ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডিএপির ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণ

বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা, আজ চীনা প্রকৌশলীরা আসছেন

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৬ আগস্ট ২০১৬

বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা, আজ চীনা প্রকৌশলীরা আসছেন

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ কীটনাশক কারখানায় ৪০ টনের একটি কেমিক্যাল ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণে ভারতের ভূপালে প্রাণ হারিয়েছিল আট থেকে দশ হাজার মানুষ। আর চট্টগ্রামে ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) কারখানায় ৩শ’ টনের এ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। বড় ধরনের একটি বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে চট্টগ্রাম। সে রাতের কথা মনে করতেই শিউরে উঠে কর্ণফুলীর তীরবর্তী আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়া গ্রাম ও বন্দরনগরীর একাংশের অধিবাসীরা। দুর্ঘটনার কারণ যা-ই হোক না কেন, সমন্বিত উদ্যোগে দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে ফায়ার সার্ভিস, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মীরা। এতেই রক্ষা। এদিকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বৃহস্পতিবার অকুস্থল পরিদর্শনে আসে বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) গঠিত ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি। আজ শুক্রবার আসছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল কমপ্লিট প্ল্যান্ট ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (কমপ্ল্যান্ট) প্রকৌশলীরা। তারা দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ করবেন। গত ২২ আগস্ট সোমবার রাতের ঘটনায় যেভাবে গ্যাস ছড়িয়ে বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল, তাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। চট্টগ্রামে ‘ভূপাল ট্র্যাজেডি’ নয় তো! মানুষকে সাহস দেয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন ও বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল- ‘এ্যামোনিয়া প্রাণঘাতী কোন গ্যাস নয়, এতে মৃত্যুঝুঁকি নেই।’ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়া মানুষদের সাহস যোগাতে তখন হয়ত সেভাবে সাহস যোগানোর প্রয়োজন ছিল কিন্তু বিষয়টি যে ফেলনা নয়, তা পরিষ্কার হয়েছে পরদিন ওই এলাকায় মৎস্য সম্পদ ও গবাদিপশুর প্রাণহানি এবং জ্বলে পুড়ে যাওয়া বিবর্ণ গাছপালার চিত্রে। তীব্র শ্বাসকষ্টে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শত শত মানুষ। এলাকায় এখন সেই বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ না থাকলেও বাতাসে বিকট গন্ধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাছ পচা গন্ধও। সে এলাকার জনসাধারণকে চলতে হচ্ছে নাকে মাস্ক অথবা রুমাল চেপে। এ বিস্ফোরণের ক্ষতিকর প্রভাব মানবদেহে দীর্ঘায়িত হয় কিনা, সে আশঙ্কায়ও রয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তবে বড় ধরনের শিল্প বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া গেছেÑ এটা ভেবে স্বস্তিতে এলাকাবাসী। ডিএপির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল কান্তি বড়ুয়া বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে বলেন, এ্যামোনিয়া গ্যাস তরল আকারে রাখা হয় মাইনাস ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়। এর তারতম্য হলে কিছু তরল বায়বীয় আকার নিতে পারে। কিন্তু তাতে যেন কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য রয়েছে বিশেষায়িত প্রযুক্তি। এর মধ্যে একটি হলো ফ্লেয়ার পাইপ, যার মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্যাস বেরিয়ে আসে এবং নিজে নিজেই পুড়ে যায়। আর একটি ব্যবস্থা হলো সেফটি বাল্ব। এর মাধ্যমে কিছু গ্যাস জমা হলে তা বেরিয়ে যায়। এছাড়া আরও কিছু সিস্টেম রয়েছে। একটি সিস্টেম ঠিক থাকলেও এ দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একই সময়ে সব সিস্টেম কেন অকার্যকর থাকল সেটিই চিন্তার বিষয়। এক্ষেত্রে কোন কারিগরি ত্রুটি বা কারও কোন দায়িত্বহীনতা ছিল কিনা, তা নিশ্চয়ই তদন্তে বেরিয়ে আসবে। কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ বা ওভারহোলিং নিয়মিত হতো কিনাÑ এ প্রশ্নের জবাবে ডিএপির এমডি জানান, সার কারখানাগুলো বছরে গড়ে দুই থেকে তিন মাস বন্ধ থাকে। গ্যাস পাওয়া না গেলেও শাটডাউন দিতে হয়। তখনই রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলে। সুতরাং এক্ষেত্রে কোন ঘাটতি ছিল না বলে তিনি জানান। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কাছাকাছি দূরত্বের মধ্যে রয়েছে কর্নফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ও ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) কারখানা। এ তিনটি স্থাপনাই বেশ স্পর্শকাতর। সেখানে কাজ হয় এ্যাসিড, এ্যামোনিয়া ও বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ডিএপি কারখানায় রয়েছে ৬০ হাজার টন ফসফরিক এ্যাসিড ও ৬ হাজার টন এ্যামোনিয়া গ্যাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা। মোট ৩টি ট্যাঙ্কে এ্যামোনিয়া মজুদ করা হয় ৬ হাজার টন। এর মধ্যে মাদার ট্যাঙ্কে ৫ হাজার টন ও দুটি ইউনিটের পৃথক ট্যাঙ্কে ৫শ’ করে এক হাজার টন। এছাড়া কাফকোতে ২০ হাজার টন ও সিইউএফএল সার কারখানায় ৫ হাজার টন এ্যামোনিয়া মজুদ থাকে। এ চিত্রই বলে দেয়, ওই এলাকাটি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। ডিএপির একটি ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের ধাক্কা লাগতে পারত অপর দুটি ট্যাঙ্কেও। তাহলে ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে পৌঁছত তা অকল্পনীয়। আনোয়ারা ও চট্টগ্রাম নগরীর একাংশে ঘটে যেতে পারত মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা গেছে বলেই এ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডিএপির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল কান্তি বড়ুয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটতে পারে তা তো কেউ ভাবেনি। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার অভিজ্ঞতাও আমাদের নেই। তারপরও অল্প সময়ের মধ্যেই সকল পক্ষ সমন্বিতভাবে কাজ করতে পেরেছে বলেই জনজীবন রক্ষা সম্ভব হয়েছে। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে যারা নিয়োজিত হয়েছিলেন তাদের জীবনও ছিল ঝুঁকির মধ্যে। এ অভিজ্ঞতা যেহেতু আগে ছিল না, সেহেতু ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় করা হবে। দুর্ঘটনার পর ডিএপি কারখানার পূর্ব ও উত্তর পাড়ে দুটি পুকুর ও কারখানা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষায় ভয়াবহ মাত্রার দূষণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। দুই পুকুরে পিএইচ পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৯৪ ও ৮ দশমিক ৫৪। অথচ এর আদর্শ মাত্রা ৬ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫। পানিতে সিওডি (কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৩২৪ ও ২৬৪। এর আদর্শমান ২শ’। প্রসঙ্গত, ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের ভূপালে একটি কীটনাশক কারখানায় ৪০ টনের মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাসের ট্যাঙ্কার থেকে ঘটেছিল এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় শিল্প বিপর্যয়। বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ। এখনও সেই বিরূপ প্রভাব বয়ে বেড়াচ্ছে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো।
×