ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

নজরুলের রোমান্টিসিজম

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৬ আগস্ট ২০১৬

নজরুলের রোমান্টিসিজম

রোমান্টিসিজমের সূত্রপাত জার্মানিতে হলেও এর বিকাশ ঘটে ইংল্যান্ডে; যদিও ইংলিশ লেখক পি.বি. শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এসটি. কোলেরিজ, লর্ড বায়রন, উইলিয়াম ব্লেক প্রমুখ যুগসৃষ্টিকারী রোমান্টিক কবিরা ফ্রেঞ্চ সাহিত্য ও ফ্রেঞ্চ রেভুলিউশনের দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত। ১৭৯৮ সালে কোলেরিজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘লিরিকাল ব্যালাড’ প্রকাশ রোমান্টিক আন্দোলনকে দারুণভাবে নতুন গতি দান করে। প্রেমাবেশ, গভীর অনুভূতি, মিষ্টিক চেতনা, প্রকৃতি-আশ্রয়, সমৃদ্ধ কল্পনা, সুন্দরের আরাধনা, অতি-প্রাকৃত ধ্যানের রূপায়ণ, অতীতমুখিতা, ক্ষুদ্রের মাঝে মহত্তমের প্রকাশ ইত্যাদি রোমান্টিসিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য। যদিও নজরুলকে বাংলার বায়রন বা শেলী বলা হয় কিন্তু কমবেশি সব রোমান্টিক কবিরাই তাকে প্রভাবিত করেন; এমনকি নজরুল রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ভাবনা দিয়েও প্রভাবিত আবার ফ্রেঞ্চ রেভুলিউশনের মর্ম বাণী সমতা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ ও ভ্রাতৃত্ব নজরুলকে প্রভাবিত করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। পি.বি. শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলেরিজ, লর্ড বায়রন, উইলিয়াম ব্লেকরা যেমন ইংরেজী রেনেসাঁর প্রতিভু তেমনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক রেনেসাঁর অগ্রদূত। রোমান্টিসিজম সবকিছুকে; এর বক্তব্য থেকে শুরু করে ছন্দের গঠনকে নতুনভাবে বিনির্মাণ করে। এটা আসে ক্লাসিকাল গৎবাঁধা নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে এক আলোকিত, সুবাসিত, বর্ণিল, কল্পনা-আশ্রিত, প্রকৃতিনির্ভর নতুন কাব্য আন্দোলনরূপে। ফেঞ্চ রেভুলিউশনের মূল বাণী, সমতা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ ও ভ্রাতৃত্ব নজরুল ধারণ করেন তার কবিতায় যে সাম্যের কথা ফ্রেঞ্চ রেভুলিউশনের মূল মন্ত্র আমরা তা পাই নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতায় : ‘গাহি সাম্যের- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। নাই দেশ কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ কবিতাটির মূল বক্তব্যে কবি দেখিয়েছেন কিভাবে স্রষ্টা সকলের মাঝে, হতে পারে ভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, মতামতের সমানভাবে বিরাজ করেন সমান ভালবাসা নিয়ে, ন্যায় নিয়ে; যে ন্যায়ের ভাগিদার সবাই। নজরুল ছিলেন একজন খাঁটি রোমান্টিক। আগেই বলা হয়েছে রোমান্টিক যুগ বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আর তা আসে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের হাত ধরে। রোমান্টিসিজম ছোট্ট কোনো ধারণা নয়; এটি ব্যাপক একটি ব্যাপ্তি নিয়ে সাহিত্যে যে নবজাগরণ নিয়ে আসে পুরো সমাজ জুড়ে আছড়ে পড়ে তার উত্তাল ঢেউ। সাহিত্য থেকে চিত্রকলা, নানা ধরনের চারু ও কারু-কলা থেকে বিস্তার লাভ করে এটি সমাজ জীবন থেকে মানব জীবনে আঁচড় কেটে যায়। রোমান্টিসিজম পরিবর্তন নিয়ে আসে মানসিকতায়, মননে, চিন্তায় ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে। ব্যক্তি যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে। পুরাতন