ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে পাঁচ জেএমবি জঙ্গী

গুলশান ও শোলাকিয়ার মতোই বড় হামলার পরিকল্পনা ছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৬ আগস্ট ২০১৬

গুলশান ও শোলাকিয়ার মতোই বড় হামলার পরিকল্পনা ছিল

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি কিংবা শোলাকিয়ার মতোই বড় ধরনের জঙ্গী হামলার ছক কষেছিল র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত জেএমবির সুইসাইড স্কোয়াডের পাঁচ সদস্য। গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে বড় ধরনের জঙ্গী হামলার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আলোড়ন তোলার পরিকল্পনা-কালেই গ্রেফতার হয় জেএমবির পাঁচ সদস্য রাশেদুজ্জামান রোজ, আব্দুল হাই, সাহাবুদ্দিন, ফিরোজ ও সাইফুল ইসলাম। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের কথা জানিয়েছে জেএমবির এই পাঁচ আত্মঘাতী জঙ্গী। জেএমবির এই পাঁচ জঙ্গী কিভাবে জঙ্গীবাদের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করেছে তার নেপথ্য কাহিনী পাওয়া গেছে তাদের দেয়া জবানবন্দীতে। র‌্যাব সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদুজ্জামান ওরফে রোজ ও গ্রেফতারকৃত তার সহযোগী জেএমবির অপর জঙ্গীরা র‌্যাবকে বলেছে, জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আমির মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতারের পর তার দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয় মহিলা শাখার পাঁচ নারী জঙ্গীকে। এই পাঁচ নারী জঙ্গীর নেত্রী আকলিমার দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয় জেএমবির সুইসাইড স্কোয়াডের পাঁচ সদস্যকে। মহিলা শাখার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে জেএমবি মহিলা শাখার নেত্রী আকলিমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে রোজের। নারী জঙ্গী নেত্রী আকলিমার দেয়া তথ্যানুযায়ী টঙ্গীর বোর্ডবাজার রাজপুকুর এলাকা থেকে জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে নারী জঙ্গীদের প্রশিক্ষক রাশেদুজ্জামান রোজও। রাশেদুজ্জামান ওরফে রোজ হচ্ছে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন করা একজন উচ্চ শিক্ষিত তরুণ। কানাডায় থাকাকালে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। কানাডায় অবস্থানের সময়েই সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েক বন্ধুর মধ্যে আহমেদ কাতিব, মোহাম্মদ কাতিবের ও ওমর কাতিবের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয় সে। সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধুদের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে ফেরত এসে রোজ জেএমবিতে যোগ দেয়। জিজ্ঞাসাবাদে রোজ জানায়, সে দেশে ফিরে আসার পর জেএমবির জঙ্গী আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। আব্দুল হাইয়ের মাধ্যমে জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। মাহমুদুল হাসানের মাধ্যমেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবিতে যোগ দেয় রোজ। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও এই তরুণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে পরিচালনা করত সাংগঠনিক কার্যক্রম। একই সঙ্গে জেএমবির নারী সদস্যদের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করত রাশেদুজ্জামান রোজ। র‌্যাবের হাতে সম্প্রতি মাহমুদুল হাসান গ্রেফতার হয়। তারপর জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমিরের দায়িত্ব পায় রোজ। বুধবার ভোরে রাজধানীর উপকণ্ঠ টঙ্গীর ছয়দানা হাজিরপুকুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাশেদুজ্জামান রোজসহ জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জেএমবির পাঁচ জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে ২টি বিদেশী পিস্তল, ৮ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৩টি ম্যাগাজিন, ২টি চাপাতি, ১৪টি বিদেশী ছুরি, ৩টি ককটেল, ৫টি ডেটোনেটর, ৫০ গ্রাম পটাশিয়াম, ১৫টি চকোলেট বোমা, ২৫টি ইলেক্ট্রোনিক ক্র্যাকার্স, ১টি ল্যাপটপ, বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। রোজের সঙ্গে মোহাম্মদ আব্দুল হাই (৩৬), সাহাবুদ্দিন ওরফে শিহাব ওরফে রকি (২৩), ফিরোজ আহম্মেদ শেখ ওরফে ফিরোজ ওরফে আনসার (২৭) ও সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা সবাই নাশকতার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছিল। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে বড় কোন নাশকতা করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদুজ্জামান রোজ জানিয়েছে, মাহমুদুল হাসান গ্রেফতার হওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হয় সে। ২০০১ সালে সে ঝিনাইদহ থেকে এসএসসি ও ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করে। এরপর এমবিবিএস পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় নির্বাচিত হলেও এমবিবিএস না পড়ে ২০০৬ সালে কানাডায় গিয়ে সেন্ট মারিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত কানাডায় অবস্থান করে সে। কানাডায় অবস্থানের সময়েই সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। এই বন্ধুদের কয়েকজন হলোÑ আহমেদ কাতিব, মোহাম্মদ কাতিব ও ওমর কাতিব অন্যতম। রোজ জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে ২০১২ সালে দেশে ফিরে আসে। এরপর পরিবারকে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে বলে, সে নিজ গ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে এবং ২০১৪ সালে এলাকায় জ্বালানি তেলের ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে। রাশেদুজ্জামান রোজের ঢাকার বাসা দক্ষিণ পীরের বাগের মুক্তি হাউজিং-এ। ১৫১/১ নম্বর বাড়ির ৪/সি নম্বর ফ্ল্যাটে বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে থাকত সে। তার বাবা খয়বর হোসেন জনতা ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আর মা রাজিয়া ইয়াসমিন মহাখালীতে ক্যান্সার হাসপাতালে কর্মরত। রাশেদুজ্জামান রোজ বিবাহিত, তার স্ত্রী মুক্তা খাতুন (মাহমুদা) বর্তমানে পড়াশুনা করছে। তাদের আট মাস বয়সী একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ছেলের নাম আব্দুর রহমান (শামা)। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঝিনাইদহে থাকতে রাশেদুজ্জামানের সঙ্গে আব্দুল হাইয়ের পরিচয় হয় তার। পরে আব্দুল হাইয়ের মাধ্যমে তার পরিচয় হয় জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে। মূলত শিক্ষিত ও সমমনা হওয়ায় মাহমুদুল হাসান তাকে জেএমবিতে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে সে মাহমুদুল হাসানের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করত। মাহামুদুল হাসান তাকে জেএমবির মহিলা শাখা পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়। এই মহিলা শাখার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে জেএমবি মহিলা শাখার নেত্রী আকলিমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে রোজের। র‌্যাব সূত্র জানান, গত ২১ জুলাই মাহামুদুল হাসানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপরই রাশেদুজ্জামান রোজ দক্ষিণাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। রাশেদের ল্যাপটপে জঙ্গী সংশ্লিষ্ট কিছু নৃশংস ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। প্রশিক্ষণের সময় সদস্যদের সে এসব ছবি ও ভিডিও দেখাত বলে স্বীকার করেছে রোজ। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গী আবদুল হাই জানায়, সে ঝিনাইদহের একটি মসজিদের ইমাম। ইমাম ছাড়াও সে নানাবিধ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। বিভিন্ন সময়ে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, হোমিও চিকিৎসক ও মোবাইল টাওয়ারে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করত। এছাড়া সে আহলে হাদিস আন্দোলনের ঝিনাইদহ শাখার সেক্রেটারি বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় আব্দুল হাই। জিজ্ঞাসাবাদে সে আরও জানায়, প্রথমে নলডাঙ্গা ভূষণ হাইস্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যায়ন করে। পরবর্তীতে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। ১৯৯৯ সালে আলিম এবং ২০০১ সালে দাখিল পাস করে। এরপর ২০০৭ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আল-হাদিস এ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে। সে কালিগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসায় দুবছর শিক্ষকতা করে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে শিশুদের জন্য সহজ কোরান শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়। ২০১৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাকে চাকরিচ্যুত করে। জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল হাই র‌্যাবকে জানায়, সে যশোর ও ঝিনাইদহ এলাকায় বিভিন্ন সময় জেএমবির বৈঠক আয়োজন করত। উক্ত বৈঠকে দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদ ও জেএমবির অন্যান্য নেতা উপস্থিত থাকত। এ ধরনের কোন এক বৈঠকে সে রাশেদুজ্জামানকে মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আব্দুল হাই মাহমুদের নির্দেশনা মতো দক্ষিণাঞ্চল থেকে সদস্য রিক্রুট করে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের জন্য ফিরোজের কাছে পাঠাত। আর ইয়ানত সংগ্রহ করে সাইফুল ইলেক্ট্রোনিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেমের মাধ্যমে ফিরোজের নিকট পৌঁছাত। জিজ্ঞাসাবাদে সাহাবুদ্দিন ওরফে শিহাব ওরফে রকি বলেছে, গ্রেফতারকৃত সাহাবুদ্দিন ওরফে শিহাব ওরফে রকি হচ্ছে শোলাকিয়া হামলায় অংশগ্রহণকারী শফিউলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য। শফিউল গ্রেফতার হওয়ার আগে তারা এক সঙ্গে একাধিকবার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। সে দু-একটি মিশনে অংশও নিয়েছিল। রকি দিনাজপুরের নারায়ণপুর প্রাইমারি স্কুলে পড়ার পর স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ৪ বছরের মতো লেখাপড়া করে। পরবর্তীতে মিরপুরের একটি গার্মেন্টসে ২৫-২৬ দিন চাকরি করে। তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বছর তিনেক আগে সে শফিউলের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দেয়। জিজ্ঞাসাবাদে ফিরোজ আহম্মেদ শেখ ওরফে আনসার জানিয়েছে, সে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে সে ঢাকায় আসে। ২০১০ সালের মাঝামাঝি বাড়িতে বেড়াতে গেলে সিরাজগঞ্জের মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাহমুদুলের মাধ্যমে সে জেএমবিতে যোগ দেয়। সে বর্তমানে লাইব্রেরি ব্যবসার আড়ালে জেএমবির সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। আরেক জঙ্গী সাইফুল র‌্যাবকে জানায়, সে নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানাধীন আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় কৈলাদিতে পড়াশুনা করত। ২০০৩ সালের দিকে সিলেটের বিশ্বনাথপুর থানাধীন একটি মাদ্রাসায় হাফেজিয়া পড়াশুনা করতে যায় এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ে। পরবর্তীতে ২০১০ সালের দিকে ঢাকায় তানজিম সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করার সময়ে আলাউদ্দিন সরকার মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সাইফুল হাজিরপুকুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে যোগদান করে। হাজিরপুকুর মসজিদের নিচে বই বিক্রেতা ফিরোজের সঙ্গে এ সময় তার সখ্য হয় এবং ফিরোজ তাকে জেএমবিতে সম্পৃক্ত করে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জেএমবির পাঁচ সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের জঙ্গী হামলা ও নাশকতার হাত থেকে বাঁচা গেছে। তারা কিভাবে জেএমবিতে যোগ দিয়েছে তার নেপথ্য কাহিনী বর্ণনা করেছে তাদের দেয়া জবানবন্দীতে। তারা জবানবন্দীতে জেএমবিতে থাকা তাদের সহযোগী আরও যেসব সদস্যদের নাম পরিচয় বলেছে তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
×