ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাটর্নি জেনারেল মত দিয়েছেন পক্ষে

ট্রাইব্যুনাল সরানোর বিপক্ষে অবস্থান আইনজীবীদের

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৫ আগস্ট ২০১৬

ট্রাইব্যুনাল সরানোর বিপক্ষে অবস্থান আইনজীবীদের

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুরাতন হাইকোট ভবন থেকে সরিয়ে নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়াতে সুপ্রীমকোর্ট বারের সভাপতি, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানসহ আইনজীবী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এতে বিচারপতি, প্রসিকিউটর, বিচারপ্রার্থী, সাক্ষীগণের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। পাশাপাশি স্মৃতিবিজড়িত এই ভবনটি বিচার শেষে যাতে জাদুঘরে পরিণত করা হয় তার উদ্যোগও বিফলে যাবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি উৎসাহিত হবে। অন্যদিকে দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা মনে করেন পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরালে বিচার প্রক্রিয়ায় কোন প্রভাব পড়বে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তৎকালীন প্রধানবিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে অনুমতি দিয়েছিলেন। আগামী বছরের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৭ বছর পূরণ করবে। এরই মধ্যে ২৬টি মামলায় ৫২ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যুদ-, এক জনের যাবজ্জীবন, একজনের ৯০ বছরের কারাদ- এবং ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে পলাতক আছে ২১ জন। আরও ডজন খানেক মামলার বিচারকাজ চলছে। পাশাপাশি তদন্ত সংস্থা অর্ধ শতাধিক মামলার তদন্ত করছে। সে মামলাগুলোও ট্রাইব্যুনালে আসবে। মঙ্গলবার সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে বর্তমানে পর্যাপ্ত স্থানাভাবে বিচারপতিগণের প্রয়োজনীয় চেম্বার ও এজলাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে সুপ্রীমকোর্ট রেজিস্ট্র্রার অফিসের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চেম্বার দফতরের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও প্রকট হবে বিধায় জরুরী ভিত্তিতে বিচারপতিগণের চেম্বার ও এজলাস এবং কর্মকর্তা- কর্মচারীদের অফিস হিসেবে ব্যবহারের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় স্থানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এই চিঠি দেয়ার পর পরই দেশের সুশীল সমাজের পাশাপাশি আইনজীবীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমাযুন জনকণ্ঠকে বলেছেন, হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিরাপত্তা, প্রসিকিউটরদের নিরাপত্তার পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা বলছি ্ট্রাইব্যুনাল সরানোর দরকার নেই। আমার অনুরোধ থাকবে প্রধান বিচারপতি এই ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে দিবেন না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পর এই ভবনের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে গেছে। অন্যদিকে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদারও ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়ার বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, আইনজীবীদের নিরাপত্তাসহ সকল বিষয় চিন্তাভাবনা করেই এখান থেকে ট্রাইব্যুনাল সরানো উচিত হবে না। এদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, সুপ্রীমকোর্ট এলাকায় অবস্থিত পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরলেও তাতে বিচার প্রক্রিয়ায় কোন প্রভাব পড়বে না। বুধবার নিজ দফতরের সম্মেলন কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নাই। বিচার প্রক্রিয়ায় এটা কোন প্রভাব বিস্তার করবে না।” একটি রায়ের মাধ্যমে সড়ক ভবন পাওয়ার পরও ‘পরিত্যক্ত পুরাতন হাইকোর্ট ভবন’ কেন দরকার- এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “যুদ্ধাপরাধ মামলায় কত দিনে রিভিউ দায়ের হয়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে, এটার জন্য আমি আপীল বিভাগের রেকর্ডরুমে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। মামলার নথি যেভাবে রাখা হয়েছে, সেখানে নড়াচড়া করার জায়গা নাই।” “আসলে আদালতের প্রচুর জায়গা দরকার। বিচারপতিদের বসার জায়গা নাই, তারা বারান্দাতে বসছেন, রেকর্ড যেভাবে রাখা হচ্ছে, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতে।” ভবনটি নির্মাণের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, “সত্যিকার অর্থে এই ভবন যখন করা হয়, তখন পূর্ব পাকিস্তান একটা প্রদেশ ছিল। এখন বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র, শুধু স্বাধীন রাষ্ট্র না, একটি অগ্রসরগামী দেশ। যে দেশ অন্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। বিশেষ করে, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগ ইত্যাদির ব্যাপারে। পুরাতন এই ভবন ফিরিয়ে এনে কাজে না লাগিয়ে ঐতিহ্য বিবেচনায় সংরক্ষণ করা প্রয়োজন কি না, এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এই ভবনটা দেখতে খুবই সুন্দর। এটা হয়েছে ১৯০৫ সালে। আমি আমার গ্রামে যেখানে পড়েছি, সেই স্কুলটা হয়েছে ১৯০৫ সালে। কাজেই সময়ের দিক থেকে এই ভবনটা এমন কোন পুরনো ভবন না।” যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ আরও অনেক ঘটনা বিবেচনায় ভবনটি সংরক্ষণ করা দরকার কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছেন বিচারকরা। বিল্ডিং করে নাই। সেগুলো সংরক্ষিত হবে রায় দিয়ে। রায়গুলো চিরদিন থাকবে।” বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমি মনে করি কিছু কিছু জাতীয় বিষয় আছে যা নিয়ে বিতর্ক করা উচিত নয়। আমরা অনেক আন্দোলন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করেছি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এখানে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। ঢাকার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এখানে আরও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মারক হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি অবিলম্বে সরকারের উচিত এটিকে সংরক্ষণযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা। সংবিধান অনুয়ায়ী সরকার তখন এই ভবন রক্ষা করতে বাধ্য। ৪০ বছর রাস্তায় থেকেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। কোন নির্দেশ বা আদেশ দিয়ে আমাদের সরানো যাবে না। এটাই সর্বমহলের জানা উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অন্যতম সাক্ষী সিরু বাঙালী বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল সরানো উচিত হবে না। ট্রাইব্যুনাল সরালে অনেক সাক্ষী নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবে আর এগিয়ে আসবেন না। আমি মনে করি যেখানে ট্রাইব্যুনাল আছে সেখানেই থাকা উচিত। আর ট্রাইব্যুনালও সুপ্রীমকোর্টের একটি অংশ। সেখানে হাইকোর্টের বিচারপতিগণ আছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এই জায়গা এমনি এমনি আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। এটা স্থায়ীভাবে চাই। বিচার একদিন শেষ হবে। তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কোন তুঘলকি কারা সহ্য করব না। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। সরকার যদি বলে অন্য জায়গায় কাজ করতে হবে সেটিই মেনে নেব। তবে এ জায়গার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। আগামী মার্চে ৭ বছর পূর্ণ করব। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ করা যেমন জরুরী, তেমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করা দরকার। সে ক্ষেত্রে একটি দালান গুরুত্বপূর্ণ। আরেক প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল সরানোর উদ্যোগের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী কর্মকা-­যেটা সেটা বেগবান হবে।
×