ও ক্লিশে ধারণার বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে রোমান্টিকতা ব্যক্তি মননে দেয় স্বাধীনতা, নতুনত্বের আভাস। নতুন কল্পনা শক্তির আধার একেকজন রোমান্টিক কবি- তাদের কল্পনায় তারা সুন্দরের উপাসক। তাই নজরুল আগমনীর বার্তা শোনান ছান্দসিক বুননে ‘ঐ নতুনের কেতন উড়ে কালবোশেখীর ঝড় / তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ যেমনভাবে রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের রুদ্ররূপ দিয়ে ক্ষুদ্রতাকে আর পঙ্কিলতাকে বিদায় করে আবার শুরু করতে চান প্রথম থেকে নব-সুন্দরে অবগাহন করে। রোমান্টিকতার মাঝে নতুন আছে, কিন্তু পুরাতন একেবারে বাদ যায় না; এটি হারিয়ে যাওয়া আঁধার থেকে আলোককে নিংড়ে বের করতে চায়; বিদায়ের ব্যথাটুকু সুখানুভূতিতে মিশিয়ে পুরাতনকে বাদ দিতে দ্বিধা করে না। বেদনার মাঝে যে আনন্দ আছে রোমন্টিক কবিরা তাই ভালবাসেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘ভালোবাসার-ঘাঁয়’ ও ‘মধুর-বেদনা’কে এক করে নেন তেমনি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটসের অনেক কবিতায় আমরা দেখি বেদনাকে বুকের কাছে রেখে, সুখের পাশে রেখে জীবনের সুখ-দুঃখের মেল বন্ধনকে মেনে নেন। নজরুল ইরানী গুলিস্তানে খোঁজ করেন ফেলে আসা স্বর্গকে। নূরজাহান-শিরি-ফরহাদ-সিরাজের মাঝে সৌন্দর্যের উন্মোচন দেখেন। ভঙ্গুরের পাশে চিরায়ত সুন্দরকে রেখে কল্পনা রাজ্যে ডুব দেন। আবার তারা প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ সব রাঙিয়ে এই পৃথিবীকে করে তুলতে চায় স্বল্পকালীন এক স্বর্গ। ছোট্ট এককণা ঘাসকেও তারা অনেক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। যেমন হুইটম্যান একটি ঘাসের ডগা আর মখমল ঘাসকে বলেন বিধাতার সুগন্ধ-রুমাল। এক আশ্চর্য জগত যা এ জগতের পাশেই বিরাজ করে তাই তারা আবিষ্কার করেন। নজরুলের কল্পনা, তাকে সম্মোহিত করে নিয়ে যায় দারুচিনি দ্বীপের দেশে। আবার ‘পূজারিণী’ কবিতায় নজরুল শুধু খাঁটি সুন্দরের সাধক নন; তিনি গোথীক-বৈশিষ্ট্যে তার অতীতমুখিতায় হারানো সুন্দরের অনুসন্ধান করেন: দক্ষিণা সমীরে ডাকো কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন! আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় গন বেদনার মায়া করুণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।’ পূজারিণী’ কবিতাটিতে ঐন্দ্রজালিক মায়া রয়েছে, ফেলে আসা অতীতের জন্যে রচিত হয়েছে দীর্ঘশ্বাস, সুন্দরের প্রতি আছে আকুতি যা রোমান্টিকদের একটা বৈশিষ্ট্য। আর নজরুলের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য তার অনেক কবিতাতেই পাওয়া যায় যা চলে আসে তার সহজাত রোমান্টিক মানসিক গঠনে ও অসাধারণ সৃষ্টিশীল সৌকর্যে। আবার অন্যদিকে সমতা, স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাও রোমান্টিকদের মাঝে এক অপূর্ব প্রচেষ্টা হয়ে থাকে। এই দিক বিবেচনায় নজরুল আর বাকি সব রোমান্টিকদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী, তার প্রদীপ্ত কবিতা, জ্বালাময়ী গান মানুষে মানুষে সমতার যে বারতা রেখে গেছে তা পি.বি.