ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে মাতৃমহিমা

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৬ আগস্ট ২০১৬

নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে মাতৃমহিমা

বাংলা ও বাঙালীর জীবনে এক অবিস্মরণীয় কৃতী পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম। তার সৃষ্টি সম্ভার নানামাত্রিকে বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে যে পূর্ণতায় নিয়ে যায় তা যেমন যুগান্তকারী তেমনই ঐশ্বর্যে ভরপুর। একেবারে সাধারণ মানুষের কবি নজরুল ইসলাম নির্যাতিত, বঞ্চিত আর নিপীড়িতদের জীবন গাথা নিয়ে যে মহামূল্যবান সৃষ্টি জগত তৈরি করেছেন সেখানে আজও তিনি অনন্য। নজরুলের সুবিশাল সৃজনশীলতায় নারীর অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে তিনি যেমন তার লেখনীতে ঝড় তুলেছেন একইভাবে সমাজের দুর্বল অংশ হিসেবে নারী জাতির প্রতি হয়েছেন বিশেষ সহানুভূতিশীল এবং দরদী। তার সৃষ্টিকল্পে নারীর অধিকার, স্বাধীনতা এবং মর্যাদার লড়াইয়ে তার জোরালো সমর্থন ছিল নারীদের প্রতি। নারীর বিশেষ রূপের অন্যতম একটি পর্যায় হলো তার মাতৃমহিমা। স্নেহ, মায়া আর মমতায় নারী মাতা এ বোধ নজরুলকে সব সময় তাড়িত করেছে। আর সেই কারণে তার জীবন ও সাহিত্য মাতৃবন্দনা অন্যতম একটি পর্যায়। মাতৃত্বের আবেদনে নজরুলের জীবনে নারীর যে অবস্থান সেখানে সঙ্গত কারণেই প্রথমেই এসে যায় তার মাতা জোবেদা খাতুনের নাম। গৃহছাড়া নজরুলের সাংসারিক বন্ধন ছিল না বললে অত্যুক্তি হয় না। পারিবারিক সীমাবদ্ধ আলয় তাকে কখনও বন্ধনে জড়াতে পারেনি। ফলে জন্মদাত্রী মায়ের মমতার আচলও তার ভাগ্যে খুব কমই ঘটেছে। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতায় মাতা ও পুত্রের এই দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। কিন্তু নজরুলের নিজের ভেতরে এক ধরনের মাতৃআকাক্সক্ষা ছিল যার বহু দৃষ্টান্ত তার জীবনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এদের মধ্যে বিরজা সুন্দরী, মিসেস মাসুদা রহমান, গিরিবালা দেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। স্নেহের দানে মাতৃত্বের মমতায় মা বিরজা সুন্দরী নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। কুমিল্লার দৌলতপুরের নার্গিসের সঙ্গে নজরুর বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছিলেন এই মা বিরজা সুন্দরী। অজ্ঞাত কারণে বিয়ে আর হয়নি। এই বিরজা সুন্দরীর সঙ্গে নজরুলের যে স্নেহের বন্ধন গড়ে ওঠে তা মাতা-পুত্রের এক স্বর্গীয় সম্পদ। এই বিরজা সুন্দরীর মৃত্যুশয্যায় নজরুল তার পাশে ছিলেন। যা তার গর্ভধারিণী মায়ের বেলায়ও ঘটেনি। কোন এক অজানা কারণে নিজের মার সঙ্গে নজরুল কোন মায়া-মমতায় আবদ্ধ থাকেননি। ফলে তার জীবন ও সাহিত্যে মায়ের উপস্থিতি খুবই কম। এখানে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, হুগলী জেলে নজরুল ৩৯ দিনের এক অনশনে ছিলেন। সেই অনশন ভাঙানোর চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, চিত্তরঞ্জন দাশসহ অনেকে করলেও সে অনশন ভাঙানো যায়নি। এমনকি তাঁর মা জোবেদা খাতুনও এই অনশন ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিলেন। সেটাও সফল হয়নি। শেষ অবধি কুমিল্লা থেকে মা বিরজা সুন্দরী দেবী লেবুর রস পান করিয়ে নজরুলকে অনশন থেকে বিরত করান। এই বিরজা সুন্দরীর উদ্দেশ্যে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতাও আছে। সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার। তুমি কোনদিন কারও করনি বিচার, কারও দাওনি দোষ। ব্যথা- বারিধির কূলে বসে কাঁদ’ মৌনা কন্যা ধরণীর। নজরুলের