ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না!

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৫ আগস্ট ২০১৬

আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না!

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পপসম্রাট গুরু“আজম খান যখন তাঁর চার বন্ধুকে নিয়ে বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন,সেই নতুন ধারার শুরুর দিকে এক গানপাগল যুবক হাতের গীটারে ঝড় তুললেন আর নিজের কণ্ঠের গান দিয়ে মাতিয়ে দিলেন সবাইকে। আশির দশকের তুমুল জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী একাধারে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকারও। বলছি কিংবদন্তি ব্যান্ড সঙ্গীতশিল্পী লাকী আখন্দের কথা ,যিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক। পপসম্রাট তার ভিন্ন ধাঁচের গান নিয়ে যেমন আলাদা সঙ্গীতশ্রোতা তৈরি করেছেন তেমনি, লাকী আখন্দ তার মেলোডি ধাঁচের গানের মাধ্যমে নিজের গণ্ডিকে করেছেন সমৃদ্ধ ও ব্যাপক। ১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে প্রকাশ পায় অসংখ্য শ্রোতানন্দিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় গানের সুরকার, সঙ্গীত পরিচলক শিল্পী লাকী আখন্দের। তাঁর প্রথম সলো অ্যালবাম ‘লাকী আখন্দ’। বাংলা সঙ্গীতের ক্ল্যাসিক সেই এ্যালবামের উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো- ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘হৃদয় আমার’, ‘সুমনা’, ‘তোমার স্বাক্ষর আঁকা’। অবশ্য পরবর্তীতে ‘আমায় ডেক না’ গানটি তিনি শিল্পী সামিনা চৌধুরীকে উপহার দেন।অন্যদিকে সামিনা চৌধুরীও তার একক এ্যালবামে লাকী আখন্দের সুরারোপে করা এই বিখ্যাত গানটি সঙ্কলন করেন। ১৯৮৭ সালে ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দের মৃত্যুর পরপর সঙ্গীতাঙ্গন থেকে অনেকটাই স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেন এই গুণী শিল্পী।তবে হ্যাপীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে হ্যাপী আখন্দের একমাত্র সলো এ্যালবামটি আবারও রিমেক করেন। মাঝখানে প্রায় এক দশক নীরব থেকে ১৯৯৮-এ পরিচয় কবে হবে ও বিতৃষ্ণা জীবনে আমার এ্যালবাম দুটি নিয়ে আবারও ফিরে আসেন সঙ্গীতাঙ্গনে। প্রাণের টানে ফিরে আসেন গানের মাঝে। সঙ্গীত ভক্ত শ্রোতাদের সৃষ্টির বেদনায় ভাসাতে আবারও দুটি হাত মেলে দিয়ে ধরেন সেই পুরনো কীবোর্ড, কথার পরতে পরতে সাজান সঙ্গীতের অপার্থিব স্বরলিপি। আর কথামালাগুলো সুরের ওম পেয়ে মেতে ওঠে সৃষ্টির উল্লাসে। গীতিকার গোলাম মোর্শেদের কথামালায় প্রায় এক দশক পরে সঙ্গীতাঙ্গনের ছয় উজ্জ্বল তারকা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ ও সামিনা চৌধুরীকে নিয়ে প্রকাশ করেন মিক্সড এ্যালবাম ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’। সেবারই তিনি প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ মিক্সড এ্যালবামের কাজ করেন। আর ফলাফল, সুপার ডুপার হিট একটি এ্যালবাম। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, লাকী আখন্দের সুরারোপে করা প্রতিটি গানের কথার ওপর সুরের যে প্রভাব, তা যে কাউকেই সহজে মুগ্ধ করবে। লাকী আখন্দকে তাই সুরের বরপুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না। সুর ও সঙ্গীতায়োজনের নান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনে তিনি কিংবদন্তি। সফট-মেলোডি, মেলো-রক, হার্ড-রক যেটাতেই হাত দিয়েছেন সেটাই হয়ে উঠেছে এক একটি মাস্টারপিস। জেমসের ‘লিখতে পারি না’ ও ‘ভালবেসে চলে যেওনা’ সুপার হিট হয়েছিল সেই সময়ে। এছাড়া এবি’র ‘কি করে বললে তুমি, তোমাকে হঠাৎ করে ভুলে যেতে’ কিংবা ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ কোন অংশে পিছিয়ে ছিল না।যেমনটি ছিল না হাসান, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ কিংবা সামিনা চৌধুরীর গানগুলোও। আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয় যখনই মনেপড়ে গানগুলোর সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হলেন ‘লাকী আখন্দ’। এছাড়াও ১৯৯৯-এ প্রাইম অডিওর ব্যানারে প্রকাশিত ব্যান্ড মিক্সড ‘দেখা হবে বন্ধু’ এ্যালবামে আর্কের জনপ্রিয় শিল্পী হাসানের জন্য একটি গানের সুরারোপ করেন তিনি। হাসানের গাওয়া সেই গানটি হলো ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা কিছু ভালবাসা দাও’। আজও অভিভূত হই হাসানের কণ্ঠের উপযোগী করে কি চমৎকার ভাবেই-না তিনি গানটি সুরারোপ করেছিলেন। অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা লাকী আখন্দ দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রাথমিকভাবে কেমোথেরাপি নেয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে আবার তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আশার কথা হলো শিল্পীর সুচিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছেন তার অগণিত ভক্ত ও শিল্পীরা।এরই পরিপ্রেক্ষিতে, ’ট্রিবিউট টু স্যার লাকি আখন্দ’ শিরোনামে টিএসসিতে হয়ে গেল দুই দিনব্যাপী কনসার্ট। ক্যান্সারে আক্রান্ত বাংলা সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র লাকী আখন্দকে সহযোগিতার জন্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি ব্যান্ড সোসাইটি এ উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম দিনে ১৪টি ও ২য় দিনে ১৬টি ব্যান্ড দল অংশ নেয়। ‘স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে তুমি আমায় ডেকো...তুমি আমায় ডেকো। এই নীল মনিহার এই স্বর্ণালি দিনে, তোমায় দিয়ে গেলাম... শুধু মনে রেখো।’ এই আকুতিটুকু ভোলা যায় না। সঙ্গীত জগতের এই কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পীকে আমাদের অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই। তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।
×