শেলী, লর্ড বায়রন, ব্লেক, উইলিয়ম এডওয়ার্ড বার্গাট বা মেরি ইভান্সের চেয়েও অনেক বেশি আধুনিক এই ক্ষয়িঞ্চু মানবিক সঙ্কটময় বিশ্বে। বিশ্বায়ন যেমন অনেক সুযোগ সুবিধা মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছে তেমনি হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, এক বিরামহীন নৈরাজ্য পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে করুণ এক অনিঃশেষ মানবিক সমস্যার শেষ প্রান্তে। তাই রোমান্টিক কবিরা যখনি কোনো অন্যায়, অবিচার দেখেছেন তারা মাথা নত না করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। আমরা এর প্রমাণ নজরুলের ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘কামাল পাশা’তে দেখতে পারি। আর বিদ্রোহী’ কবিতাটি বিশ্ব মানবতার মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার এই কবিতা অসত্য, সাম্রাজ্যবাদ, অন্যায় তা যে রূপেই আসুক তা প্রতিহত করে মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করার এক অমোঘ জাগ্রত বাণীমালা হয়ে আছে যুগের পর যুগ। এর সঙ্গে শেলীর ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ এর বেশ খানিকটা মিল আছে আবার হুইটম্যানের ‘সং অব মাইশেলফ’ এরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ এ বিদ্রোহীর মতোই উচ্চারিত হয় ‘মাথানত করে থাকা তোমরা জানো আমি তা পরোয়া করি না/ আর আনুগত্য একটা শব্দ ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই না’/ আনুগত্য দাসত্বের মৃত্যু পরোয়ানা/ আর কিসে আমি নত হবো/ যা আসুক সামনে কিছুতেই নয়।’ নজরুল যখন বিদ্রোহীতে মাথানত করতে চান না তিনি আরো প্রখর: আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!’ বলা যায় বিদ্রোহী কবিতা ১৯৪৭ এ বিট্রিশদের তাড়াতে যেমন অনুপ্রেরণা ছিলো তেমনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিলো অনিমেষ প্রেরণা। রোমান্টিকদের মাঝে যেমন কল্পনার আশ্রয় আছে, বিমুগ্ধতা আছে, বাসনার পেয়ালা পূর্ণ করার বিরাট অতৃপ্তি আছে; আছে সীমার মাঝে অসীমকে খুঁজে নিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করবার প্রয়াস। রোমান্টিকরা প্রথম ধাপে নিজেকে চিনবার জানবার প্রচেষ্টায় থাকে মগ্ন-অবিচল। সক্রেটিসকে যদি আমরা আদি রোমান্টিক বলি তবে বলতে হয় রোমান্টিসিজমের বীজ তিনি বপন করে গেছেন সবার আগে। নিজেকে জানার সুতীব্র আকাক্সক্ষা থেকে বলেছিলেন ‘নো দাই শেলফ’ বা নিজেকে জানো। নিজেকে জানা অর্থ হচ্ছে অন্যকে জানার প্রথম ধাপ। একথাই কবিগুরু বলেন তার গানে অন্য ব্যঞ্জনায়, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি’; আমাদের হৃদয়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে সুন্দর আর না জানা সত্য কবি আমাদের তাই দেখতে বলেন। এই কথাটিই লালন বলেন একটু ঘুরিয়ে; আমরা জানি মহাত্মারা একই কথা ভাবেন শুধু আঙ্গিকটা আলাদা। লালন তাই বলেন ‘আপনারে চিনতে পারলে যাবে অজানারে জানা।’ তাই বলা যায় বহুদূর, বহুদেশ না ঘুরে নিজেকে চিনলে অজানাকে চেনা যাবে; যে অজানা রোমান্টিক কবিদের; না পাওয়ার বেদনা নিয়ে নিয়ত তাড়িত করে; কিন্তু তারা কল্পনার রঙে রঞ্জিত হয়ে সেই অজানাকে জানতে পারেন। নজরুলও এর ব্যতিক্রম নন; তার বিখ্যাত উক্তি ‘তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান/ সকল শা¯্রখুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ।’ নিজেকে জানবার, চিনবার এই আহ্বান সত্যি অনন্য। সৃষ্টিকর্তা যে প্রতিটি মানুষকে একক হৃদয় দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আর তা যে মহামূল্যবান তা আমরা নিজেই ভুলে বসে থাকি। প্রতিটা মানুষের মাঝে সত্য, সুন্দর, জ্ঞান, বিবেক স্ব-স্ব ভাবে আছে। বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতার শেষে এসে নজরুল আরো পরিষ্কার করে বলেন : ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।’ পবিত্র কাবা-শরীফ হচ্ছে সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতার মিলনস্থল তেমনি আমাদের প্রতিজনের হৃদয়ও একেকটি সত্য, সুন্দর আর পবিত্র স্থান; এত সুন্দরের, সত্যের পরিচর্যা আমাদের আমিকে জাগিয়ে তুলে, মিথ্যা, অন্যায়, অসত্যকে করে দিবে দুর্বল। তাই অন্য কেউ নয় ব্যক্তি নিজেই নিজেকে পবিত্রতার মাঝ দিয়ে সত্যের পথে নিয়ে যেতে পারে করতে পারে মিথ্যাকে পরাজিত। অসম্ভবকে সম্ভবনা দেয়া রোমান্টিসিজমের আরেক দিক যেটি নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে’ কবিতায় পাওয়া যায়। এখানে কবির প্রকৃতি প্রেম দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কবি পাহাড়ের উত্তাল ঝরনা হয়ে যান: ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। ওই পাহাড়ের ঝরনা আমি, ঘরে নাহি রইগো।’ চির দুর্নিবার কবি মন; চঞ্চল তার গতি; অকুতোভয় কবি মিশে যান আদি প্রকৃতির সাথে : ‘চিতা বাঘ মিতা আমার গোখরা খেলার সাথি সাপের ঝাঁপি বুকে ধ’রে সুখে কাটাই রাতি।’ এই কবিতাটির সাথে কোলরিজের ‘কুবলা খান’ কবিতার বেশ মিল পাওয়া যায়; দুটি কবিতাতেই অতিপ্রাকৃত আবহ আর গা ছমছমে একটা ভাব কাজ করে। এবং দুটি কবিতাই শেষ হয়েও শেষ হয় না আরও কিছু বাকি বলার থাকে কিন্তু কবি মানসে যতটুকু চিন্তার প্রকাশ ততটুকুই কবিতা দুটোতে স্থান পায়। নজরুলের কবিতা ও গানে বিস্তৃতভাবে প্রকৃতি- বন, ফুল, পাখি, গাছ, চাঁদ, তারা, আকাশ, বৃষ্টি, পাহাড় ইত্যাদি স্থান পায় যা রোমান্টিক কবিদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। তার ‘আশা’ কবিতাটি একটি উল্লেখযোগ্য রোমান্টিক কবিতা; এতে কল্পনা, ইচ্ছা, ভালবাসা, নিভৃত প্রকৃতি সব একাকার হয়ে মিশে যায়। এখানে কবির বিজন মনের বাসনা পরিতৃপ্ত হয় তার প্রেয়সীর সাথে কল্পনা ভুবনে অবগাহন করে: ‘হয়ত তোমার পাবো দেখা, যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা।’ কবিতাটিতে প্রেয়সির চুম্বন আমাদের কীটসের কবিতা ‘ওড অন আ গ্রেসান আর্ন’ এর প্রেয়সির অধরা চুম্বনের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘বনের ফাঁকে দুষ্টু তুমি আস্তে যাবে নয়ন চুমি, সেই কথা লিখছে হেথা দিগ¦লয়ের অরুণ-লেখা।’ আবার কবির কী অতুলনীয় শব্দ চয়ন আর চিত্রকল্পরূপ যখন তার গানে কবিতার প্রেয়সিকে আমন্ত্রণ করেন: ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল’ তারাকে ফুল বানিয়ে প্রেমিকার খোঁপায় পরানোর কল্পনা-বিলাস শুধু রোমান্টিক কবিরাই দেখাতে পারেন। ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতাটি আকাশ পিয়াসি কবিবে মৃন্ময় করে তুলে। এখানে আমাদের রবী ঠাকুরের ‘মাটির ডাক’ বা কীটসের ‘ওড টু অটম’ এর কথা মনে পড়ে যায়। আরেকটি ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো কবির সাধারণ একটি ঝিঙে ফুলকে কবিতার বিষয়বস্তু করে তোলা। যেমনভাবে আমরা দেখি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় একটি রাখাল বালক কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে যায় বা ব্লেকের কবিতায় গৃহহীন, ঝাড়ুদার শিশুরা স্থান পায় সম্মানের সাথে। যে ব্যাপারটা স্মরণযোগ্য তা হলো রোমান্টিক কবিরা ক্লাসিক্যাল যুগের রাজা-রানিদের নয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নয় অতি ক্ষুদ্র, অসহায়, নিপীড়িতদের তাদের কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র দান করেন। কবিতা মুক্তি পায় যেন অনেকটা শেকল থেকে- বাঁধা-ধরা নিয়মের ঘেরাটোপ থেকেও। