ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ কাজী নজরুল ইসলামের কোথা সে আরিফ?

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৬ আগস্ট ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ কাজী নজরুল ইসলামের কোথা সে আরিফ?

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ইন্তেকাল করেন ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট। আমরা জানি কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বপুরুষগণ মুঘল বাদশাহী আমলে কাজী বা বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর এক পূর্বপুরুষ মুঘল বাদশাহ্্ শাহ আলমের আমলে বর্ধমানের চুরুলিয়ায় আসেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আমরা এও জানি, নজরুল ইসলাম পারিবারিকভাবে সুফী খান্দানভুক্ত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই শৈশব থেকেই তিনি সুফী পথপরিক্রমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আমরা এটাও জানি যে, নজরুল ইসলাম সেই ছোটবেলায় গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করেছেন, কুরআন, দীনীয়াত ইত্যাদির পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করেছেন, বাল্যকালেই তিনি পীরের মাজারের খাদেম হয়েছেন, মসজিদে ইমামতি করেছেন, আবার মক্তবে মৌলবিগিরি করেছেন অর্থাৎ মক্তবের ছাত্রছাত্রীদের কুরআন ও দীনীয়াতের পাঠদান করেছেন। পিতার মৃত্যু এবং দারিদ্র্য একদিন তাঁকে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলেও তিনি কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে পড়েও আপন সত্তা কোন অবস্থাতেই বিস্মৃত হননি। জীবনের পরতে পরতে তিনি সংগ্রামী হয়ে উঠেছেন, ঐতিহ্যচেতনা ও স্বকীয়তার অবস্থান সর্বাবস্থায় সুসংহত করেছেন, সত্য-পক্ষ গ্রহণ করেছেন, তিনি অসত্য, অসুন্দর, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনা-গঞ্জনা ও নির্যাতনের বিরদ্ধে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে সোচ্চার হয়েছেন, আন্দোলনের ঝড় তুলবার চেষ্টা করেছেন জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন বাংলার পিছিয়ে-পড়া আদম সন্তানকে। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে শরিক হয়েছেন, সৈনিকের উর্দি পরে হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সৈনিক জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর দেহ-মনে সচেতনতার এক নতুন সূত্র সংযোজন করেছে, তিনি বিপ্লবী ও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন, তাঁর ভেতর সত্য-সুন্দরের তীব্র স্পন্দন নবতর বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে যা বাল্যকালেই তাঁর মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। পুরুষ পরম্পরায় তিনি যে জিহাদী মননে অভিষিক্ত ছিলেন, নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করা তথা জিহাদে আকবার বা বড় যুদ্ধের যে চেতনা তাঁর মধ্যে অনুরণিত ছিল সশস্ত্র যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাকে আরও বলীয়ান করে তোলে। তিনি মর্দে মুজাহিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আল্লাহ্্ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত না করার প্রেরণা তাঁর মধ্যে শক্ত বুনিয়াদ লাভ করে। তাই তো তিনি নিজেকে জনসমক্ষে হাজির করেন বিদ্রোহীরূপে যা কেবল সম্ভব একজন তওহীদবাদী অর্থাৎ একত্ববাদীর পক্ষেই। যে কবিতাটি তাঁকে রাতারাতি সর্বমহলে বিখ্যাত করে দেয় সেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তার পক্ষেই লেখা কেবল সম্ভব ছিল, কেননা তিনি সুফী মনন প্রভাবিত প্রতিভাদীপ্ত ছিলেন, তিনি স্বভাবতই নির্ভীক চিত্তের অধিকারী ছিলেন। ‘বল বীর/বল উন্নত মম শির/শির নেহারি আমারি নত শির/ঐ শিখর হিমাদ্রির...’ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এই ক’টি পঙ্ক্তিতেই কবি নজরুল ইসলামের খাঁটি ও আসল রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। আমরা তাঁর নির্বাক হয়ে যাবার পূর্বেকার কয়েকটি রেকর্ড-গাত্রের ‘পীর কবি’ নজরুল ইসলাম লেখা দেখে তো অবাক হয়ে যাই। আসলে তিনি কি ছিলেন? নজরুল ইসলামের কাব্যে যে ‘আরিফ’-এর উল্লেখ রয়েছে সেই আরিফ-চেতনার মূল আবেদন স্পন্দিত হয়েছে বিদ্রোহী কবির- বল বীর/বল উন্নত মম শির-এই বাণীর বলিষ্ঠ দ্যোতনার মধ্যে। কাজী নজরুল ইসলামের ভেতর সুফী মননের যে প্রেরণা সঞ্চারিত ছিল, রক্তীয় ধারায় তাঁর সত্য-সুন্দরের ধ্যান-অনুধ্যানের যে চেতনা বিদ্যমান ছিল তার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় তাঁর বহু রচনাকর্মে, ছন্দ নির্মাণে এবং কাব্যিক অনুভবে বাহ্যিক প্রকাশ ও উপস্থাপনায়। গওসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী (রহ) তাসাওউফের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক স্থানে বলেছেন যে তাসাওউফ লিখতে আরবি ‘তা’, সোয়াদ, ওয়াও, ফা-এই চারটি হরফ লাগে। এই চারটি হরফের প্রত্যেকটি হরফ একটি তাৎপর্যপূর্ণ হরফের আদ্যক্ষর। ‘তা’ হচ্ছে তওবার আদ্যক্ষর। তওবা হচ্ছে সমস্ত গোনাহ্্ খাতার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করার নাম। এই তওবা করতে হবে, মুখে, মনেপ্রাণে এবং আমলে-আখলাকে। তাসাওউফ লিখতে দ্বিতীয় যে হরফটি লাগে তা হচ্ছে সোয়াদ। এই সোয়াদ হচ্ছে সাফা শব্দের আদ্যক্ষর। সাফা শব্দের অর্থ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ভেতরে-বাইরে পরিষ্কার হতে হবে। আর সেটা সম্ভব আল্লাহর যিকর-ফিকর, মুরাকাবা-মুশাহাদা তরিকত অনুযায়ী করার মাধ্যমে। তাসাওউফ লিখতে তৃতীয় হরফ লাগে ওয়াও। এই ওয়াও হচ্ছে ওয়ালাত বা বিলায়াত। বিলায়াত হচ্ছে ওলীত্ব। এই বিলায়াত যখন কেউ প্রাপ্ত হন তখন আল্লাহর তত্ত্বজ্ঞানের তিনি অধিকারত্ব লাভ করেন, তিনি ফানিফিল্লাহ মকামে উন্নীত হন, ফলে কেউ কেউ এই পর্যায় উন্নীত হয়ে নিজের অস্তিত্ব অনুভব হারিয়ে ফেলে আত্মবিস্মৃত হয়ে যান। এই পর্যায়ে এসে আল্লাহর কুরবত বা নৈকট্য লাভ করে তিনি ধন্য হয়ে যান। তাঁর আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জানাজানি, চেনা-পরিচয় হয়ে যায়, তিনি আরিফ বিল্লাহ হয়ে যান। লা মাওজুদা ইল্লাল্লাহ্্- আল্লাহ্্ ছাড়া কোন অস্তিত্ব নেই- চেতনার এই দৃঢ়তা যার মধ্যে প্রবল হয়ে যায় তখন তাঁর জীবনমৃত্যু জ্ঞানও বিলুপ্ত হয়ে যায় কিংবা জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে তিনি কোন পার্থক্য দেখেন না, পৃথিবীর এপারের জীবন অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন এবং ওপারের জীবন অর্থাৎ আখিরাতের জীবনের মধ্যখানে সেতুবন্ধন হচ্ছে মৃত্যু। কুরআন মাজীদে ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জীবনেরই বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, যেমন ইরশাদ হয়েছে : ‘এই দুনিয়ার জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়, আখিরাতের জীবনই তো প্রকৃত জীবন’ (সূরা আনকাবুত: আয়াত ৬৪), ‘এই দুনিয়ার জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস’ (সূরা মু’মিন: আয়াত ৩৯)। আরিফ বিল্লাহ স্তরে উন্নীত যিনি হন তিনিই এই সত্যগুলো যে অকাট্য সত্য সেই চেতনা ধারণ করে তার আলোকধারায় উদ্ভাসিত হন। কাজী