ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যাত্রীবাহী লঞ্চ চললেও পণ্যবাহী যান বন্ধ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৫ আগস্ট ২০১৬

যাত্রীবাহী লঞ্চ চললেও পণ্যবাহী যান বন্ধ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ধর্মঘটও চলছে লঞ্চও ছাড়ছে। নৌ-ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন বুধবার সদরঘাটের ছিল এই চিত্র। শুধু সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। দেশের বিভিন্ন রুট থেকে ছেড়ে আসা নৌযান সদরঘাটে ভিড়েছেও। তবে এ দিন পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় স্থবির ছিল দেশের দুই বন্দর। শ্রমিক নেতারা বলছেন, মালিকদের চাপে যাত্রীবাহী নৌযান চালাতে শ্রমিকরা বাধ্য হচ্ছেন। তবে পণ্যবাহী নৌযানে ধর্মঘট রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় নৌযান শ্রমিক নেতা চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, শ্রমিকরা মালিকদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল তাদের বেতন নৌপরিবহন মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী হয়নি। সঙ্গত কারণে চলতি মাসের বেতনের সঙ্গে ঘোষিত বেতনের বর্ধিত অংশ যোগ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাদের সঙ্গে মালিকদের সমঝোতা হয়েছে তারা কাজ করছে। আর যাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি তারা কাজ করছে না। তিনি বলেন জ্বালানি তেলবাহী জাহাজের মালিকদের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু পণ্যবাহী জাহাজের মালিকরা সরকারের এই ঘোষণা মানতে নারাজ। কোন কোন ক্ষেত্রে যাত্রীবাহী নৌযানেরও একই অবস্থা বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে সদরঘাট থেকে বুধবার স্বাভাবিকভাবে নৌযান চলাচলের দাবি করেন অভ্যন্তরীণ নৌযানের যাত্রী পরিবহন সংস্থা। লঞ্চ মালিকদের সংগঠনটি দাবি করছে বুধবার ৪০ থেকে ৪২টি লঞ্চ সদরঘাট ছেড়ে গেছে। সাধারণত রোটেশন প্রক্রিয়ায় চলাতে এই রকম নৌযানই ছেড়ে যায়। সংগঠনের সচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারি জানান, সাধারণ শ্রমিকদের কেউই ধর্মঘটে সাড়া দেয়নি। তারা সকলেই লঞ্চ চালাচ্ছে। সদরঘাট থেকে স্বাভাবিকভাবে সকল লঞ্চ বুধবার ছেড়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি। মাসিক ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা মজুরি, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ পুনর্নির্ধারণ, নৌপথে সন্ত্রাসী-ডাকাতি-চাঁদাবাজি বন্ধ ও নদীর নাব্য রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়ার দাবিতে মঙ্গলবার থেকে দেশের সব নদীবন্দরে ধর্মঘটের ডাক দেয় নৌশ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ। স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, বুধবার ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেও অচলবস্থা ছিল বন্দর বহির্নোঙ্গরে। পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় মাদার ভ্যাসেলগুলোকে অলস ভেসে থাকতে হয়। এছাড়া ঘাটে ঘাটে কর্মহীন নোঙ্গর করা রয়েছে লাইটার জাহাজগুলো। জলপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের প্রাণহীনতা। ধর্মঘটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ কন্টেনারজাত হয় না এমন পণ্যগুলো। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ঘাটগুলোতে নেই শ্রমিকদের হাঁকডাক। তবে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রয়েছে মিছিল-সমাবেশ। সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ বশির জানান, এর আগে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আশ্বাস মিলেছিল দাবি মেনে নেয়ার। কিন্তু সে আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি জানান, গত ২৬ এপ্রিল নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জাতীয় স্কেলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নৌযান শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী মজুরি সর্বনিম্ন ৯ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ১০০ টাকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন ঘটেনি। বন্দর সূত্রে জানা যায়, কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে সমস্যা না হলেও নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে বহির্নোঙ্গরে। সেখানে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস এক প্রকার বন্ধ। তবে অয়েল ট্যাংকারগুলো চালু রয়েছে। জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোস্টার ভ্যাসেল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরাও চাই না বিষয়টি ঝুলে থাকুক। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সকল পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। কেননা দফায় দফায় এ ধরনের কর্মসূচীতে ব্যবসাবাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে। প্রসঙ্গত, নৌযান শ্রমিকদের বাকি তিনটি দাবি হচ্ছে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ, নৌপথে ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও দুস্যতা বন্ধ এবং জলপথের নাব্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। নিজস্ব সংবাদদাতা, মংলা থেকে জানান, নৌযান শ্রমিকদের চলা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের বুধবারও মংলা সমুদ্রবন্দরে কোন কাজ হয়নি। বন্দরে আসা দেশী-বিদেশী বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহন কাজ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে মংলা বন্দরের সাথে সারাদেশের নৌ-যোগাযোগ। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে দেশের দ্বিতীয় এ সমুদ্রবন্দর। বিভিন্ন ধরনের আমদানি পণ্য নিয়ে বন্দরে অলসভাবে পড়ে থাকা জাহাজ হতে মালামাল খালাস করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণ, উৎপাদন ব্যাহতসহ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বন্দর জেটি ও চ্যানেলে পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বিদেশী জাহাজগুলো অলস পড়ে থাকায় মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়া পণ্য বোঝাইয়ের জন্য বন্দর চ্যানেলে সারিবদ্ধভাবে নোঙ্গর করে রয়েছে শত শত পণ্যবাহী নৌযান। নৌ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ওয়েজুল ইসলাম বুলবুল বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নৌযান শ্রমিকদের এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খান মঙ্গলবার মালিক পক্ষকে দাবি মেনে নিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বললেও মালিকপক্ষ এখনও তাতে সাড়া দেয়নি। স্টাফ রিপোর্টার বরিশাল থেকে জানান, নৌ-যান শ্রমিকদের ডাকা দ্বিতীয় দিনের লাগাতার কর্মবিরতীর ফলে বরিশাল নৌ-বন্দর টার্মিনাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চসহ নদীপথে সব ধরনের মালবাহী কার্গো চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। বুধবারও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রুটের ৩৫টি লঞ্চের একটি ছেড়ে যায়নি। বন্ধ রয়েছে নদীপথে চলাচলকারী মালবাহী কার্গোগুলো। নৌযান নিরাপত্তায় টার্মিনালে নিয়োজিত রয়েছে নৌ-পুলিশ সদস্যরা। অপরদিকে দাবি আদায়ের লক্ষে বুধবার বেলা ১১টার দিকে বরিশাল নদীবন্দর পন্টুুনে সমাবেশ করেছে নৌযান শ্রমিকরা। সমাবেশে তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত লাগাতার কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময় শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, লঞ্চ মালিকরা শ্রমিকদের চাপের মুখে নৌযান চালাতে বাধ্য করছেন। নিজস্ব সংবাদদাতা চাঁদপুর থেকে জানান, ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে ৪ যাত্রীবাহী লঞ্চ। তবে ধর্মঘট থাকার কারণে যাত্রী সংখ্যা অনেক কম। বুধবার সকাল ৭টা ২০ মিনিট থেকে ১২টার মধ্যে এসব লঞ্চ ছেড়ে যায়। সকাল ৭.২০ মিনিটে ছেড়ে যায় এমভি সোনারতরী-২, ৮টায় এমভি মহিমা,এমভি জলতরঙ্গ ৯টা ৪০ মিনিটে এবং এমভি প্রিন্স অব রাসেল ছাড়ে দুপুর ১২টায়। চাঁদপুর লঞ্চঘাটের মালিক প্রতিনিধি রহুল আমিন জানান, শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে ধর্মঘট ডাক দিলেও আমরা যেসব লঞ্চের প্রতিনিধিত্ব করি, সেসব লঞ্চের মালিকগণ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিয়ে আসছে। সে কারণে আমাদের লঞ্চগুলো জনসাধারণের সুবিধার্থে ছেড়ে যাচ্ছে। নৌযান শ্রমিক লীগ নেতা বিপ্লব সরকার জানান, তাদের ধর্মঘট চলছে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে। তবে যেসব লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে, সেগুলোর শ্রমিকরা হয়ত তাদের দাবি পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন। নিজস্ব সংবাদদাতা ভোলা থেকে জানান, দ্বিতীয় দিনের মতো নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকায় অচল হয়ে পড়েছে দ্বীপজেলা ভোলার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে করে দ্বীপের হাজার হাজার যাত্রী চরম দুভোর্গে রয়েছে। তবে শুধু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভোলা খেয়াঘাট থেকে কর্ণফুলী লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে চলাচল করছে। কিন্তু অন্য কোন কোম্পানির লঞ্চ ভোলা-ঢাকা রুটে চলাচল করছে না। এমনকি জেলার অন্য কোন উপজেলা থেকেও লঞ্চ চলাচল করছে না। দ্বীপ জেলার ভোলা থেকে অন্য কোন জেলায় যাওয়ার প্রধান মাধ্যম নৌপথ হওয়ায় যাত্রীদের ভোগান্তির এখন শেষ নেই। ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন ভোলা ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটে দেখা যায়, বরিশালের উদ্দেশে কোন লঞ্চ ছেড়ে না যাওয়ায় জরুরী প্রয়োজনে ট্রলার, স্পিডবোট দিয়ে রোগীসহ সাধারণ মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। ভোলা থেকে বিআইডব্লিউটিসি’র সরকারী কোন নৌযান না থাকায় ভোলার যাত্রীরা এখন লঞ্চ মালিকদের কাছে জিম্মি অবস্থায় রয়েছে। এতে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। ভোলা সদরের খেয়াঘাট টার্মিনালে ভোলা-ঢাকা রুটের লঞ্চগুলো নোঙ্গর করে থাকলে কর্ণফুলী লঞ্চ ছাড়া অন্য সকল লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে। কর্ণফুলী-১০ লঞ্চের মাস্টার বাবুল সিকদার জানান, তাদের মালিক কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার জোরপূর্বক লঞ্চ চালাতে বাধ্য করে। তাদের দাবি না মানলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখবে বলে তারা জানান। তবে খেয়াঘাটে অপর লঞ্চ শ্রমিকরা জানান,আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে কর্ণফুলী লঞ্চ মালিক পক্ষ শ্রমিকদের এ ধর্মঘটকে অযৌক্তিক বলে দাবি করেছেন। তারা ভোলা শহরে মাইকিং করে ভোলা-ঢাকা রুটে তাদের লঞ্চ চলাচল করছে বলে যাত্রীদের জানাচ্ছেন। অপর দিকে ঢাকা থেকেও তাদের লঞ্চ চলাচল অব্যহত রয়েছে বলে তারা জানান।
×