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে রোমান্টিক কবিরা আধুনিক কবিদের জন্যে বিষয় বস্তুতে আর চরিত্রে নতুনের বীজ বপণ করে দিয়ে যান। তাই সাধারণ ঝিঙে ফুল নজরুলের কাছে হয়ে ওঠে বহুমূল্য ‘ঢল ঢল স্বর্ণ’। কবির মাটির কাছে থাকার আকুতি আমাদের সহজ সরল জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়- মনে করিয়ে দেয় ‘নোবেল সেভেজ’ এর কথা। রবীন্দ্রনাথকে দামী কিছু নয় মন ভুলিয়ে, কেড়ে নিয়ে যায় রাঙা মাটির পথ আর নজরুলকে মাটিতে নামায় ঝিঙে ফুল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে, কীটস ও শেলী পাখির ডাকে পৃথিবীর মাঝে অতুলনীয় অনুভবে ক্ষুদ্র স্বর্গ খুঁজে পান। এভাবেই রোমান্টিক কবিরা প্রকৃতি-সান্নিধ্যে স্বর্গতুল্য করে তোলেন পৃথিবীকে। প্রকৃতি বিছিন্নতা এই কোমলপ্রাণ রোমান্টিক কবিদের করে তোলে বিমর্ষ। তাই আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখি মাটির ডাকে শান্তি নিকেতনে ফিরে যেতে; বা নিজের পরিকল্পনায় শান্তি নিকেতন গড়ে তুলতে। টমাস মুর যে ইউটোপিয়া বা স্বর্গ রাজ্যের বর্ণনা দেন তা প্রকৃতির কোলেই যার সাথে স্পেনসারের আর্কেডিয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নজরুলকে আমরা দেখি ‘বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি’ কবিতায় বিষন্ন মনে সুপারির গাছেদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। কোনো মানব বা মানবী নয় একদল সুপারির গাছ ছেড়ে যেতে কবি মন কেঁদে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘তপোবন’ আর কবিতা ‘বনবাণী’ এই গাছদের নিয়েই। ‘আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি’ বা ‘কাঁদিতেছে চাঁদ’ ‘আঁধারের এলোচুল’ ‘আপন মনে পুড়িব একাকী’ এই কথাগুলো নজরুলের যে অব্যক্ত বেদনা তা প্রবলভাবে প্রকাশ করে। কবি যে কতোটা বেদনা-আক্রান্ত তা এই লাইনগুলোতে আরো বেশি পরিলক্ষিত হয়: ‘জানি- মুখে মুখে হবে না মোদের কোনোদিন জানাজানি বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপাণি। ’ আসলে রোমান্টিক কবিরা ভালো করেই জানেন তাদের যে কল্পনা রাজ্যে অবগাহন তা নিছক এক মায়া। তারা মায়াবনে অযথাই বিহার করেন। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তবতা মিলে তারা যে পরাবাস্তব জগত গড়ে তুলেন তা নিমিষের জন্যে হলেও তাদের অশান্ত হৃদয়কে শান্তি দেয়। রবীন্দ্রনাথ তার কল্পনার বিহার শেষে ব্যথিত মনে বলেন, ‘আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন বাতাসে/ তাই আকাশকুসুম করিনু চয়ন হতাশে।’ নজরুলও এই কথাটি অকপটে স্বীকার করেন : ‘হয়ত: তোমারে দেখিয়াছি, তুমি যাহা নও তাই ক’রে ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে।’ কী অসাধারণ আর স্পষ্ট কবির স্বীকারোক্তি, কবি জানেন তিনি যাকে নিয়ে এতো কল্পনা বিলাস করছেন তা আদতে কেবল এক মায়া কিন্তু বাস্তব-বিবর্জিত কল্পনা-আশ্রয়ী কবিদের যে এটাই শেষ ভরসা। জাগতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বেদনা, অন্যায়-অবিচারে কোমল প্রাণ কবি মানস কল্পনার স্বপ্ন রাজ্যে খুঁজে ফেরে সুখ। আর এই কল্পনা রাজ্যে অবগাহন করতে গিয়ে তারা তাদের বিপুল কল্পনা শক্তি দিয়ে তৈরি করেন নব-নব আশা আর প্রতিশ্রুতির এক নতুন বিশ্ব-জগত যেখানে আছে শুধু বিলাস-বাসনে ভেসে যাওয়া। কীটসের বিখ্যাত ওডগুলো কল্পনার অনুরাগে ভীষণভাবে রঞ্জিত আবার এগুলো শেষ হয় প্রশ্নের পর প্রশ্ন দিয়ে। তেমনি ‘বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি’ শেষ হয় প্রশ্ন দিয়ে আর ক্ষণিকের অতিথি স্বপ্নচারী কবিদের কথাও মনে করিয়ে দেয় এটি: ‘তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমাবে যবে, মূর্ছিতা হবে সুখের আবেশে, - সে আলোর উৎসবে মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর? তোমার নিশাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার?’ কিন্তু শুধুই স্বপ্ন বিলাসিতা নয় কবিদের বাস্তব থেকে এই কল্প-রাজ্যে গমন আবার বাস্তবে ফিরে আসা এতে তাদের জীবন সম্বন্ধে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ হয়; আর এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবন সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি দান করে। এই জীবনে ব্যথা থাকতে পারে এটি আঘাত দিতে পারে তাই বলে এ জীবন ত্যাগ করে শুধু কল্পনা রাজ্যে ভেসে গেলে চলবে না। তাই স্বপ্নচারী রোমান্টিক কবিরা শেষে আবার ফিরে আসেন এই কাদা-মাটির মর্ত্যকুলে। আমরা তেমনি ‘চৈতি হাওয়া’ আর ‘কৃষাণের গান’ কবিতায় দেখি নজরুল অপরূপ প্রকৃতি আর প্রিয় মাটিতে ফিরে আসেন; ফিরে আসেন সত্যে আর বাস্তবে। তার কল্পনা যেমন সমৃদ্ধ তেমনি নিটোল বাস্তবতাকে গ্রহণও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকে। ‘চৈতি হাওয়া’ কবিতায় কবি আবার নতুন করে এই মর্ত্যকুলে জেগে ওঠেন। কবিতাটিতে কবির মর্ত্যপ্রিয়ার সাথে মিলনের তীব্র আকাক্সক্ষা যেমন আছে, আছে ঋতুরাজের অনুপম বর্ণনা; চৈত্র্য সময়কে কবি এই পৃথিবীর বুকে ছোট্ট এক স্বর্গ-কানন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এর সাথে কীটসের ‘ওড টু অটম’ কবিতার হেমন্তের যে অতুলনীয় বর্ণনা তা মিলে যায়। কীটসও এই মাটির পৃথিবীতে ফিরে আশ্চর্যভাবে এর রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণে মাতোয়ারা হয়ে যান। শরত তার দৃশ্যপটে মোহনীয় তুলনাহীন এক রূপের আধার হয়ে ধরা পড়ে। বস্তুত নজরুলের বিদ্রোহ আর রোমান্টিসিজম হাত ধরাধরি করে চলে তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অনেকটা জুড়ে রোমান্টিক চিহ্ন পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলেন : ‘আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বি নয়নে বহ্নি’ অথবা, ‘আমি আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড় চিত- চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!’ কবিযে একই সাথে বিদ্রোহি আর প্রেমিক হৃদয়-পুরুষ তা বিদ্রোহী কবিতাতেই বলে যান। কারণ তার এক হাতে প্রেমের বাঁশরী আর এক হাতে থাকে রণ-তূর্য। এভাবেই নজরুল তার অসামান্য রোমান্টিক প্রতিভা দিয়ে বিদ্রোহের দীপ্ত শিখা জ্বালিয়ে চলেন কখনো কোমলভাবে আবার কখনো স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি; তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, নাট্যকার, গল্পকার আবার ঔপন্যাসিক। দিনে দিনে তাকে নিয়ে লেখবার প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। তার অসামান্য প্রতিভার অল্পই আমরা জানতে পেরেছি। তার বিদ্রোহী ও রোমান্টিক সত্তার পুরোটা একপাতায় লিখে শেষ করা যায় না। যত সময় গড়াবে তিনি আরো বেশি আবেদন যুগিয়ে নতুন সময়ের চাহিদা মিটিয়ে; পাঠক মনকে যেমন করবেন উদ্দীপ্ত তেমনি সমাজে তার লেখা নতুন দিনের আলোকবার্তা ছড়াবে যুগে যুগে এ আশাবাদ ব্যক্ত করা যায় নির্দ্বিধায়।
×