ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দরিদ্র মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না, ব্যয় নাগালের বাইরে ॥ মেডিক্যাল শিক্ষা কি শুধু বিত্তশালীদের

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৫ আগস্ট ২০১৬

দরিদ্র মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না, ব্যয় নাগালের বাইরে ॥ মেডিক্যাল শিক্ষা কি শুধু বিত্তশালীদের

নিখিল মানখিন ॥ গরিব পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থী সোহেল রহমান। ময়মনসিংহের তারাকান্দা থানা সদর এলাকায় তাঁর বাড়ি। গত বছর মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সরকারী মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পাননি তিনি। তবে যেখানে সরকারী মেডিক্যাল কলেজের মেধাস্কোর শেষ তা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না সোহেল রহমানের মেধাস্কোর। দেশের প্রথম শ্রেণীর বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার মেধাস্কোর ছিল তার। কিন্তু উচ্চ ভর্তি ও আনুষঙ্গিক ফি মেটাতে না পেরে তিনি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। তার জায়গা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এভাবে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের উচ্চ ফি যোগান দিতে না পেরে প্রতিবছর দরিদ্র পরিবারের অনেক মেধাবীমুখ মেডিক্যাল শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ছে। গত বছরও বেসরকারী কলেজের নির্ধারিত আসনের তিনগুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু শিক্ষার্থী সংকট বলে দাবি করেছে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের মালিকপক্ষ। এমনিতেই বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর জন্য উচ্চ ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রী সম্পন্ন করতে মোট খরচ হবে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এই ফি যোগান দেয়াটাই অনেক শিক্ষার্থীর নাগালের বাইরে। তার মধ্যে সরকারী নির্ধারিত এই ফি মেনে চলে না অধিকাংশ বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ। একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লাগে বলে অভিযোগ করেছেন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। এবার মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এমবিবিএসের ভর্তি পরীক্ষা আগামী ৭ অক্টোবর ও বিডিএসের (ডেন্টাল) পরীক্ষা ৪ নবেম্বর হবে। এছাড়া এবার ভর্তির আবেদনে এসএসসি ও এইচএসসিতে মোট জিপিএ-৯ থাকতে হবে। আগে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল জিপিএ-৮। গত বছরের মতো এবারও লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ বহাল রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রবিবার ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তি সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ২৯টি সরকারী মেডিক্যাল কলেজে আসন সংখ্যা ৩ হাজার ১৬২ জন। অন্যদিকে ৬৪টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে আসন ৫ হাজার ৩২৫টি। সরকারী ৯টি ডেন্টাল কলেজে ৫৩২টি আসন রয়েছে। ২৪টি বেসরকারী ডেন্টাল কলেজে আসন ১ হাজার ২৮০টি। সরকারীভাবে ফি নির্ধারণ ॥ দীর্ঘ সমালোচনা ও আলোচনার পর গত বছর বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এক প্রজ্ঞাপনও জারি করে। বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়তি অর্থগ্রহণ ঠেকাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো ভর্তি ফি বাবদ ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিতে পারবে। ইন্টার্ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া পাঁচ বছরে মোট টিউশন ফি বাবদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফি নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রী সম্পন্ন করতে মোট খরচ হবে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে ইন্টার্ন ফি বাবদ কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে টাকা গ্রহণ করবে পরবর্তীতে ইন্টার্নশিপ করার সময় তার লভ্যাংশসহ ফেরত দেবে। অথচ সরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি মাত্র ১২ হাজার টাকা (তিন মাসের টিউশন ফিসহ)। নির্ধারিত ফি’র দ্বিগুণ খরচ ॥ এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতি বছরের মতো এবারও ভর্তি ফি’র বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে। গত বছর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুধু ভর্তি ফি ১৪ লাখ ২০ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা। যা কাগজে-কলমে লিখিত থাকে না। প্রথম শ্রেণীর মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে অনেক শিক্ষার্থীর গোপনে মোটা অংকের টাকা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি ফি নিয়ে এবারও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন অনেক মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। গত সেশনের অভিজ্ঞতা তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর নিজেদের মতো করে বাড়তি ভর্তি ও কোর্স ফি আদায় করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে আসছে। বিগত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফি, উন্নয়ন ব্যয়, বিধিসহ নামে-বেনামে অনেক খাতের অজুহাত দেখিয়ে চড়া ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের বিষয়টি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। এ বিষয়ে বিএমএ’র সাবেক সভাপতি এবং ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি রশিদী-ই মাহবুব জনকণ্ঠকে জানান, সদিচ্ছা থাকলেই সহনশীল ভর্তি ফি নির্ধারণ করতে পারে সরকার। বৈষম্য দূরীকরণে অতি দ্রুত সরকারী হস্তক্ষেপ দরকার। আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি সুরাহা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে এখনও ভর্তি ফি কম নেয়া হয় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনারস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডাঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, মেডিক্যাল কলেজ পরিচালনা করা কোনভাবেই লাভজনক নয় বলে এ সেক্টরে বড় বড় ব্যবসায়ীর মুখ দেখা যায় না। জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যেই মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। তাই ব্যবসায়িক কারণে নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তা করতে হয়। প্রতিষ্ঠান চালানোর চাহিদা ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন বাড়তি টাকা নেয়া হয় না বলে জানিয়েছেন বেসরকারী কলেজের কর্তৃপক্ষরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ভর্তি ফি হিসেবে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়ে থাকে বলে জানান মহাসচিব ডাঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত জানান, একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা খুবই ব্যয়বহুল। ভারতে প্রথম শ্রেণীর কয়েকটি কলেজে ভর্তি ফি হিসেবে শিক্ষার্থী প্রতি এক কোটি টাকাও নেয়া হয়ে থাকে বলে তিনি দাবি করেন।
×