নজরুল ইসলাম সেই আরিফের ডাক দিয়েছেন এইভাবে: আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান/কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু জ্ঞান। যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম/ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম/যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জিন পরী ইনসান/স্ত্রী পুত্রেরে আল্লারে সঁপি জিহাদে যে নির্ভীক/হেসে কোরবানি দিত প্রাণ, হায়! আজ তারা মাগে ভিখ/কোথা সে শিক্ষা- আল্লাহ ছাড়া/ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা/আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কোরআন। কাজী নজরুল ইসলামের এই অসাধারণ কাব্য সৃষ্টিতে আরিফের বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেকগুলো গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আরিফ যে মহামনা ও নির্ভীকচিত্ত মানুষ, আরিফ যে সত্য-সুন্দর সমুন্নত রাখতে জিহাদী চেতনা ধারণ করেন এবং প্রয়োজনে জিহাদে অবতীর্ণ হন এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমরা সুফীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই সুলতানুল আরিফীন বহু আল্লাহর ওলীর লকবের সম্পৃক্ত হয়েছে তার আরিফ গুণের মানুষ গড়ার কারণে। সুলতানুল আরিফীনের অর্থ আরিফগণের সুলতান। হযরত হাসান বসরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত গরীবে নওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ সুলতানুল আরিফীন ছিলেন। জিহাদ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, সত্য হাসিলের জন্য, সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য, আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করার জন্য, আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য, শয়তানের প্ররোচনা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, চেষ্টা-পরিশ্রম করার মধ্যে, সংগ্রাম করার মধ্যে, জিহাদের মূল চেতনা বিদ্যমান রয়েছে। কুরআন মজীদে জিহাদের উল্লেখ যেমন রয়েছে তেমনি আর একটি শব্দেরও উল্লেখ রয়েছে আর তা হচ্ছে কিতাল। কিতাল শব্দের অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধ। একবার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এক সশস্ত্র যুদ্ধাভিযান থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদে (জিহাদুল আকবার) ফিরে এসেছি। জিহাদুল আকবার অর্থাৎ বড় জিহাদ বলতে তিনি নফ্্সা বা প্রবৃত্তির সঙ্গে যুদ্ধ বুঝিয়েছেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া জাহিদুহুম বিহি জিহাদান কাবীর-এর সাহায্যে ওদের সঙ্গে বড় যুদ্ধ চালিয়ে যাও। (সূরা ফুরকান : আয়াত ৫২) এখানে এর সাহায্য বলতে কুরআন মজীদের সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। আমরা কাজী নজরুল ইসলামের, তাঁর কর্মে, এই বাণীর অনুরণন দেখতে পাই। তিনি বলেছেন : আমার কিসে শঙ্কা/কোরআন আমার ডঙ্কা/ইসলাম আমার ধর্ম/মুসলিম আমার পরিচয়। আরিফ একজন মুসলিমের সর্বোচ্চ মর্যাদার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করার মাধ্যমে অর্থাৎ প্রবৃত্তিকে দমন করার মাধ্যমে প্রকৃত মনুষ্যত্বের গুণাবলী অর্জন করার মাধ্যমে যখন কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত নেক বান্দায় পরিণত হয়ে যায় তখন আল্লাহতে আত্মসমর্পিত সেই মানুষ পূর্ণ মুক্ত মুসলিম হিসেবে গণ্য হয়, কাজী নজরুল ইসলাম এই গুণান্বিত মুসলিমের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আরিফের পরিচয় তুলে ধরেছেন এইভাবে- কোথা সে আজাদ/কোথা সে পূর্ণ মুসলমান/আল্লাহ ছাড়া করে না কারেও ভয়, কোথা সেই প্রাণ?