ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় ॥ পাশে দাঁড়ানো

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৫ আগস্ট ২০১৬

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় ॥ পাশে দাঁড়ানো

অভাব-অনটনে, অসুস্থতায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং যে কোন জাতীয় সংকটে বাঙালীর একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর রয়েছে আবহমান ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যই ১৯৫২ সালে উপহার দিয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য বাঙালী যেভাবে মুক্তিকামী মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল তা অবিস্মরণীয় ও নজিরবিহীন। মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানপন্থীরা আমাদের গ্রামের হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট করে। নিরুপায় হয়ে তারা জীবন রক্ষায় ভারতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার সময় তারা আমাদের বাড়িতে এসে জড়ো হয়। কিন্তু সঙ্গে নেবার মতো কিছুই নেই তাদের। বাবা সেদিন সাধ্যমতো চাল-ডাল, চিড়া-মুড়ি ও টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার একমাত্র চাচা ছিলেন নেত্রকোনা কলেজের অধ্যাপক। সেই সূত্রে উনার বহু ছাত্র ও বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতেন। বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে তাঁরা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে পা বাড়াতেন। কিছুদিন পর নেত্রকোনায় আমার চাচাকে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী গ্রেফতার করে এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার অভিযোগে হত্যা করে। পরে আমাদের বাড়ি-ঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। উদ্বাস্তু আমাদেরকে প্রাণ হারানোর ভয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে কেউ ঠাঁই দিতে রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে পাড়ি জমালাম পূর্বধলার লেটীরকান্দা এবং পরবর্তীতে বাড়হা গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে। এরকম সহযোগিতা না পেলে ভয়ংকর পরিণতি হতে পারত। ১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ খাদ্যাভাব। মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। দরিদ্র্য মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে ভাত খেতে চাইত। দাদিকে দেখতাম সারাদিনই ভাতের হাঁড়ি চড়িয়ে রাখতেন, কোন ক্ষুধার্ত যাতে খাবার চেয়ে ফেরত না যায়। একবার আমাদের গ্রামের এক হিন্দু বৃদ্ধলোক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পড়শী মুসলমান ভাইকে অনুরোধ করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে কিন্তু অনুরোধটি রক্ষা না করায় গ্রামের মুরব্বিরা তাকে সমাজচ্যুত করে। পাশে দাঁড়ানোর সম্প্রীতির এ মানসিকতা এ সমাজে বরাবরই ছিল। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় মানুষ যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল তা আজ ইতিহাস। একটি কলেজে দরিদ্র পঙ্গু বাবার একাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে উপবৃত্তির জন্য আবেদন করেছে কিন্তু রহস্যজনক কারণে সে তা পায়নি। জনৈক কলেজ শিক্ষক বিষয়টি জেনে- বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ছাত্রীটিকে দান করে। এক দম্পতি একত্রে দিনমজুরি করে সংসার চালায়। কিন্তু ওরা এতটাই সুখী যে পাড়ার মোড়ে চা খেতে গেলেও ওরা একসঙ্গে যায়। ওদের এ মধুর সম্পর্কটি দেখে গানের সে কলিটির কথা মনে পড়ে, ‘পাশেপাশে থেকো মোর চাই না কিছুই আর।’ বিশ্বায়ন ও যান্ত্রিকতার এ যুগে সমাজে অনৈতিকতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, অকৃতজ্ঞতা ও অমানবিকতা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে, যা কাম্য নয়। নৈতিক-সামাজিক মূল্যবোধ ও সুশাসন বলবৎ থাকলে বাঙালীর পাশে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য অটুট থাকবে। দুর্গাপুর, নেত্রকোনা থেকে
×