জীবনে আর এক মায়ের ভূমিকায় গিরিবালা দেবী যিনি তাঁর স্ত্রী প্রমীলার মা। গিরিবালা নজরুল আর প্রমিলার সাংসারিক জীবনে দীর্ঘ দিন যুক্ত ছিলেন। কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামে কবির আরেক মায়ের নাম শোনা যায় যার স্নেহ- ভালবাসায় কবি অভিষিক্ত হয়েছিলেন। তাঁর নাম এখতারুন নেসা। কবি তাঁকে মা বলে ডাকতেন। তিনি নার্গিসের বড় খালা। কবি তাঁর ‘মা’ নামের কবিতাটি লেখেন এই এখতারুন নেসাকে নিয়েই। যেখানেতে দেখি যাহা মা-এর মতন তাহা একটি কথায় এত মধু মেশা নাই। মায়ের মতো এত আদর সোহাগ সে তো আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই। মাতৃত্বের অনাবিল সৌন্দর্যে নজরুলের বুভুক্ষ হৃদয়ের আকুল আর্তি। মায়ের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন নজরুল হয়তবা এভাবেই তাঁর মাকে খুঁজেছেন। স্নেহময়ী মায়ের ভালবাসা, সন্তানবৎসল মায়ের সীমাহীন দরদ এভাবে নজরুলকে মুগ্ধ করেছে, মাতৃ স্নেহধারায় এভাবে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। কুমিল্লার বিখ্যাত কংগ্রেস নেত্রী ও জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হেমপ্রভা মজুমদারও কবির কাছে ছিলেন মাতৃস্থানীয় তার স্নেহের দানে কবির জীবন নানামাত্রিকে সমৃদ্ধ হয়েছে। হেমপ্রভার বাসায় নজরুলের গানের আসর বসত। তকে উদ্দেশ করে লেখা নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘হেমপ্রভা’। মাতৃত্বের মহিমায় যে বিখ্যাত নারী নজরুলের বিভিন্ন সঙ্কটে তার পাশে ছিলেন তার নাম মিসেস মাসুদা রহমান সংক্ষেপে মিসেস এম রহমান। নজরুল প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র যে নারী বিভাগ ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ এরও নিয়মিত লেখিকা ছিলেন মিসেস এম রহমান। প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের বিয়েতে মিসেস এম রহমান মায়ের ভূমিকা পালন করেন। ‘সন্ধ্যাপ্রদীপে’ মিসেস রহমানের আক্রমণাত্মক লেখা সমকালে পুরুষ এবং নারী সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছিল। এই মায়ের সর্বক্ষণিক আশীর্বাদ নজরুলের মাথার ওপরে ছিল। স্নেহশীলা জননী রূপেও নজরুলের কাছে তিনি ছিলেন মাতৃত্বের এক উদ্দীপ্ত আধার। তাকে নিয়ে লেখা নজরুলের বিখ্যাত কবিতা মিসেস এম রহমান আজও কবির সৃষ্টি সম্ভারে এক অনবদ্য সংযোজন। তার অকাল মৃত্যু নজরুলকে বিশেষভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত করেছিল। এই মমতাময়ী নারী নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে যে অনবদ্য প্রভাব রাখেন তা আজও অম্লান। এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে কবির বিখ্যাত কবিতা ‘মিসেস এম রহমান’-এর কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি।- যাহাদের তরে অকালে আম্মা, জান দিলে কোরবান তাদের জাগায় সার্থক হোক তোমার আত্মদান। মধ্যপথে মা তোমার প্রাণের নিভিল যে দীপ-শিখা জ্বলুক নিখিল-নারী-সীমন্তে হয়ে তাই জয়টিকা। বিদ্রোহী কবি, বিপ্লবের সৈনিক, লড়াইয়ের দিশারী কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরে যে একটি কোমল, স্পর্শকাতর অনুভবে মাতৃস্নেহের প্রতি আকুলতা প্রকাশ পায় তা সত্যিই অনন্য। নিজের দ্বৈতসত্তাকে নিজেই এভাবে তুলে ধরেছেন। মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী ও নজরুলের জীবনে মায়ের আসনেই ছিলেন। এই স্নেহশীলা জননীকে নজরুল তাঁর ‘চিত্তনামা’ শোক কাব্যটি উৎসর্গ করেন। এভাবে মাতৃপ্রেমে পাগল নজরুল যেসব মাতৃস্থানীয় নারীর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের কাছে নিজেকে নানাভাবে নিবেদন করেছেন।
×