ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তথ্য বলে ২১ আগস্টের অপারেশনের মাস্টারমাইন্ড তারেক ও সা কা চৌধুরী -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৬ আগস্ট ২০১৬

তথ্য বলে ২১ আগস্টের অপারেশনের মাস্টারমাইন্ড তারেক ও সা কা চৌধুরী -স্বদেশ রায়

একুশে আগস্ট যখন গ্রেনেড হামলা শুরু হয় সে সময়ে নিউ মার্কেটে জিনাত বুক সাপ্লাই-এ বই কিনছিলাম। বই খুঁজছি এ অবস্থায় সেলফোনটি বেজে ওঠে। ওপার থেকে ছাত্রলীগের একটি ছেলে কান্না না ভয় না কী মিশ্রিত গলা (তা প্রকাশের ভাষা আমার নেই) অনেকটা জোরে বলে ওঠে, দাদা, যতগুলো পারেন এ্যাম্বুলেন্স পাঠান, নেত্রীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। আমি চিৎকার করে বলি, আপা কোথায়? সে বলে সব নেতারা আপাকে ঢেকে রেখেছেন। সঙ্গে ছেলে এবং চিত্রা ছিল, ওদের শুধু বলি, আপার ওপর হামলা হয়েছে, আমি ওখানে যাচ্ছি। ওরা কী যেন বলতে যাচ্ছিল তাও আর শুনিনি সম্ভবত। স্কুটার নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দেই। সচিবালয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দেখি একটি আর্মির গাড়ি চলে যাচ্ছে। এই আর্মির গাড়ি দেখে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে ওপাশে দাঁড়ানো কয়েক জনের কাছে জিজ্ঞেস করি, এই আর্মির গাড়িটা কতক্ষণ এখানে ছিল? তারা বলে বেশ অনেক সময়। ওই দিন রাস্তায় আর্মি নামার কোন কথা ছিল না। তেমন কিছু ঘটেনি। এক গাড়ি আর্মি ওখানে কেন ছিল? সাংবাদিক হিসেবে আজও আমার মনে প্রশ্ন। ২১ আগস্ট হত্যা মামলার বিচার হচ্ছে, সেখানে এই আর্মির গাড়ি কেন ছিল তা কোন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে কিনা জানি না। এখনও অন্তত কোন সংবাদপত্রের পাতায় দেখিনি। স্কুটার নিয়ে একটু এগুতেই প্রচ- টিয়ারশেলের শব্দ। ধোঁয়ায় গোটা এলাকা অন্ধকার। ১৯৭৭ থেকে টিয়ারশেলের সঙ্গে পরিচয়। তাছাড়া রাস্তায় টিয়ারশেল ও গুলির ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃতের পকেটের নোট বুক নেয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। তাই বয়স ও শরীর বাড়লেও টিয়ারশেলে কাবু করতে পারেনি। যা হোক, এগিয়ে গিয়ে দেখি, আওয়ামী লীগের যারা মিছিল করছে তাদের ওপর টিয়ারশেল ছোড়া হচ্ছে। মিছিলকারীদের কাছে জানতে পারি, শেখ হাসিনার গাড়ি চলে গেছে। যাক শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন। তাই অনেকটা টেনশন মুক্ত হয়ে রিপোর্টিং-এ মন দেই। টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া দেখেই বুঝতে পারি, সরকার ওপাশ দিয়ে হামলাকারীদের পালানোর ব্যবস্থা করছে। খুব তাড়াতাড়ি হিসাব করি, কোন্ কোন্ পথে পালানোর ব্যবস্থা করবে- এক. গোলাপ শাহ মাজারের ওখান থেকে, দুই. গুলিস্তানের কামান ছিল যেখানে ওখান থেকে। দ্রুত পিছিয়ে এসে ওসমানী উদ্যানের রেলিং বেয়ে ভেতরে ঢুকি, সোজা অনেকটা দৌড়ে যাই ওসমানী উদ্যানের ভেতর দিয়ে। ওপাশের গেট পার হয়ে দ্রুত চলে আসি গোলাপ শাহ মাজারের ওখানে। দীর্ঘদিন গোলাপ শাহ মাজারের ওখানে সাত দলের মিটিং এবং আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আওয়ামী লীগের মিটিং কভার করার কারণে এসব এলাকার অতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক ভাব। এমনকি কয়েকজন একটু ভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গেও। যা হোক, ওখানে এসে তাদের কয়েক জনের কাছে জানতে পারি, যখন আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গ্রেনেড মারা হয়, তার কিছু আগে থেকে এখানে কিছু হলুদ ট্যাক্সিক্যাব দাঁড়ানো ছিল এবং গ্রেনেড হামলার কয়েক মিনিট পরেই এখানে কিছু লোক আসে এবং তারা দ্রুত ওই হলুদ ট্যাক্সিক্যাবগুলোতে উঠে চলে যায়। কোন্ দিকে গেছে জানতে চাইলেই তারা বলে ওরা মেয়র ভবন পার হয়ে ওই সোজা রাস্তার মাথা পর্যন্ত গিয়ে কোন্ দিকে গেছে তা আর তারা জানে না। ওদের কাছ থেকে ওই হলুদ ট্যাক্সিক্যাবের তথ্য পাওয়ার পরে গুলিস্তানের কামানের ওখানে যাই। ওখানেও অনেক পরিচিত সাধারণ মানুষ ছিলেন তখন। তাদের কাছে গিয়ে জানতে পারি, এই পথে ট্রাকে করে অনেক লাশ নিয়ে গেছে। তাদের সংখ্যা অনেক হবে। যে কারণে, আমি কিন্তু কখনও লিখি না একুশে আগস্টে ২২ জন মারা গিয়েছিল। কারণ ওই সব সাধারণ লোকের চোখের ধারণা ও এই সরকারী হিসেবের মৃতের তথ্য মিলালে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশের ওপর যাবে। অনেকে বলতে পারেন, যারা মারা গেছেন, তারা তো আওয়ামী লীগের কর্মী। তারা তো হিসাব পাবেই। আওয়ামী লীগের মিটিংয়ের চার পাশে ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকতা করেছি এক যুগেরও বেশি। অভিজ্ঞতা বলে, আওয়ামী লীগের এমন অনেক সমর্থক মিটিং শুনতে দাঁড়িয়ে যায় বা শেখ হাসিনাকে দেখতে দাঁড়িয়ে যায় যা আওয়ামী লীগ কোন দিন হিসেবে রাখতে পারবে না। হয়ত কুষ্টিয়া থেকে এক লোক ঢাকায় এসেছে মামলার কাজে। রমনা ভবন এলাকায় কোন কিছু কেনার জন্য বিকেলে গিয়েছেন, শেখ হাসিনার মিটিং দেখে তিনি দাঁড়িয়ে যান। ওই মানুষটি নিখোঁজ হয়ে গেলে তার খবর কে রাখবে? তার পরিবারও তো জানে না ওই দিন তিনি মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। যা হোক, এক পাশ থেকে হলুদ ট্যাক্সিক্যাবে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পেলাম আরেক পাশে গিয়ে বাড়তি লাশের খবর পেলাম। এরশাদ আমলে সাধারণত জুরাইন কবরস্থানে এ ধরনের লাশের কবর হতো। জুরাইনের একটা ছেলেকে ফোন করে রাতে সেদিকে নজর রাখতে বলি, তেমন কিছু দেখলে জানাতে বলি। কিন্তু জুরাইনে তাদের কবর দেয়া হয়নি। আসলে খালেদা, এরশাদ এরা বর্বর অনেক। এরশাদও চট্টগ্রামের গণহত্যার লাশ পুড়িয়ে ফেলেছিল। খালেদাও এর থেকেও যে কোন বর্বর ভাবে ওই লাশ গুম করতে পারে এবং তার চরিত্রের সঙ্গে সেটা মিলেও যায়। জিয়াউর রহমান ও খালেদার ভেতর কে বেশি নিষ্ঠুর তা কিন্তু নির্ণয় করা কঠিন। যা হোক, ঘটনার পরদিন থেকে খোঁজ নেয়ার জন্য নেমে পড়ি হলুদ ট্যাক্সিক্যাব সম্পর্কে। দুই তিন দিনের ভেতর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারি, হলুদ ট্যাক্সিক্যাবে ধানমন্ডিতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত একটি বাড়িতে যায় ওই ব্যক্তিরা। তিনি বাড়িটি নির্দিষ্ট করে বলতে চান না। বুঝলাম, তার পক্ষে আর বেশি বলা সম্ভব নয়। তখন ওই সময়ে অনেক সাবধানে এই হলুদ ট্যাক্সিক্যাবের নিউজ তোয়াব ভাইকে বলে জনকণ্ঠে, ‘জনকণ্ঠ রিপোর্ট’ হিসেবে প্রকাশ করি। আজ বারো বছর পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ২১ আগস্টের ষড়যন্ত্র করার জন্য তারেক দীর্ঘদিন ধানম-িতে তার শ্বশুরবাড়ি ছিল। এখন নিশ্চয়ই আরও তদন্ত করলে জানা যাবে, হলুদ ট্যাক্সিক্যাবগুলো সেদিন কোন্ বাড়িতে গিয়েছিল? নাকি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ধানম-ির বাসায় গিয়েছিল। সবই এখন তদন্ত করে বের করা সম্ভব। হলুদ ট্যাক্সিক্যাবে যারা ওইদিন ধানম-ি গিয়েছিল তাদের সবাই যে সেখান থেকে এক পথে পালিয়েছিল তার কোন পূর্ণাঙ্গ তথ্য ওই সময়ে পায়নি। তবে কিছু তথ্য ওই সময়ে পেয়েছিলাম। যা নানাভাবে তখন ছেপেছি। ওই দিন ঢাকা- চট্টগ্রামের বিমানের কয়েকটি টিকেট মন্ত্রী ফোন করে বাতিল করে অন্যের জন্য রিজার্ভ করে। ওই কয়টি সিটে ধানম-িতে যারা হলুদ ট্যাক্সিক্যাবে গিয়েছিল তাদের কয়েকজন চট্টগ্রাম যায়। তখন চট্টগ্রাম-পুকেট এয়ারলাইন্স ছিল। ওই এয়ারলাইন্সে তারা থাইল্যান্ডে যায়। এ তথ্য ওই সময়ে পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী বারো বছর পরে এসে যখন ২১ আগস্ট ঘিরে তারেকের ধানম-ি ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন, তখন নিশ্চয়ই কারা সেদিন ওই বিমানে গিয়েছিল তাদের ভেতর একজন বেশি লম্বা ছিল। তারা পুকেটের পরে কোথায় যায় এগুলো হয়ত সরকার এতদিন তদন্ত করে বের করে ফেলেছেন। কিন্তু তাদের কাউকে কী গ্রেফতার করা হয়েছে? এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে এবং আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকরা সেদিন যে তথ্য খুঁজে পেয়েছিলাম তাতে কি এটা প্রমাণিত নয় যে, ২১ আগস্টের অপারেশনের মাস্টারমাইন্ড ছিল তারেক ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। [email protected]
×