ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবিতা ইয়াসমিন

নজরুলের মননশীলতায় নারী-চেতনা

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৬ আগস্ট ২০১৬

নজরুলের মননশীলতায় নারী-চেতনা

শুধুমাত্র কবিতাতেই নয় কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা এবং মননশীলতায়ও ছিল নারী স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের এক দীপ্ত প্রয়াস। আবেগে আপ্লুত এবং কল্পনায় আচ্ছন্ন হয়ে কাব্যসম্ভারে নারীর যে লড়াইয়ের সুতীব্র আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয় নজরুলের সৃজন সৌধে; সেখানে যুক্তিশীল মনন এবং বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায়ও নারীর অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। অসংখ্য গদ্য লেখায় এই নারী ভাবনার চিত্র উজ্জীবিত হয়। নজরুলের গদ্য-সাধনায় বের হয়ে আসে নারী শিক্ষা, অধিকার, অবরোধ প্রথা সর্বোপরি আপন মর্যাদায় বেঁচে থাকার বলিষ্ঠ প্রত্যয়। সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে উপেক্ষা করতে পারেন না নজরুল নারী স্বাধীনতার বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার মতো নজরুল ইসলামও মনে করতেন, নারী জাতিকে তার সমস্ত অবরোধ আর শৃঙ্খল ভেঙ্গে দৃপ্ত মনোবলে সমস্ত বাধা-বিঘœ অতিক্রম করতে হবে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সভ্যতা থেকে অর্ধাংশ নারী জাতিকে পেছনে ফেলে সুষ্ঠুভাবে সমাজ কখনও এগিয়ে যেতে পারে না। তার মতে, ‘আমাদের সকল শুভ কাজ, কল্যাণ, উৎসব আজ শ্রীহীন, বর্ণহীন এবং প্রাণহীন। তোমাদের অর্ধেক আসন ছেড়ে দাও কল্যাণী নারীকে। দূর করে দাও তাদের সামনের এই অসুন্দর অবরোধ। দেখবে তোমাদের কর্তব্যের কঠোরতা, জীবনপথের দূরধিগমতা হয়ে উঠবে সুন্দরের স্পর্শে পুষ্প পেলব।’ যুগ যুগ ধরে শোষিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত নারী সমাজের অসহায়ত্ব তাকে বার বার উদ্বিগ্ন করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে এবং শেষ অবধি সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথও নির্দেশিত হয়েছে। বিশেষ করে অবরোধ প্রথাকে কখনও মানতে পারেননি বেগম রোকেয়ার মতো। বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও এই পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার জন্য নারী জাতিকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, এ দেশের মেয়েরা বড় অসহায়। অনেক প্রতিভা নিয়ে জন্মালেও পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় তারা নিজের প্রয়োজনে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। বিশেষ করে সীমাবদ্ধ আলয়ে তাদের বন্দিনী থাকার কারণে। তিনি মনে করতেন মেয়েরা চাইলে যুগের প্রয়োজনে তারা তাদের এই অর্গল ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে পারেন। তার ধারণা ছিল এই শৃঙ্খল শুধু বাইরে থেকে নয় ভেতর থেকেও। অর্থাৎ বাধা শুধু সমাজ কিংবা পুরুষরা নয়, বাধা নারীরা নিজেই নিজেদের। নজরুল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন পুরুষরা অবরোধ আরোপকে নির্বিঘœ করেছে নারীর শিক্ষাহীনতায়। তিনি মনে করতেন নারী মুক্তির প্রধান অস্ত্র শিক্ষা ও জ্ঞান। জ্ঞানের উদ্দীপ্ত শিখাই নারীকে তার সমস্ত অধীনতা, অমর্যাদা এবং হীনম্মন্যতা আর অন্ধকার থেকে মুক্তি দেবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে পুত্র-কন্যার অসাম্য বৈষম্যকে তিনি কোনভাবেই মানতে পারেননি। ‘কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেয়া যে, আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া ও হতভাগিনীদের চিরতরে বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি।’ কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র চিন্তাশীলতায় কিংবা বক্তৃতা দিয়েই নারী স্বাধীনতার দিক নির্দেশ করে ক্ষান্ত হননি, এর জন্য বাস্তব পদক্ষেপও নিয়েছেন নির্দ্বিধায়। তার প্রকাশিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামে মহিলাদের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ ছিল। সেখানে নারী শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে অবরোধ প্রথা, নারী নির্যাতন, পুরুষতন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাব এর বিরুদ্ধে সোচ্চার, প্রতিবাদ সব ধরনের বিষয়ই গুরুত্ব পেত। সমকালে এই ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ বিভাগ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এখানে শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও এ বিভাগের বিরুদ্ধচারণ করতে পিছপা হয়নি। মহিলাদের এই বিশেষ বিভাগে মিসেস এম রহমানের পাঁচটি জ্বালাময়ী নারী বিদ্রোহের প্রবন্ধ ছাপা হয়। যাকে নজরুল মায়ের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে নজরুলের একটি কবিতাও আছে। এ বিভাগে নজরুল ইসলাম নারীদের যে কোন ধরনের লেখা ছাপাতে দ্বিধা করতেন না। এভাবে নারীদের সামনে এগিয়ে চলার পথকে তিনি নানাদিক থেকে সুযোগ সৃষ্টি করতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। প্রতিভাদীপ্ত, সৃষ্টিশীল নারীরা যাতে অবাধে, নিঃসঙ্কোচে তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা পাওয়ার ব্যাপারে নিজেদের মতামত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারে। নারী স্বাধীনতার আর এক জাগ্রত সৈনিক বেগম সুফিয়া কামালের সৃষ্টিশীল জগতে নজরুল ইসলাম এক বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন। সুফিয়া কামালের প্রথম কাব্য ‘সাঁঝের মায়া’ নজরুলের হাতে গিয়ে পৌঁছলে নজরুলের যে অভিব্যক্তি তা সত্যিই প্রশংসনীয়। নজরুল প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলেন না কোন মুসলিম অবরোধবাসিনী বালিকা এত মানসম্পন্ন এক গুচ্ছ কবিতা লেখার ক্ষমতা রাখেন। নজরুলের উৎসাহ ও উদ্দীপনার ‘সাঝের মায়া’ প্রকাশ পেয়ে পারিবারিক সীমাবদ্ধ গ-ি থেকে সর্বসাধারণের সম্মুখে উন্মোচিত হলো। নারী স্বাধীনতার আর এক সচেতন প্রবাদপুরুষ তো বটেই। এভাবে নজরুলের জীবনে অনেক খ- খ- ঘটনা বিধৃত আছে যেখানে নারীর অধিকার ও মুক্তির জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে। জীবনভর নারী জাতির প্রতি সহানুভূতিশীল, দরদী এবং আবেগপ্রবণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীদের উৎসাহ দিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন সর্বোপরি পথনির্দেশকও ছিলেন।
×