ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একজন কিংবদন্তি ॥ মহম্মদ রফি

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২৫ আগস্ট ২০১৬

একজন কিংবদন্তি ॥ মহম্মদ রফি

ছাত্রজীবনে শিখেছিলাম ‘জলের নিজস্ব কোন আকার নেই। যে পাত্রে রাখা হয়, তার আকার ধারণ করে।’ সুপরিচিত কোন গায়ক সম্পর্কে কীএই কথাটি বলা চলে? নৃত্যরত ম্যাটিনি আইডল, ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী, ট্র্যাজিক নায়ক, রাস্তাপাসের কৌতুকশিল্পী বা ঈর্ষাকাতর তরুণ স্বামী- এসব চরিত্র কেই একা ফুটিয়ে তুলতে পারেন? পেরেছিলেন একজন। মহম্মদ রফি। প্রায় তিন দশক ধরে কেন তিনি প্রায় সমস্ত সুরকার, গীতিকার এবং নায়কদের প্রিয় কণ্ঠ? তার একটি কারণ রফির কণ্ঠ সর্বদাই পর্দায় নায়কের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে, কখনও তাকে ছাপিয়ে যায় না। তিনি অভিনেতার স্টাইল এবং ম্যানারিজম লক্ষ্য করতেন, তাকে বুঝতেন এবং অভিনেতার স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী নিজের কণ্ঠ মড্যুলেট করতেন। এসব গুণের জন্যই তিনি আজও জনপ্রিয় সবার মাঝে। তিনি হিন্দী ছাড়াও বাংলা, অহমিয়া, ভোজপুরি, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিন্ধি, গুজরাটি, তেলেগু, মৈথিলি, উর্দু, ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। ইংরেজী, ফার্সি, স্প্যানিস এবং ডাচ ভাষাতেও গান করেছেন। মহম্মদ রফির জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে। অমৃতসরের কাছে একটি ছোট গ্রাম কোটলা সুলতান সিং। সে গ্রামের বাসিন্দা হাজী আলি মহম্মদের সন্তান রফির ডাকনাম ছিল ফিকু। গ্রামের ফকিরদের গান শুনে ছোটবেলাতে সুরের মায়ায় মন ভরে যায় তার। ১৯৩৫ সালে রফির বাবা সপরিবারে লাহোরে চলে যান। রফির বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন আবদুল হামিদ নামে এক সহৃদয় তরুণ। তার অনুপ্রেরণাতেই গান শিখতে শুরু করেন রফি। অল ইন্ডিয়া রেডিও লাহোরে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। আবদুল হামিদ পরিবারের সবাইকে বোঝান যে রফির মুম্বাই যাওয়া উচিত। তিনি নিজেই রফিকে ১৯৪৪ সালে মুম্বই নিয়ে আসেন। সঙ্গীত পরিচালক শ্যাম সুন্দরের ‘গাও কি গৌরী’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ হয় রফির। গানটি ছিল ‘আজি দিল হো কাবু মে।’ ১৯৪৪ সালে মুক্তি পাই ছবিটি। এরপর ধীরে ধীরে আরও বেশ কটি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মুম্বাইতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বলিউডে রফি ছিলেন ব্যস্ততম প্লেব্যাক গায়ক। সে সময়ের নামকরা সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ, ওপি নায়ার, শংকর জয়কিষণ, শচীন দেববর্মণ, মদন মোহন, রওশান এদের সবার সুরেই গান করেছেন রফি। ১৯৫২ সালে মুক্তি পাওয়া বৈজু বাওরা ছবিতে ‘ও দুনিয়াকে রাখোয়ালে’ গানটিকে বলা হয় রফির প্রতিভার সেরা স্বাক্ষর। তবে বাংলাতেও বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে মহম্মদ রফির। ‘ওরে মনকে এমন দাগা দিয়ে’, ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’, ‘কথা ছিল দেখা হলে’, আলগা করগো খোপার বাঁধন’ আজও মানুষের মুখে মুখে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বলিউডে অংশগ্রহণকারী অন্য গায়কদের তুলনায় রফিকেই দেখা গিয়েছিল বেশি। তার নারী সহশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লতা মঙ্গেশকার ও আশা ভোঁসলে। তবে লতার সঙ্গে রফির জুটিকে বলিউড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জুটি ধরা হয়। তাঁরা ১৯৪৯ সালে বারসাত ছবি থেকে শুরু করে একনাগাড়ে রফির মৃত্যু পর্যন্ত ৫০০ এর অধিক দ্বৈত গানে অংশ নেন। আশা ভোঁসলের সঙ্গে রফির জুটিকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জুটি বলা হয়। তারা দুজনে মোট ৯১৮টি গানে দ্বৈত কণ্ঠ দিয়েছেন, যা বলিউড ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ১৯৭৭ সালের নবেম্বর মাসে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মহম্মদ রফি দাবি করেন যে, তিনি ওই সময় পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৬ হাজারের মতো গান গেয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৮ হাজার গান গেয়েছেন। তিনি ১৯৪৮ সালে জওহরলাল নেহরুর কাছ থেকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে রৌপ্যপদক গ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন এ ছাড়াও তিনি জীবনে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তার গায়ক জীবনের উর্ধমুখী লেখচিত্রের পেছনে ছিল তিনটি জিনিস- কঠোর পরিশ্রম, নিখাদ সততা এবং জনসংযোগের সততা। রফি সর্বদা তার সেরাটাই দিতেন। তিনি ছিলেন সব মহলেই অসম্ভব প্রিয়। ধার্মিক ছিলেন, বিতর্কে জড়াননি, চরিত্রদোষ ছিল না সন্তানদের ভালবাসতেন, কাউকে আঘাত দেননি, অর্থ রফিকে কলুষিত করেনি, আত্মপ্রচারে উৎসুক ছিলেন না। বস্তুত এই রকম বহুগুণসম্পন্ন এবং বিপুল প্রতিভাসম্পন্ন কোন ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ত্রুটিহীনতায় পৌঁছানো অসম্ভব, কিন্তু রফি তার খুবই কাছে যেতে পেরেছিলেন। ১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। তবে তার অসংখ্য গানের মাঝে তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল ।
×