/ কোথা সে আরিফ কোথা সেই ইমাম, কোথা সে শক্তিধর? মুক্ত যাহার বাণী শুনি কাঁপে ত্রিভুবন থর থর। আরিফ আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় করে না। কারণ তিনি ওলী আল্লাহ হয়ে যান। কুরআন মজীদে ওলী আল্লাহ্্গণ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : ‘জেনে রাখো, ওলী আল্লাহগণের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (সূরা ইউনুস : আয়াত ৬২)। কাজী নজরুল ইসলাম আরিফ পর্যায় উন্নীত হওয়ার পথপরিক্রমে অগ্রসরমান ছিলেন বলে মনে হয়। আর তার প্রমাণ মেলে তাঁর নির্বাক হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে প্রদত্ত একাধিক অভিভাষণে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে এক অভিভাষণে তিনি দীর্ঘ বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন, আপনাদের অনেকে বহুদিন থেকে এই দ্বীন ফকিরের কাছে আসা যাওয়া করেছেন- যাঁরা আসেন না তাঁরাও নাকি আশা করে বসে আছেন শিরনির আশায়। যে ফকিরের ঝুলি রইল আজও শূন্য, আল্লাহর রহমতের আশায় যে ভিক্ষুক আজও উর্ধের পানে হাত পেতে বসে আছে, তারই কাছে যখন আপনারা হাত পাতেন, তখন আমার আঁখি অশ্রুতে ভরে ওঠে। পরম কুরুণাময়ের পরম রহমত পাওয়ার শুভক্ষণ যখন এলো ঘনিয়ে- যে ভা-ার হতে তার অনন্ত শক্তি অসীম করুণা নিয়ত বিতড়িত হচ্ছে সেই অতি গোপন ভা-ারের দ্বারে পৌঁছে যদি আমি আপনাদের আহ্বানে পিছু ফিরে যাই, তাহলে বঞ্চিত শুধু আমিই হব না, হবেন আপনারা। ... পবিত্র কাবা ঘরের ছায়া যখন আকাশের নীল শিশায় ফুটে উঠেছে- তখন আমার আত্মীয় যারা তারাই যদি পিছু ডেকে ফিরাতে চায়, তাহলে আমার দুনিয়া ও আখেরাত দুই হবে বরবাদ। আমার এই ঘোর দুর্দিনের, দুর্যোগের মরুভূমি দিয়ে তীর্থযাত্রা হবে নিষ্ফল। ‘সলুক’ ও ‘তরিকতে’ই’ হবে আমার মৃত্যু। ... আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই- আল্লাহর রহমত আমি পেয়েছি- কিন্তু মুক্ত করার শক্তি তিনি দেননি। ... কাজী নজরুল ইসলাম যে ইলমে তাসাওউফের দিকে মনোযোগী হয়েছিলেন, তিনি যে আল্লাহর রিযামন্দী অর্থাৎ সন্তুষ্টি এবং কুরবত অর্থাৎ নৈকট্য লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন তার উপরিউক্ত অভিভাষণে। এতে লক্ষ্য করা যায় তিনি তাসাওউফে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ এনেছেন তার ওই অভিভাষণে, আর তা হচ্ছে ‘সলুক’ এবং তরিকত’। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ বনগাঁ সাহিত্য সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন ... আজ আমার সকল সাধনা, তপস্যা, কামনা, বাসনা, চাওয়া, পাওয়া, জীবন, মরণ তাঁর পায়ে অঞ্জলি দিয়ে আমি আমিত্বের বোঝা বওয়ার দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছি ...। এমতাবস্থায় কবি নজরুল ইসলাম দৈহিক অবয়ব নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচেছিলেন অনেকগুলো বছর, কিন্তু তখন কি তিনি একান্তভাবে রূহানী জগতে বিচরণ করছিলেন? তিনি তার একটি ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন এইভাবে.... মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। কবির ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশেই শুয়ে আছেন। আরিফ অনুভবে উজ্জীবিত কাজী নজরুল ইসলাম সত্য-সত্যই কি আরিফ বিল্লাহ হয়ে গিয়েছিলেন? আল্লাহর সঙ্গে কি তার একান্ত চেনা-জানা হয়ে গিয়েছিল? মান আরাফা নাফসাহ ফাকাদ আরাফা রব্বাহু- এই উক্তির মধ্যে রয়েছে আরিফ চেতনা। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×