা তার নিজস্ব মর্যাদায় আর থাকে না। তার মতে ব্যবহারিক জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন এবং সর্বোপরি অফিস-আদালতেও বাংলা ভাষা এখনও পূর্ণরূপে চালু হয়নি। তাকে বিশেষভাবে ব্যথিত করে হিন্দী চ্যানেল এবং ইংরেজী মাধ্যমে স্কুলের আধিক্য। বালা, হিন্দী এবং ইংরেজীর সংমিশ্রণে যে পারিপার্শি¦ক আবহ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যেভাবে বিভ্রান্ত করছে, সেভাবে মাতৃভাষার প্রতি তাদের কোন ধরনের শ্রদ্ধাবোধ-ভালবাসা কিংবা আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না। তিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গ তুলেও একই ধারণা পোষণ করেছেন। যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিরেকে যেসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় লাগামহীনভাবে গড়ে উঠছে সেখানে মাতৃভাষার কোন চর্চা নেই বললেও চলে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা ইংরেজী-বাংলা মিলিয়ে যে অদ্ভুত বাক্য গঠন করি সেটাও লেখিকাকে ভীষণভাবে আহত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব সংস্কৃতি চর্চা বিশেষ করে নাটকে আঞ্চলিক ভাষার সম্পৃক্তিকেও তিনি মানতে পারেননি। তাঁর মতে ভাষার পরিশুদ্ধতা ভাষা চর্চার অন্যতম একটি বিশেষ দিক। যা নতুন প্রজন্মকে অত্যন্ত পরিশীলিতভাবে আয়ত্ত করতে হবে যাতে আমাদের ঐতিহ্যিক বাংলা ভাষার গুণগত মান যেন ক্ষুণœ না হয়। গ্রন্থকারের এ অভিযোগকে আমলে নিয়েও বলতে হয়, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ কোন ভাষা কি অত সহজেই তার বিশেষত্ব হারায়? বাংলাভাষাও হারাবে না। সমাজের মতো কোন দেশের ভাষা ও বহুবিবর্তনের ফলশ্রুতি। যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া বাংলা ভাষায় যে সমৃদ্ধ রূপ তার শেকড় উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত এ ভাষার কোন অঙ্গহানি হওয়ার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই। বহুবার নানামাত্রিক এ ভাষার ওপর আক্রমণ এসেছে, ভাষাকে বিধ্বস্ত করতে মৌবাদী অপশক্তি খড়গহস্ত হয়েছে, এমনকি আমাদের ভাষার জন্য রক্তও দিতে হয়েছে। তার পরও আজ অবধি বাংলাভাষা তার গৌরব আর অহঙ্কার নিয়ে আপন মর্যাদায় টিকে আছে। অবশ্য জীবনবোধকেও জাগিয়ে দেয়। জীবনের আঙ্গিনায় পা ফেলতে সে সতর্ক হয়, সমাজ জীবনের গভীরে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, নিজের সম্পর্কে পাঠক সচেতন হয়, ভাবার অবকাশ পায়। মনে পড়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোট গল্প নিয়ে সেই অসাধারণ বাক্যটি, ‘বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা।’ এই গ্রন্থটিও পাঠক সমাজে আদৃত হবে বলে বিশ্বাস। বিশেষ করে এই সময়ে উদীয়মান তরুণ প্রজন্মকে তার মনন ও জীবন তৈরির জায়গায় বইটি নানামাত্রিক সাহায্য করবে। গ্রন্থটির জন্যও এর রূপকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এই গ্রন্থটিরও জীবন ও সমাজকে উপলব্ধি করার জন্য এক প্রাসঙ্গিক সংযোজন। অভিজ্ঞতালব্ধ চেতনার কিছু সুসংবাদ সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও এ ধরনের কিছু সংক্ষিপ্ত বাণীÑ উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে। অথবা যথাসাধ্য ভালো বলে ওগো আরে ভালো। কোন স্বর্গপুরী তুমি করে থাকে আলো। আরো ভালো কেঁদে কয়, আমি থাকি হায়, অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈষার। লেখিকার স্বল্প কথার বাক্যসমূহ অসাধারণ এবং জীবনঘনিষ্ঠ। প্রতিটি শব্দের যেমন গভীরতা তেমনি তার তাৎপর্য। সমাজের বিচিত্র অবস্থার সঙ্গে গ্রন্থকারের অনুভূতির যে নির্মল সংমিশ্রণ তা সত্যিই পাঠককে মুগ্ধ করে। শুধু মুগ্ধতাই নয়, এসব সংক্ষিপ্ত বার্তা পাঠক সাধারণের লেখিকা আমাদের বাংলাভাষার ঐতিহ্যকে প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করতে ভোলেননি। বইটি সুখপাঠ্য এবং আধুনিক প্রজন্মের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী নির্দেশনা। উদীয়মান কিশোর-কিশোরীদের মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টিতে বইটি বিশেষ অবদান রাখবে বলে মনে করি। হোসনে আরা শাহেদকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন এমন একটি মূল্যবান গ্রন্থ পাঠক সমাজকে উপহার দেয়ার জন্য। হোসনে আরা শাহেদকে অপর বইটি ‘শত পাতা’ যা সদ্য প্রকাশিত, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বইটির বিশেষত্ব হলো দীর্ঘ কোন বক্তব্য নেই এখানে। ছোট ছোট অনুভূতির সচেতন উপলব্ধিতে লেখা প্রতিটি পৃষ্ঠায় মাত্র দু’এক লাইনের কিছু শিক্ষণীয় বার্তা। পড়লেই বোঝা যায় জীবনের নানা পথ-পরিক্রমায়।
×