ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শফী আহমেদ

ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৬ আগস্ট ২০১৬

ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে

ইংরেজীতে বহুল ব্যবহৃত একটি বাক্য আছে ‘লেট ইজ বেটার দ্যান নেভার’ যার বাংলা অর্থ এই দাঁড়ায় কখনও না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়া ভাল। মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা সম্পর্কে অপপ্রচারে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং অর্থদ-সহ বিভিন্ন বিধান রেখে গত সোমবার মন্ত্রিসভায় একটি আইন খসড়া আকারে উত্থাপিত এবং পাস হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী প্রস্তাবিত এই আইনটি সংসদীয় কমিটিতে যাবে, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাসহ পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত আইনটি বিল আকারে উত্থাপিত হবে। বিল পাস হলে গেজেট নোটিফিকেশন হবে। নোটিফিকেশনের পর আইনটি কার্যকর হবে। আমাদের রাজনৈতিক অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত ভাবনায় আনলে দুটি বিষয় কালের মাত্রাকে অতিক্রম করেছে। এর একটি হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্য ক্ষেত্রটি হচ্ছে আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট; যা এক অন্তহীন সমুদ্রের মতো। বাঙালীর অহঙ্কার করার মতো অনেক কিছুই আছে কিন্তু কাল অতিক্রম করার ক্ষেত্র হচ্ছে এই দুটি। এই দুটি ক্ষেত্রকে আইনগত সুরক্ষা দেয়ার জন্য সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে বহুবার দাবি উত্থাপিত হয়েছে কিন্তু দেরিতে হলেও সোমবার উত্থাপিত দাবিটি মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা সম্পর্কে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং নানাবিধ শাস্তির বিধান রেখে এই আইনটি মন্ত্রিসভায় পাস করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লাখো কোটি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব বিবেকবান মানুষের পক্ষ থেকে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। সাংবিধানিকভাবে পরিচালিত যে কোন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রণীত আইন বিতর্কের উর্ধে নয়। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামের নেতা ও সেই জাতির মুক্তির ইতিহাস বিতর্কের উর্ধে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিগত ৪৫ বছর যাবত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কোন কোন মহল অপপ্রচার ও কুৎসা রটনায় ব্যস্ত ছিল। আবার কোন কোন মহল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলেও সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে হেয়প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ইতোমধ্যেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই, বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি একাত্তরের ঘাতক দালালদের বংশপরম্পরা আমাদের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুকেও মেনে নেয়নি। ওই রাজাকারদের বংশপরম্পরা ইলেক্ট্র্রনিক মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে বিকৃত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বাক স্বাধীনতা একটি সাংবিধানিক অধিকার, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপপ্রচার করা সংবিধানস্বীকৃত বাক স্বাধীনতার অংশ হতে পারে না। তাই আমরা আশা করব, প্রস্তাবিত আইনটি অতি দ্রুত আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে বাস্তব প্রয়োগে যাবে। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও তথাকথিত সাংবিধানিক বাক স্বাধীনতার তকমাধারীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার মধ্যেই থেমে থাকেনি। তাদের এখন একটাই লক্ষ্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে উচ্ছেদ করা। ১৯৮১ সালে পিতৃ-মাতৃ-স্বজনহারা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ও বিএনপি-জামায়াতের অশুভ অক্ষশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে আজ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিগত বছরগুলোতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এই হত্যাচেষ্টার সঙ্গে কখনও ফ্রিডম পার্টি কখনও হরকত-উল-জিহাদ কখনও জেএমবি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ হামলাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। এই হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিল বিকল্প রাষ্ট্রীয় শক্তির অধিকারী হাওয়া ভবনখ্যাত তারেক রহমান ও তৎকালীন সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তা। এই হত্যা প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধারার বিকাশমান রাজনীতিকে চিরতরে উচ্ছেদ করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারবর্গের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সকলেরই পবিত্র দায়িত্ব। জাতির পিতার পরিবারকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি আইন বলবত আছে যা প্রতিবেশী ভারতেও অনুসরণ করা হয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু আইন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়েই সব ক্ষেত্রে এ ধরনের মহান ব্যক্তিবর্গের জীবনের সুরক্ষা দেয়া যায় না। বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি কেনেডি, মহাত্মাগান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে আপাতবিশ্বস্ত ছদ্মবেশধারী খুনীরা জড়িত ছিল। প্রত্যেকটি হত্যাকা-ের পূর্বে রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের প্লট তৈরি করা হয়েছিল। বিশ্বে রাজনৈতিক অবস্থা আজকে জঙ্গীবাদের ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত। অতিসম্প্রতি আমাদের দেশেও এ ধরনের জঙ্গীদের উত্থান দেখা যাচ্ছে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, খুনী মোশতাক চক্রের মতো মুখোশধারী মীরজাফররা আমাদের মধ্যে অবস্থান করছে। এও অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনে একাত্তরের পরাজিত শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই অনুপ্রবেশকারীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগসাজশের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানে যে কোন ধরনের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অতিগুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- প্রতিরোধে এক ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল। সেই সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ও অন্য বাহিনীর কর্মকর্তরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি। আমরা আর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয় কখনও কখনও আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় খানিকটা ভোগান্তি তৈরি করে, তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ ধরনের সাময়িক ভোগান্তি আমাদের দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নেয়া উচিত। একাত্তরের পরাজিত শক্তির সর্বক্ষণিক চক্রান্তের মধ্যে এখন যুক্ত হয়েছে জঙ্গীবাদী হুমকি। বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতির অবস্থান বিশ্ব-মোড়লদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন দেশ বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবস্থানগত সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আবার কোন কোন দেশ আমাদের সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে ভিন্ন দেশের ওপর সামরিক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে চায়। বিশ্ব-মোড়লদের কেউ কেউ বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতিতে ফেলে হামিদ কারজাইয়ের মতো পুতুল সরকার অধিষ্ঠিত করতে চায়। মেরুদ-হীন দেশপ্রেমবিবর্জিত সরকার চাপিয়ে দিয়ে আমাদের দেশ থেকে নানা রকম ফায়দা হাসিল করতে চায়, বিতর্ক এড়ানোর স্বার্থে ওই সমস্ত দেশের নাম উল্লেখ করলাম না। কিন্তু যতক্ষণ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবেন ততক্ষণ কোন পরাশক্তি আমাদের থেকে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুই অর্জন করতে পারবে না। অতএব, আমাদের সমস্ত আন্তরিকতা ও শক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিধান করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। এই তো সেদিন একুশ আগস্টের স্মরণসভায় বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেই বলেছেন, ‘বারবার আমার পিছনে মৃত্যু ছুটেছে কিন্তু আমি মরার আগে মরতে চাই না।’ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির কাছে আমাদের উদাত্ত আহ্বান ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘জাতির পিতা’ সম্পর্কে অপপ্রচারে প্রস্তাবিত আইনের যারা সমালোচনা করবেন তাদের যৌক্তিকভাবে মোকাবেলা করা উচিত ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াতে। বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাদের মোকাবেলা করাটাও জরুরী। আমরা এগিয়ে যেতে চাই নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের উন্মোচিত সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করে একবিংশ শতাব্দীর উন্নত-মানবিক-মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আমাদের যে কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ চেয়েছিলাম সেটা প্রতিষ্ঠা করা। এক মুহূর্তের জন্য আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সমার্থক শব্দ। আর এরই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে পুনরায় যেন অন্ধকার যুগে ফিরে যেতে না হয়। লেখক : নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা
×